বিশেষ নিবন্ধ

এটা কি অন্নদাতাদের সম্মান, না অপমান!
তন্ময় মল্লিক

‘লাঙলের টুকরোর স্ট্যাচুই কৃষকদের সর্বোচ্চ সম্মান।’ দিল্লিতে আন্তর্জাতিক কৃষি-অর্থনীতিবিদদের সম্মেলনে এই মন্তব্য করেছেন আমাদের প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদি। একথা বলার কারণ? দেশের কৃষকরা যে তাঁর আমলেই সর্বোচ্চ সম্মান পেয়েছে, সেটা বিশ্ববাসীকে বোঝানো। প্রধানমন্ত্রী একথা বলে দেশের কৃষকদের সম্মান জানালেন, নাকি করলেন অপমান! মোদিজি, আমাদের কৃষকরা দধীচি মুনির উত্তরসূরি। দেবতাদের রক্ষার জন্য বজ্র তৈরি করতে দধীচি মুনি জীবন উৎসর্গ করেছিলেন, দিয়েছিলেন নিজের অস্থি। আর আমাদের অন্নদাতারা? রক্ত জল করা পরিশ্রমের বিনিময়ে রক্ষা করে চলেছেন আমাদের জীবন। সেই ঋণ কি একটা মূর্তি গড়ে শোধ হয়, নাকি তাদের সম্মানিত করা যায়? 
পুরাণ মতে, অসুরদের দাপটে স্বর্গচ্যুত দেবদেবীরা গিয়েছিলেন দধীচি মুনির কাছে। কারণ মহাদেবের বরে কাঠ বা কোনও ধাতব অস্ত্রে অসুরদের বধ করা সম্ভব ছিল না। প্রয়োজন ছিল দধীচি মুনির অস্থি। দেবকূলকে রক্ষার জন্য দধীচি মুনি দেহত্যাগ করেছিলেন। তাঁর অস্থি দিয়ে তৈরি বজ্রেই বিনাশ হয়েছিল অসুরকূলের। রক্ষা পেয়েছিলেন দেবতারা।
চাষিরাও আমাদের জীবন রক্ষা করে চলেছেন। তাঁরা আমাদের মুখের অন্ন জোগান বলেই আমরা বেঁচে আছি। তাঁদের রক্ত জল করা পরিশ্রমেই বীজ থেকে গাছ, গাছ থেকে ফসল হয়। শুধু পরিশ্রমই নয়, প্রতিটি পর্যায়ে থাকে চরম অনিশ্চয়তা। বিপুল আর্থিক দায় মাথায় নিয়ে তাঁরা চাষ করেন। বীজ বোনা থেকেই শুরু হয় প্রকৃতির সঙ্গে লড়াই। কখনও অনাবৃষ্টি, কখনও অতিবৃষ্টি। পদে পদে প্রাকৃতিক প্রতিকূলতা। সেই লড়াই সফল হলে তবেই গোলায় ওঠে সোনালি ফসল। তবে লড়াই সেখানেই শেষ নয়। বরং বলা ভালো, সেখান থেকেই লড়াইয়ের শুরু। ফসলের ন্যায্যমূল্য আদায়ের লড়াই।
সমস্ত উৎপাদিত দ্রব্যের দাম ঠিক করে উৎপাদক সংস্থা। কিন্তু কৃষিপণ্যের দাম ঠিক করার অধিকার চাষির নেই। তাঁরা ব্যবসায়ীদের ঠিক করা দামে 
বীজ কিনে, কোম্পানির নির্ধারিত এমআরপির চেয়ে বেশি টাকায় সার কিনে, চাষ করবেন। অথচ, কৃষিপণ্যের মূল্য ঠিক করবে মধ্যসত্ত্বভোগীর দল। যাদের ডাক নাম ‘ফোড়ে’। বাজারে চাহিদা থাকলে তাঁরা ফসল কেনেন। আর না থাকলে? তাঁরা ততক্ষণ হাত গুটিয়ে বসে থাকেন যতক্ষণ না চাষির রক্ত জল করা পরিশ্রমের ফসল বিক্রি হয় জলের দরে। তাতে চাষির মাথায় চাপে ঋণের বোঝা। আর সেই বোঝা যখন অসহনীয় হয়ে ওঠে? তখন সবকিছু থেকে নিষ্কৃতির আশায় কেউ দেন গলায় দড়ি, কেউ হাতে তুলে নেন বিষের শিশি।
অনেকের বিশ্বাস, কৃষিঋণ মকুব করলে পরিস্থিতির কিছুটা উন্নতি হতে পারে। সেই ভাবনা থেকেই কংগ্রেস নেতৃত্বাধীন ইউপিএ সরকার ২০০৯ সালে ক্ষমতায় এসে ৭২ হাজার কোটি টাকার কৃষিঋণ মকুব করেছিল। সেই একই রাস্তায় হেঁটে উত্তরপ্রদেশ, মহারাষ্ট্র, পাঞ্জাব ও কর্ণাটকে হাজার হাজার কোটি টাকার কৃষিঋণ মকুব করা হয়েছে। অনেকে মনে করেন, কৃষিঋণ মকুব করে চাষিদের সাময়িক স্বস্তি দেওয়া যায়। কিন্তু এটা 
