বিশেষ নিবন্ধ

জাস্টিস ফর আর জি কর
শান্তনু দত্তগুপ্ত

জাস্টিস ফর অভয়া।
আপনি কি অভয়ার আসল নাম জানেন? তার হাতের লেখা কেমন ছিল? কিংবা তার ডাক্তারি রেজিস্ট্রেশন নম্বর? মৃত্যুর পর কেমন দেখতে হয়েছিল তাকে? হয়তো জানেন। সৌজন্যে? সোশ্যাল মিডিয়া। অথচ, এমন কোনওটাই আপনার-আমার জানার কথা ছিল না। দেশের আইন অন্তত তাই বলে। সুপ্রিম কোর্টের নির্দেশ ছিল, নির্যাতিতার নাম, ছবি, ঠিকানা এবং এমন কোনও কিছু আমরা প্রকাশ করতে পারি না... যাতে সে চিহ্নিত হয়ে যায়। দিল্লিতে নির্ভয়াকে নারকীয় অত্যাচারের প্রতিবাদেও কিন্তু গোটা দেশ পথে নেমেছিল। কিন্তু আপনি কি জানেন, নির্ভয়ার আসল নাম কী? কবে জানতে পেরেছিলেন? দেখেছিলেন কি তাঁর ক্ষতবিক্ষত ছবি? কেন জানতে পারেননি জানেন? কারণ, তখন আমরা সত্যিই সুনাগরিকের ভূমিকা নিয়েছিলাম। আর সবচেয়ে বড় কথা, মোবাইল ফোন তখন ষড়যন্ত্রের হাতিয়ার ছিল না। ফরওয়ার্ড, শেয়ার করে আমরা তখন নির্ভয়াকে প্রতিদিন, প্রতি মুহূর্তে আরও বেশি লাঞ্ছিত করিনি। তাঁকে রাস্তায় টেনে নামাইনি। কিন্তু আজ? কী করছি আমরা? আর জি করের সেই চিকিৎসকের ছবি আজ মোবাইলে-মোবাইলে। সোশ্যাল মিডিয়াওয়ালারা অনেকেই তাঁকে চেনেন, জানেন। পুলিস সেই সব বিশেষজ্ঞ এবং ‘তদন্তকারীদের’ নোটিস পাঠাচ্ছে। এফআইআর করছে। তারপরও আমাদের হেলদোল নেই। ষড়যন্ত্র চলছে। ওই মুঠোফোনে। আমাদের অনেকের মধ্যে এখন বিপ্লবের ভূত ভর করেছে। বিদ্রোহী আমরা। সরকারের বিরোধিতায় সরব। পক্ষে বলা চলবে না। বলতে হবে বিপক্ষে। তাহলেই তুমি আমাদের দলের লোক। বাস্তবসম্মত চিন্তা-ভাবনা করলে, কিংবা বিজ্ঞানভিত্তিক কথাবার্তা বললে তুমি অন্য দলে। যদি বলো রাজ্যটাকে বাংলাদেশ করে দেওয়া যাবে না... তাহলে তুমি চটিচাটা। কারণ, এটাই এখন নতুন ইস্যু। বিরোধিতা। তাই বদলাচ্ছে আবহ... প্রতিবাদের।
আর জি করে তরুণী চিকিৎসকের নৃশংস মৃত্যু আজ পিছনের সারিতে। চুপিসারে। সেটা আমরা বুঝেও বুঝছি না। ঘটনার ২৪ ঘণ্টার মধ্যে মূল অভিযুক্ত গ্রেপ্তার হওয়া সত্ত্বেও সিবিআই তদন্তের নির্দেশ হয়েছে। কিন্তু আমরা প্রশ্ন তুলছি না যে, কতটা এগল তারা। চার্জশিট কবে হবে? এই নৃশংস, নারকীয় কাণ্ডের কুশলীর ফাঁসি কবে হবে? আর কেউ কি ছিল তার সঙ্গে? কোনও ঘটনা বা ব্যক্তিকে কি সত্যিই আড়াল করা হচ্ছে? এই প্রশ্নগুলো এখন আর শোনা যাচ্ছে না। প্রশ্নবাণে বিঁধে দেওয়া হচ্ছে না সিবিআইকে। উঠছে শুধু আওয়াজ—উই ওয়ান্ট জাস্টিস। কেমন সেই জাস্টিস? কীভাবে মিলবে? তদন্তে? নাকি বাংলাকে অচল করে দিয়ে?
