বিশেষ নিবন্ধ

কতটা শাস্তি হলে তবে সিস্টেম বদলানো যায়
শান্তনু দত্তগুপ্ত

নির্ভয়াকে মনে আছে আমাদের? সেই যে প্যারামেডিক্যালের ছাত্রী। বাড়ি ফিরছিল বন্ধুর সঙ্গে। দোষের মধ্যে, রাতটা একটু বেশি হয়ে গিয়েছিল। আর রাত বাড়লেই যে মানব সমাজের অন্দরে লুকিয়ে থাকা পশুগুলো খোলস ছেড়ে বেরিয়ে আসে। সেবারও এসেছিল। সীমা ছাড়িয়েছিল নৃশংসতা। মানুষ নামে উন্নত পশু আবার দেখিয়েছিল, নারী শরীর শুধুই ভোগ্য। আবার কেন? এই শক্তি প্রদর্শন যে যুগে যুগে হয়ে আসছে। বারবার। মনে নেই বানতলার অনিতা দেওয়ান? কিংবা সিঙ্গুরের তাপসী মালিক? নাকি হেতাল পারেখও বিস্মৃতির অতলে তলিয়ে গিয়েছে? বদায়ুন, উন্নাও, নয়ডা, হায়দরাবাদ... প্রতিবার আমরা কান পেতে শুনেছি, চোখ বড় বড় করে সংবাদমাধ্যমে পড়েছি, মুখ থেকে বেরিয়ে এসেছে চুক চুক শব্দ, প্রশ্ন তুলেছি নিরাপত্তাহীনতা নিয়ে। কখনও-সখনও মোমবাতি মিছিলও করেছি। তারপর? ভুলে গিয়েছি।
আসলে পাবলিক যে চরিত্রগতভাবেই বড্ড ভুলোমনা। আমরা ইস্যু খুঁজি। জীবনের চেনা ছক ভেঙে কিছুক্ষণের জন্য... কিছুদিনের জন্য বেরিয়ে আসার। হেতাল পারেখ আমাদের ‘কাপ অব টি’ নয়। আমরা খুঁজি ধনঞ্জয় চট্টোপাধ্যায়কে। কী হয়েছিল? কীভাবে হয়েছিল? বারবার জানতে চাই। ধনঞ্জয়দের ফাঁসিতে ঝুলতে দেখে অসীম আনন্দ পেয়ে থাকি। কিন্তু একবারও তার গোড়ায় যাই না। ভেবে দেখি না, কেন একজন ধনঞ্জয় তৈরি হয়? ‘তৈরি হয়’ কথাটাই এখানে ভীষণ লাগসই। কারণ ধর্ষকের, খুনির জন্ম হয় না। সমাজই তাদের তৈরি করে। এর দায় অশিক্ষার, অকারণ গোপনীয়তার। আমরা কি আমাদের সন্তানদের মানব শরীর নিয়ে সঠিক শিক্ষা দিয়ে থাকি? কোনও স্কুলে কি শিক্ষকরা তাঁদের পড়ুয়াদের খোলা মনে বুঝিয়ে থাকে জীবনচক্রের খুঁটিনাটি। না। এই শিক্ষা আমাদের সমাজে নিষিদ্ধ। তাই কেউ উপযাচক হয়ে এগিয়ে এলেও আশপাশ থেকে ভেসে আসে হাসির শব্দ। কেউ ভুরু কুঁচকায়। কেউ নাক সিঁটকে সরে যায়। তখন তারা ভুলে যায়, নিষিদ্ধের প্রতিই মানুষের স্বাভাবিক আকর্ষণ। একদিন তাদের মধ্যে কারও সন্তানই ধর্ষণের দায়ে দাঁড়ায় আইনের কাঠগড়ায়। আইন তাকে শাস্তি দেয়। কিন্তু তাতে কি অপরাধের প্রবণতা মানব সমাজ থেকে মুছে যায়? না... যায় না। কারণ, আইন সমাজকে বাঁধতে পারে, নিয়ন্ত্রণ করতে পারে। কিন্তু সংশোধন করতে