নজিরবিহীন একটি নাগরিক আন্দোলনকে সম্পূর্ণ বিপথে ঠেলে দেওয়ার চক্রান্ত কারা করছে? কারা নাগরিক আন্দোলনের বিস্ফোরক এবং সৎ আবেগকে কাজে লাগিয়ে সেই আন্দোলনের মূল দাবিকে সরিয়ে দিকভ্রষ্ট করার দিকে গোপন পরিকল্পনা করছে? গোটা ভারত শেষ কবে দেখেছে এরকম এক জনরোষ? সরকার থেকে সুপ্রিম কোর্ট। গোটা রাষ্ট্রযন্ত্রকে নাড়িয়ে দেওয়া এই নিতান্ত সাধারণ মানুষের আন্দোলনের কৃতিত্ব হাইজ্যাক করার কৌশলী খেলা কারা খেলছে? আমজনতাকে নিজেদের স্বার্থসিদ্ধির দাবাখেলার বোড়ে করে দেওয়ার চেষ্টা হচ্ছে না তো? এই প্রশ্নগুলি কেন মনে আসছে? কারণ পৃথক পৃথক বিক্ষোভ ও আন্দোলনের গতিপ্রকৃতি, স্লোগান, কর্মসূচি, রূপরেখা এবং বক্তব্য। ভয় হচ্ছে। আমাদের নিজেদের অজ্ঞতা এবং অপরিণামদর্শী আচরণেই আমরা বিপথগামী হয়ে যাচ্ছি না তো? অন্যরা সুযোগ নিয়ে নিচ্ছে?
দফা এক দাবি এক/মমতার পদত্যাগ। এই স্লোগান কারা দিচ্ছে? যদি তর্কের খাতিরে ধরে নেওয়া যায় যে ‘দফা এক এবং দাবি এক’। তাহলে তো সেই ‘দফা এক এবং দাবি এক’ হওয়ার কথা একটিই। দোষীদের চরমতম সাজা চাই। আমাদের যদি কোনও এক সর্বশক্তিমান মহাকাল কাল্পনিক শর্ত দেয় যে, একটিই দাবি পূরণ করব। একটিই দফা! বলো তোমরা কোনটা চাও? আমরা আমজনতা কী বলব? এক ও একমাত্র দফা এবং দাবি সর্বোচ্চ সাজা। তাই তো? তাহলে এক ও একমাত্র দাবি মমতার পদত্যাগ কারা করছে? তাদের লক্ষ্য কী? মমতার পদত্যাগ? চাইতেই পারেন। গণতন্ত্রে যে কোনও দাবিই চাওয়া যায়। সঙ্গত কী অসঙ্গত সেটা রাজনৈতিক ডিবেট। পক্ষে ও বিপক্ষে তর্ক চলুক। এই দাবিটি দ্বিতীয় ও তৃতীয় স্থানে নয় কেন? প্রথম দাবি তো ‘সাজা চাই’ হওয়া উচিত!
দফা দুই অথবা তিন, দাবি দুই অথবা তিন নয়। এখানে বলা হচ্ছে ‘দফা এক দাবি এক’! মমতার পদত্যাগ! তার মানে আর কোনও দফা ও দাবি নেই? দোষীর বিচার ও শাস্তি চেয়ে কোনও দফা ও দাবির স্থানই নেই? এটা হতে পারে? নাগরিক আন্দোলনের মূল দাবি তো এটা ছিল না! হঠাৎ এটা প্রথম করে দিয়ে কারা জলঘোলা করে দিচ্ছে?
নাগরিক আন্দোলনকে এভাবে বদনাম করার চেষ্টার পিছনে কী সূক্ষ্ম প্ল্যান আছে আপনাদের? বাংলার এই নাগরিক আন্দোলন বিশ্ব জেনে গিয়েছে। অগাধ শক্তি অর্জন করেছে। এতদিন ধরে ব্যর্থ রাজনীতির কারবারিরা কি নাগরিকদের নিজেদের হাতে তৈরি একটি ইস্যুকে তাই ছিনিয়ে নিচ্ছে? নাগরিক আন্দোলনকে করতে চাইছে দুর্বল?