আম আদমি হিসেবে দাবি করছি, ন্যায়বিচার চাই। আলবাৎ চাই। ওই মেয়েটির জন্য শুধু নয়, আগামী প্রজন্মের জন্য। আপনার-আমার ঘরের ওই কন্যাসন্তানের জন্য। তার স্বাধীনতার জন্য। নিরাপত্তার জন্য। কিন্তু আন্দোলনকারীদের মাঝে যে রাজনীতির শুঁয়োপোকা নিঃশব্দে জায়গা করে নিয়েছে! তার প্রতিবাদ হবে না কেন? ‘উই ওয়ান্ট জাস্টিস’ স্লোগানে যে প্রতিবাদ শুরু হয়েছিল, তা এখন রাজনীতির কানাগলিতে লাট খাচ্ছে। পিতা, স্বামী কিংবা দাদা হিসেবে স্বতঃস্ফূর্ত যে পা-গুলো ‘রাতের দখল’ নিতে পথে নেমেছিল, তাদের ঘিরে ফেলেছে লাল-নীল-গেরুয়ার মেলা। একটি মোমবাতি নিয়ে মিছিলে আসা কিশোরী হঠাৎ দেখতে পাচ্ছে, তার হাতে তেল চকচকে বিরাট একটি ফ্লেক্স। অজানা-অচেনা কেউ ধরিয়ে দিয়ে গিয়েছে। হাতে লেখা প্ল্যাকার্ড নিয়ে ন্যায়বিচারের আশায় বুক বেঁধে হাজির হওয়া যুবক পিছিয়ে গিয়েছে ‘প্রফেশনাল’দের সৃষ্টিতে। মাস তিনেক আগে হয়তো তাঁরা ভেবেছিলেন, আরও পাঁচ বছর অপেক্ষা করতে হবে ক্রিয়েটিভিটি দেখানোর জন্য। কিন্তু না, এসে গিয়েছে সুযোগ। আবার। তাই আমরা... এই আম জনতা একবারও ভাবিনি, ১৪ আগস্ট সন্ধ্যায় সোদপুরে হঠাৎ কেন ভেঙে দেওয়া হল পুলিসের গাড়ি? কে ভাঙল? শান্তিপূর্ণ মিছিল থেকে কারা ইট ছুড়ে রক্তাক্ত করল বিধাননগর পুলিসের কনস্টেবল শম্পা প্রামাণিককে? মাথা থেকে, চোখের কোণ ফেটে রক্ত বেরচ্ছিল তাঁর...। কী ছিল অপরাধ? তিনি তো ডিউটি করতেই এসেছিলেন। আপনি যাতে কোনওরকম অশান্তির মধ্যে পড়ে না যান, তাই পাহারায় ছিলেন তিনি। তাহলে কেন এই আক্রোশ? পুলিস বলে? ‘দলদাস’ বলে? যুগে যুগে পুলিস তো দলদাসই। রাজ্য হোক বা কেন্দ্র। এটা সিস্টেমের দোষ। মানুষের নয়। আপনার নয়। কিন্তু হ্যাঁ, শম্পারও নয়। পুলিসেরও আগে তিনি একজন মহিলা। ওই রাতটা তাই ছিল শম্পারও। তারপরও কোনও একটা শ্রেণি স্বতঃস্ফূর্ত প্রতিবাদ-আন্দোলনের সুযোগে রক্তাক্ত করেছে তাঁকে। হামলা চালিয়েছে আর জি কর হাসপাতালে। একইসঙ্গে দাগ লাগিয়েছে সাধারণ মানুষের স্বতঃস্ফূর্ত প্রতিবাদে। আর দায় চেপেছে? প্রশাসনের ঘাড়ে। পুলিসি ব্যর্থতা এগিয়ে এসেছে সামনের সারিতে। আর সিবিআইয়ের তদন্ত? আবডালে। সোশ্যাল মিডিয়ায় মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ের পদত্যাগ চেয়ে পোস্ট পড়ছে। রাস্তায় নেমে পড়েছে সিপিএম-কংগ্রেস-বিজেপি। মুখ্যমন্ত্রী নিজেও বিচার চাইছেন। দোষীদের ফাঁসির দাবিতে পথে নামছেন। তা সত্ত্বেও উঠছে স্লোগান। কিন্তু ঘোলা জলে রাজনীতির মেছুরেরা একবারও বলছে না, মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় পদত্যাগ করলেই অপরাধ বন্ধ হয়ে যাবে না। তাহলে গুজরাত, উত্তরপ্রদেশ, মহারাষ্ট্র, রাজস্থানের মুখ্যমন্ত্রীদের প্রতিদিন একবার করে পদত্যাগ করতে হতো। রাজনীতির কারবারিরা