পারে না। তার জন্য প্রয়োজন সচেতনতা। আমরা ছেলেমেয়েদের ফরাসি সভ্যতা পড়াব, পিথাগোরাসের থিওরেম মুখস্ত করাব, কানাডায় কীভাবে গাছ কাটা হয়... সেটাও শেখাব। অথচ, রাস্তায় কেউ বিপদে পড়লে যে এগিয়ে যেতে হয়, সেটা বোঝানোর প্রয়োজন বোধ করব না। নারী মানেই যে ভোগ্য নয়, সেই শিক্ষা দেব না। একবারও বলব না... তুমিও এমন এক জঠর থেকেই বেরিয়ে এসে পৃথিবীর আলো দেখেছ। একে সম্মান করতে শেখো। আর তাই কোনও নির্ভয়া, অনিতা দেওয়ান বা আজকের আর জি করে নৃশংস মৃত্যুর শিকার ওই মেয়েটির দায় আমরাও ঝেড়ে ফেলতে পারি না। পারব না। 
শহর-শহরতলির মোড়ে মোড়ে আজ আমরা দেখছি সাদা অ্যাপ্রন গায়ে ছেলেমেয়েদের। তাদের দাবি অনেক। একটাও অন্যায় নয়। অসঙ্গত নয়। কিন্তু তারা কি দেখছে রাজ্যের মেডিক্যাল কলেজ-হাসপাতালগুলোর বাইরে দাঁড়িয়ে থাকা শুকনো মুখ? কেউ অসুস্থ ছোট্ট সন্তানকে কোলে নিয়ে দাঁড়িয়ে আছেন। কেউ শুয়ে আছেন অ্যাম্বুলেন্সে... বুক আঁকড়ে। তাঁরা জানতে পারছেন, চিকিৎসা হবে না। কারণ, আন্দোলন করছেন ডাক্তাররা। যাঁদের ঈশ্বরের পরের আসনেই আম জনতা বসিয়ে রাখে... যাঁদের মুখের দিকে অপার বিশ্বাসে তাকিয়ে থাকে তারা... সেই ডাক্তাররাই তালা দিয়েছেন হাসপাতালে। ইমার্জেন্সিতে। প্ল্যাকার্ড হাতে তাঁরা দাঁড়িয়ে পড়েছেন রাস্তার মোড়ে। ন্যায়বিচার চাইছেন। তাঁদের নিহত সহকর্মীর জন্য। কী সেই ন্যায়? কেমন সেই বিচার? ফাঁসি? আরও একটা ধনঞ্জয় চট্টোপাধ্যায়। প্রশাসন থেকে বিদ্বজ্জন—সবাই ফাঁসির কথাই বলছে। কেউ বলছেন দৃষ্টান্তমূলক সাজার কথা। কী সেই সাজা? কেমন হবে সেই দৃষ্টান্ত। পারেন কেউ দিশা দেখাতে? এমন কোন সাজা সমাজটাকে বদলে দেবে? সচেতন করবে মানুষকে? বদল আনবে শিক্ষায়? কেউ প্রস্তাব করছেন না। করবেনও না। তাঁরা চাইবেন নিরাপত্তা। সরকার তাঁদের নিরাপত্তা দিতে পারছে না। নিশ্চিত, নিরাপত্তা ব্যবস্থা অবশ্যই আরও নিশ্ছিদ্র হওয়া উচিত। আরও সিসি ক্যামেরা, আরও বেশি পুলিসকর্মী। একটু ভেবে দেখবেন, এতে নিরাপত্তার মোড়কটা মিলবে। অন্তর শুদ্ধ হবে না। শাস্তি হবে অপরাধীর। অপরাধের নয়। বরং এই বিক্ষোভ, আন্দোলন, কর্মবিরতিতে সাজা হবে লক্ষ লক্ষ গরিব মানুষের। কেউ ঘরদোর বেচে বেসরকারি হাসপাতালে পরিজনকে নিয়ে যাবেন। কেউ ওই হাসপাতাল চত্বরেই কাটিয়ে ফেলবেন জীবনের শেষ কয়েকটা মুহূর্ত। সেই মৃত্যুর জন্য কোনও এফআইআর হবে না। ময়নাতদন্ত হবে না। রাজনীতির কারবারিরা তাঁদের বাড়ি গিয়ে আশ্বাস বা ক্ষতিপূরণও পৌঁছে দেবেন না। তখন সেই দায় কে নেবে? নিতে হবে আমাদের। এই লোকদেখানো, দৃশ্যত পরিপাটি, অন্তঃসারশূন্য মানব সমাজকে।