কোনও স্থায়ী সমাধান হতে পারে না। উল্টে ক্ষতিই 
হয়। ঋণ নিয়ে তা পরিশোধ না করার ইচ্ছায় ইন্ধন জোগায়। তাহলে দেশের অন্নদাতাদের জন্য সরকারের করণীয় কী?
চাষিদের একটা বড় অংশ মনে করে, সারের দামের উপর সরকারের নিয়ন্ত্রণ থাকা দরকার। ক্ষুদ্র ও প্রান্তিক  চাষিরা যাতে কম দামে সার কিনতে পারেন তারজন্য দিতে হবে ভর্তুকি। উৎপাদন খরচের একটা বড় অংশ চলে যায় সার কিনতে। তাই সারের দাম কমলে উৎপাদন খরচ কমবে। সেক্ষেত্রে কমে যাবে লোকসানের ঝুঁকিও। আপাতত ২৩টি পণ্য ন্যূনতম সহায়ক মূল্যের তালিকায় আছে। যদিও হাতেগোনা দু’চারটি ফসল ছাড়া সরকার কিছুই কেনে না। এই তালিকায় আলু সহ আরও কিছু নিত্যপ্রয়োজনীয় পণ্যকে যুক্ত করতে হবে। সহায়কমূল্য নির্ধারণের আগে সার, বীজ, মজুরি, সেচের খরচ বৃদ্ধির বিষয়গুলিও দেখতে হবে। ঠান্ডাঘরে বসে মর্জিমাফিক একটা দাম ঠিক করে দিলেই হবে না। মনে রাখতে হবে, চাষিরা ঘরের পয়সায় বেশিদিন রামযাত্রা চালিয়ে যাবেন না।
শুধু সহায়ক মূল্য ঘোষণা করলেই হবে না, চাষি যাতে সেই মূল্য পায়, তা নিশ্চিত করতে হবে। চাষির কাছ থেকে কৃষিপণ্য কিনে সংরক্ষণ করতে হবে। তাতেই চাষিদের ফসলের লাভজনক দাম পাওয়া নিশ্চিত হবে। সরকার ফসল সংরক্ষণ করলে পণ্যের মূল্যবৃদ্ধিতেও লাগাম পরানো যাবে। সংরক্ষিত পণ্য বাজারে ছাড়লে বন্ধ হবে ফাটকাবাজির রাস্তা। 
তারজন্য বিপুল পরিমাণ অর্থেরও প্রয়োজন নেই, দরকার সরকারের সদিচ্ছা। প্রশ্নটা হচ্ছে, কেন্দ্রীয় সরকার যদি শিল্পপতি ও বহুজাতিক কোম্পানির হাজার হাজার কোটি টাকা ঋণ মকুব করতে পারে, তাহলে দেশের অন্নদাতাদের বাঁচিয়ে রাখতে ভর্তুকি দেবে না কেন? আসলে নরেন্দ্র মোদির সরকারের সেই সদিচ্ছাটাই নেই। তারজন্যই নতুন কৃষি আইন করে কৃষিপণ্যের ন্যূনতম সহায়ক মূল্যের বিষয়টি তুলে দিতে চেয়েছিল। 
বিজেপি সরকার গোটা কৃষি ব্যবস্থাটাকে কর্পোরেট ও বহুজাতিক সংস্থার হাতে তুলে দেওয়ার পরিকল্পনা করেছিল। তারজন্য পাশ করিয়েছিল নয়া কৃষি আইন। তাতে শুধু চাষিরাই বঞ্চিত হতেন না, নিত্যপ্রয়োজনীয় পণ্যের দামও আকাশছোঁয়া হতো। আইনে নিত্যপ্রয়োজনীয় দ্রব্যের মজুতদারির উপর সরকারের নিয়ন্ত্রণ থাকত না। সেই আইন কার্যকর করার জন্য সরকার আন্দোলনকারী চাষিদের উপর লাঠিচার্জ করতে, এমনকী জলকামান দাগতেও পিছপা হয়নি। কিন্তু কৃষকদের অনমনীয় জেদের কাছে হার মেনেছে সরকার। চাপে পড়ে ‘কালা কানুন’ প্রত্যাহার করলেও কৃষক-বিরোধী ছাপটা মোদিজির গায়ে লেগেই গিয়েছে। দিল্লিতে কৃষি বিষয়ক আন্তর্জাতিক সম্মেলনে সর্দার বল্লভভাই প্যাটেলের মূর্তির প্রসঙ্গ তুলে বিদেশি প্রতিনিধিদের কাছে সেই দাগটা মুছে ফেলতে চেয়েছিলেন তিনি। 