একবারও বলছেন না, এই বিপ্লবের শেষে বাংলার ভবিষ্যৎ কী? এজেন্ডা কী এই রাজনীতির? বাংলায় রাষ্ট্রপতি শাসন? উত্তর নেই। শুভবুদ্ধিসম্পন্ন মানুষকেও এই ভাবনা থেকে দূরে সরিয়ে রাখার জন্য সবকিছু করছে তারা। আর আমরাও ভেসে চলেছি স্রোতে। ভুলে যাচ্ছি, এরপরও তো নির্বাচন হবে রাজ্যে। তখন সবচেয়ে বেশি আসন জিতে ক্ষমতায় আসবে কারা? মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ের বিকল্প নিশ্চয়ই ওই স্রোতমুখী মানুষ ঠিক করে রেখেছেন। কিন্তু যদি তা না হয়? রাজনীতির তল্পিবাহকরা রাজ্যে এবং সমাজে নৈরাজ্য চাইবেই। মানুষকে বুঝে নিতে হবে তার সন্তানের ভবিষ্যৎটা। ন্যায়বিচার যেমন তাঁদের সন্তানের জন্য, একইভাবে প্রযোজ্য তাঁদের রাজ্য-জন্মভূমির জন্যও। ২০১১ সালের পর ঘেরাও-ধর্মঘটের যে রাজনীতি পশ্চিমবঙ্গ থেকে বিদায় নিয়েছিল, সেই রাজ্যই এখন অচলাবস্থার প্রাণকেন্দ্র। দেশের আনাচে-কানাচে তো বটেই, ইউরোপ আমেরিকার শহরেও মানুষ বাংলা নিয়ে ছিছিক্কার করছে। এতে কি আমাদের মাথা নিচু হয়ে যায় না? 
জাপানে শ্রমিকরা প্রতিবাদে নামলে বাড়তি কাজ করেন। কারণ, তাতে বেড়ে যাবে কোম্পানির উৎপাদন। বাজারের চাহিদার থেকে বেড়ে যাবে সরবরাহ। কোম্পানিকে হয় মাল ফিরিয়ে নিতে হবে। না হলে দাম কমাতে হবে। তাতেও সুরাহা হবে না। ফল? ব্যাপক লোকসান। মালিক বাধ্য হয় শ্রমিকদের দাবি শুনতে। আর জাপান শেখায়, আন্দোলন মানেই অচলাবস্থা নয়। আন্দোলন মানেই অবরোধ, ভাঙচুর, ঘেরাও নয়। আন্দোলন মানে কর্মবিরতি নয়। বুকে কালো ব্যাজ, কিংবা মুখে কালো কাপড় বেঁধেও আন্দোলনের অংশীদার হওয়া যায়। মুমূর্ষু রোগীদের না ফিরিয়ে তাঁদের পাশে দাঁড়িয়েও হয় আন্দোলন। নিজের মাটিকে, রাজ্যকে, দেশকে দুনিয়াদারির সামনে হেনস্তা না করেও আন্দোলন সম্ভব। আর যদি রুখে দাঁড়াতেই হয়, তাহলে কেন এই আন্দোলন, বিক্ষোভ, কর্মবিরতি ভিনেশ ফোগাট বা সাক্ষী মালিকের জন্য হয় না? বিশ্বের দরবারে ভারতের মাথা গর্বে উঁচু করে ফেরার পরও রাজধানীর রাজপথে তাঁদের টেনে-হিঁচড়ে নিয়ে যাওয়া হয়। কেন? যৌন হেনস্তার বিরুদ্ধে তাঁরাও তো নালিশ করেছিলেন! জাস্টিস ফর ভিনেশ বা সাক্ষী কি এতটাই দূরের গ্রহের? মণিপুরের সেই তরুণীকে যখন গণধর্ষণ করে নগ্ন দেহে প্যারেড করানো হয়, তখন পথে ফ্লেক্স দেখা যায় না। উন্নাও বা হাতরাসের প্রতিবাদে যখন কোনও সাংবাদিককে রাষ্ট্রদ্রোহের অপরাধে জেলবন্দি করে রাখা হয়, তখনও বাড়ে না মোমবাতির বিক্রি। নির্ভয়া, অভয়ার জন্য যদি প্রতিবাদ হয়, তাহলে আন্দোলন তো ওঁদের সম্মানের জন্যও হওয়া উচিত। এই দেশ তো ওঁদেরও। এই রাত তো ওঁদেরও। ন্যায়বিচার প্রাপ্য ওঁদেরও। এরপর কি তাহলে আশা করব আর জি কর সেই পথ দেখাবে? ভিনেশ, সাক্ষী, মণিপুর বা হাতরাসের ‘জাস্টিসে’র জন্যও নামবে দেশ? গর্জে উঠবে?