তাই আন্দোলন করতে হবে, কিন্তু সিস্টেমে বদল আনার জন্য। সমাজ ব্যবস্থায় আমূল পরিবর্তনের জন্য। কারণ, সরকার কড়া আইন করবে। নতুন থানা বা ফাঁড়ি হবে। বদলে যাবে পুলিস কর্তা। ট্রান্সফার হবে আধিকারিকদের। কিন্তু তাতে সিস্টেম বদলাবে না। আমরা বদলাব না। সিস্টেমের ফাঁক আজ ফাটল হয়ে গিয়েছে। বন্ধ করতে হবে তাকে। বিক্ষোভকারীদের অভিযোগ, আড়াল করা হচ্ছে কাউকে। পোস্ট মর্টেম রিপোর্ট যা বলছে, তাতে আর জি করের নৃশংসতা একজনের কাজ কি না, প্রশ্ন উঠছে সেটা নিয়েই। তাই ঘটনার ২৪ ঘণ্টার মধ্যে অভিযুক্তের গ্রেপ্তারি চলে যাচ্ছে পিছনের সারিতে। প্রশাসনের সাফল্য নয়, আড়ালের ব্যর্থতার বিষ তীব্রতর হয়ে উঠছে। ডাক্তাররা বলছেন, সত্যি সামনে আনতে হবে। কিন্তু সত্যিটা কী জানেন? আপনাদের-আমাদের মধ্যেই আরও কোনও সঞ্জয় রায় লুকিয়ে আছেন। তিনি ধরা পড়েননি। ক্যামেরার ছবি কি মুছে গিয়েছে? তিনি কি প্রভাব খাটিয়ে অন্তরালে চলে গিয়েছেন? সেটা হলেও দায় আমাদের। এই সমাজের দায়। আমরা তাদের এমন শিক্ষাই দিয়েছি। আমরাই তাদের প্রশ্রয় দিয়েছি ক্ষমতার কলকাঠি কাজে লাগিয়ে নিজেদের জামাকাপড় দাগমুক্ত রাখার। নাম জেনেছি। কিন্তু বলিনি। প্রথম যেদিন তার মানসিকতার আঁচ পেয়েছি, শুধরে দিইনি। হয়তো ভয়ে। হয়তো পরের ছেলে পরমানন্দ ভেবে। আর তাই তৈরি হয়েছে সঞ্জয় রায়। তৈরি হবে সঞ্জয় রায়। আমাদের ঘরে ঘরে। 
সুনীতা কৃষ্ণানের নাম কি আমরা শুনেছি? ১২ বছর বয়সে ধর্ষণের শিকার হয়েছিলেন সুনীতা। বোঝার বয়স তেমন ছিল না। কিন্তু যন্ত্রণা চিরে দিয়েছিল তাঁর শরীরকে। মনকে। ঘেন্না ধরে গিয়েছিল আশপাশের লোকজন, সমাজের উপর। কিন্তু সেই রাগকেই জেদে বদলে দিয়েছিলেন সুনীতা। পড়াশোনা করেছেন, বড় হয়েছেন, আর তারপর নিজেই খুলেছেন একটি এনজিও। তারা কাজ করবে মানব পাচারের বিরুদ্ধে। সুনীতা বুঝেছিলেন, যে সিস্টেম তাঁকে খাদের কিনারে দাঁড় করিয়েছিল, বদলাতে হবে তাকেই। আজ তাঁর সংগঠন পুলিস-প্রশাসন এবং এজেন্সির সঙ্গে মিলে নারী পাচার, মানব পাচার বন্ধের জন্য দিনরাত খেটে চলেছে। সুনীতার লক্ষ্য, সমাজকে সচেতন করতে হবে। সমস্যার গোড়ায় আঘাত হানতে হবে। তবেই ভেন্টিলেশনে চলে যাওয়া সমাজ সাড়া দেবে। 