কৃষকদের উপকার হবে, এমন কোনও ঘোষণা দিল্লির সম্মেলনে প্রধানমন্ত্রী করেননি। সারের ভর্তুকি বা ফসলের ন্যূনতম সহায়ক মূল্য নিয়ে একটি কথাও বলেননি। ঘুরিয়ে ফিরিয়ে নিজের কৃতিত্বই জাহির করেছেন। বুক ফুলিয়ে বলেছেন, ৬ লক্ষ গ্রামের কৃষকের কাছ থেকে তাঁদের লোহার যন্ত্রপাতির টুকরো গলিয়ে বল্লভভাই প্যাটেলের স্ট্যাচু তৈরি করা হয়েছে। ৬০তলা বিল্ডিংয়ের সমান উঁচু স্ট্যাচু দর্শনের সুযোগ যেন বিদেশ থেকে আগত অতিথিরা হাতছাড়া না করেন, সেকথাও স্মরণ করিয়ে দিয়েছেন। তাঁর দাবি, ‘একজন কৃষকপুত্রকে এমন সম্মান গোটা দুনিয়ায় আজ পর্যন্ত কেউ দেয়নি।’ 
তাহলে মোদ্দা কথাটা কী দাঁড়াল? ভারতে কৃষকদের যোগ্য সম্মান জওহরলাল নেহরু, ইন্দিরা গান্ধী, রাজীব গান্ধী, মনমোহন সিং কেউই দেননি। এমনকী ভারতরত্ন অটলবিহারী বাজপেয়িও দেননি, দিয়েছেন নরেন্দ্র দামোদরদাস মোদি।
২০২০ সালে দেশের কৃষকদের আয় তিন বছরের মধ্যে দ্বিগুণ করার প্রতিশ্রুতি দিয়েছিলেন নরেন্দ্র মোদি। আয় বৃদ্ধি নিয়ে বিতর্ক থাকতেই পারে, কিন্তু তাঁর আমলে কৃষক আত্মহত্যা যে বেড়েছে তাতে দ্বিমত নেই। কেন্দ্রীয় স্বরাষ্ট্র মন্ত্রকের ‘ন্যাশনাল ক্রাইম রেকর্ডস ব্যুরো’র রিপোর্ট কী বলছে? কৃষি পেশার সঙ্গে যুক্ত আছেন এমন ৩০জন আত্মহত্যা করছেন প্রতিদিন। ২০২১ সালে আত্মঘাতী হয়েছেন ১০ হাজার ৮৮১জন। তার মধ্যে ৫ হাজার ৩১৮জন চাষি। বাকি খেতমজুর। অর্থনীতিবিদ এবং সমাজবিজ্ঞানীরা মনে করছেন, ঋণ নিয়ে তা শোধ করতে না পারা, ফসলের লাভজনক দাম না পাওয়া, পেশার অনিশ্চয়তা প্রভৃতি কারণে আত্মহত্যার ঘটনা ঘটছে এবং এই প্রবণতা বাড়ছে। এরপরেও কি বিশ্বাস করতে হবে, মোদিজির রাজত্বে কৃষকরা ভালো আছেন এবং সম্মানিত হচ্ছেন?
কাজী নজরুল ইসলাম বহু যুগ আগে লিখেছিলেন, ‘যে দধীচিদের হাড় দিয়ে ওই বাষ্প-শকট চলে, বাবুসা’ব এসে চড়িল তাহাতে, কুলিরা পড়িল তলে।’ সময় বদলালেও পরিস্থিতি পাল্টায়নি। ফের প্রমাণ হল, যুগে যুগে ‘দধীচি’রা আত্মত্যাগই করে যান। বিনিময়ে জোটে শুধুই অবহেলা। মোদিজি, বিশ্বের সর্বোচ্চ মূর্তি গড়ায় ইতিহাসের পাতায় আপনার নাম অবশ্যই জ্বলজ্বল করবে। তারজন্য আপনি আত্মশ্লাঘা অনুভব করতেই পারেন, আপনি সম্মানিত হতেই পারেন। কিন্তু চাষিরা হন না। কারণ আপনার রাজত্বে তাঁরা ক্রমশ তলিয়ে যাচ্ছেন আঁধারে। অপ্রিয় হলেও এটাই বাস্তব। এ কি অন্নদাতাদের সম্মান, না অপমান!
1Month ago
কলকাতা
রাজ্য
দেশ
বিদেশ
খেলা
বিনোদন
ব্ল্যাকবোর্ড
শরীর ও স্বাস্থ্য
সিনেমা
প্রচ্ছদ নিবন্ধ
আজকের দিনে
রাশিফল ও প্রতিকার
ভাস্কর বন্দ্যোপাধ্যায়
mesh

বহু প্রচেষ্টার পর আটকে থাকা কাজের জটিলতা মুক্তি। কৃষিজ পণ্যের ব্যবসায় বিশেষ উন্নতি। আয় বাড়বে।...

বিশদ...

এখনকার দর
ক্রয়মূল্যবিক্রয়মূল্য
ডলার৮৩.১৫ টাকা৮৪.৮৯ টাকা
পাউন্ড১০৭.৭৯ টাকা১১১.৩৩ টাকা
ইউরো৯০.৯৫ টাকা৯৪.১৩ টাকা
[ স্টেট ব্যাঙ্ক অব ইন্ডিয়া থেকে পাওয়া দর ]
*১০ লক্ষ টাকা কম লেনদেনের ক্ষেত্রে
দিন পঞ্জিকা