সাইকেল নিয়ে বেরিয়ে পড়তেন তিনি। ঘুরতেন একের পর এক বাড়িতে। সবাই গরিব। ওষুধ কেনা বা ফি দেওয়া তো দূরঅস্ত, পথ্যের টাকাও থাকত না অনেকের কাছে। নিজের পকেট থেকেই টাকা গুঁজে দিয়ে আসতেন হাতে। প্লেগের মড়কেও দমদম থেকে বেলগাছিয়া ছুটত তাঁর সাইকেল। চেনাজানা লোকজন বলত, সময় নষ্ট কোরো না। শুনতেন না তিনি। বন্ধুরা অবাক হতো, বিলেতফেরত ডাক্তার হয়ে কি না এই দশা! পসার হবে কীভাবে? কান দিতেন না তিনি। বুঝেছিলেন, এভাবে হবে না। গরিব মানুষের জন্য হাসপাতাল চাই। যেখানে বিনা পয়সায়, আর বিনা দ্বিধায় সমাজের এক কোণে পড়ে থাকা মানুষগুলো চিকিৎসা করতে আসতে পারবে। কিন্তু হাসপাতাল তৈরির জন্য অত টাকা ছিল না তাঁর কাছে। হাত পাতলেন তিনি। ভিক্ষা করলেন। দাঁড়িয়ে থাকলেন বড়লোকের অনুষ্ঠানবাড়ির বাইরে। তাতেও হল না। নিজের সর্বস্ব বিক্রি করে তিলে তিলে টাকা জমিয়ে কিনে ফেললেন জমি। তাতে তৈরি হল ৩০ বেডের হাসপাতাল। ঠিকানা, ১ নম্বর বেলগাছিয়া রোড। সেই ডাক্তারের নাম, রাধাগোবিন্দ কর। আর সেই হাসপাতাল? আর জি কর মেডিক্যাল কলেজ। রাধাগোবিন্দ করের নামেই। একজন রোগীও যেন ফিরে না যায়... এই ছিল তাঁর শপথ। আজকের আন্দোলন কি তাই কর্মবিরতির হতে পারে? নাকি তার উদ্দেশ্য হতে পারে বাংলার সম্মান ভূলুণ্ঠিত করার? ছায়ার মতো আর একটা নিঃশব্দ লড়াই যে তাই সমান্তরালে চলছে। স্লোগান আছে তারও।
জাস্টিস ফর বেঙ্গল। জাস্টিস ফর আর জি কর। 
24d ago
কলকাতা
রাজ্য
দেশ
বিদেশ
খেলা
বিনোদন
ব্ল্যাকবোর্ড
শরীর ও স্বাস্থ্য
সিনেমা
প্রচ্ছদ নিবন্ধ
আজকের দিনে
রাশিফল ও প্রতিকার
ভাস্কর বন্দ্যোপাধ্যায়
mesh

বহু প্রচেষ্টার পর আটকে থাকা কাজের জটিলতা মুক্তি। কৃষিজ পণ্যের ব্যবসায় বিশেষ উন্নতি। আয় বাড়বে।...

বিশদ...

এখনকার দর
ক্রয়মূল্যবিক্রয়মূল্য
ডলার৮৩.১৫ টাকা৮৪.৮৯ টাকা
পাউন্ড১০৭.৭৯ টাকা১১১.৩৩ টাকা
ইউরো৯০.৯৫ টাকা৯৪.১৩ টাকা
[ স্টেট ব্যাঙ্ক অব ইন্ডিয়া থেকে পাওয়া দর ]
*১০ লক্ষ টাকা কম লেনদেনের ক্ষেত্রে
দিন পঞ্জিকা