নিলুকেও আমরা খুব একটা চিনি না। বাবা-মা মারা যাওয়ার পর থেকে মন্দিরেই থাকত সে। ১৫ বছর বয়সে ধর্ষণ করা হয় তাকে। তার থেকে গর্ভবতী। তাও মন্দির ছেড়ে যায়নি সে। ছোট্ট কন্যাসন্তানকে নিয়ে থাকার বিনিময়ে সবার রান্না করে দিত। তখনই এসেছিল প্রস্তাব। এক ‘ভদ্রলোক’ বলেছিল, পুনেতে তার বোনের বাড়ি। ২৪ ঘণ্টার লোক দরকার। নিলু কাজ করবে কি না। মেয়ের ভবিষ্যতের কথা ভেবে রাজি হয়ে গিয়েছিল নিলু। কিন্তু আবিষ্কার করল, যেখানে তাকে আনা হয়েছে, সেটা বোনের বাড়ি নয়। নিষিদ্ধপল্লি। প্রতিরোধ ভেঙে গেল কয়েক মাসে... মদ, মাদক, আর মারের চোটে। মেনে নিয়েছিল নিলু। টিবি রোগ ধরল। তারপর এইডস। মেয়ের মুখের দিকে তাকিয়ে মেনে নিল সেটাও। বারবার ভাবল, গলায় দড়ি দেওয়ার কথা। কিন্তু হতাশার অন্ধকার ঝেড়ে ফিরে এল জীবনে। নিলু সেদিন বুঝে নিয়েছিল, মেয়েটাকে বড় করতে হবে। শিক্ষা দিতে হবে। সঠিক শিক্ষা। যেন এই সমাজে আর একটা নিলু তৈরি না হয়। যেন কোনও মেয়ে নিলু হতে বাধ্য না হয়।
আর জি করের নৃশংসতার শেষটাও তেমনই শিক্ষায় কেন হতে পারে না? কেন বদলাতে পারে না সমাজ? সিস্টেম? আমরা অলস নই। ভীতুও না। অপেক্ষা শুধু স্থবিরতা ঝেড়ে উঠে দাঁড়ানোর। নতুন কোনও সঞ্জয় রায় আমরা চাই না। আমরা দেখতে চাই না আর জি করের সেমিনার রুমে নিথর পড়ে থাকা কোনও দেহও। এই বার্তাই কি মেয়েটি দিয়ে গেল না? চোখ খোলার সময় এসেছে। সমাজের। আন্দোলনকারীদের। আমাদের মধ্যে না থেকেও শিক্ষা দিয়ে গিয়েছে সমাজকে... ‘অভয়া’।
1Month ago
কলকাতা
রাজ্য
দেশ
বিদেশ
খেলা
বিনোদন
ব্ল্যাকবোর্ড
শরীর ও স্বাস্থ্য
সিনেমা
প্রচ্ছদ নিবন্ধ
আজকের দিনে
রাশিফল ও প্রতিকার
ভাস্কর বন্দ্যোপাধ্যায়
mesh

বহু প্রচেষ্টার পর আটকে থাকা কাজের জটিলতা মুক্তি। কৃষিজ পণ্যের ব্যবসায় বিশেষ উন্নতি। আয় বাড়বে।...

বিশদ...

এখনকার দর
ক্রয়মূল্যবিক্রয়মূল্য
ডলার৮৩.১৫ টাকা৮৪.৮৯ টাকা
পাউন্ড১০৭.৭৯ টাকা১১১.৩৩ টাকা
ইউরো৯০.৯৫ টাকা৯৪.১৩ টাকা
[ স্টেট ব্যাঙ্ক অব ইন্ডিয়া থেকে পাওয়া দর ]
*১০ লক্ষ টাকা কম লেনদেনের ক্ষেত্রে
দিন পঞ্জিকা