একটি নৃশংস ধর্ষণ এবং হত্যাকাণ্ডের বিচার চাওয়া নজিরবিহীন আন্দোলনে নাগরিকদের মাথায় আগুন জ্বলছে। কেন? কারণ চোখ বন্ধ করলেই মনে হচ্ছে, সেমিনার রুমে যদি আমার মেয়ে থাকত? সেই আগুন নিভবে না। দুঃস্বপ্নের মতো ফিরে আসবে। কী হচ্ছে হতভাগ্য মা-বাবার অন্তরে! কোনওদিন পূর্ণভাবে স্পর্শই করতে পারব না আমরা। তবু তাদের সম্মিলিতভাবে বলা যে, আমরা আছি। পাশে আছি। যতদিন না বিচার হচ্ছে। হয়তো আমাদের মনের আগুন কিছুটা অন্তত শান্ত হবে যদি যুদ্ধকালীন তৎপরতায় দোষী অথবা দোষীদের চিহ্নিতকরণ, চার্জশিট, বিচার এবং সর্বোচ্চ শাস্তি হয়। আর ঘটনার আগে অথবা পরের গাফিলতি, ব্যর্থতা, ইচ্ছাকৃত ধামাচাপা দেওয়ার প্রয়াসের পূর্ণাঙ্গ তদন্ত চাই। জানতে চাই, কারা আর জি করে ভাঙচুর করল? কেন তাদের প্রতিরোধ করা গেল না? চাই, সেই অভিযোগগুলির কঠোরতম ব্যবস্থা। নিছক আর জি কর নয়, শহর এবং রাজ্যের সর্বত্র নিরাপত্তা নিশ্চিত করতে হবে। সব ঠিক।
কিন্তু আমাদের সর্বাধিক প্রায়োরিটি কী? এখনই চিহ্নিতকরণ, বিচার ও শাস্তি! সেটা কারা দিতে পাবে? সিবিআই। আমরা সিবিআইয়ের উপর ঠিক একইরকম চাপ দিতে পারছি? নাকি আন্দোলনের অভিমুখ অন্যদিকে সরে যাচ্ছে?
প্রথমত ফেক নিউজ। পোস্ট ট্রুথ অথবা ফেক নিউজ ছড়ানোর ক্ষতিকর দিক কী? যাদের বিরুদ্ধে এই ফেক নিউজ ছড়ানো হয়, তারা কিছুটা নিশ্চিন্ত হয়ে যায়। তারা ভাবে, যাক, তাহলে খুব বেশি সত্যি অভিযোগ এদের হাতে নেই? সেই কারণেই ফেক নিউজের আশ্রয় নিতে হচ্ছে? নাগরিক আন্দোলনকারীদের ভাবতে হবে যে, এই জঘন্যতম ঘটনায় ফেক নিউজ ছড়ানোর দরকার পড়ল কেন? আমাদের আরও রাগিয়ে দেওয়ার জন্য? আমাদের আরও প্ররোচিত করার জন্য? আমাদের আরও বেশি আগ্রাসী হয়ে ঝাঁপিয়ে পড়ার বার্তা দিতে? কিন্তু সেসবের দরকার কী? এরকম এক শিউরে ওঠার মতো অপরাধই কি যথেষ্ট নয় বিক্ষোভে ফেটে পড়ার জন্য? তাহলে মিথ্যা প্রচার করে, শেয়ার করে, ফরওয়ার্ড করে নিজেদের ক্ষোভকেই তো হাল্কা করে দেওয়া হল? যাদের বিরুদ্ধে রাগ, তাদের হাতেই অস্ত্র তুলে দেওয়া হল কেন যে, নাগরিকরা মিথ্যা ছড়াচ্ছে?
কারা ছড়াল ফেক নিউজ? কারা ওই নির্যাতিতার ছবি, নাম, পরিচয় সমাজমাধ্যমে অবিরত ছড়িয়ে দিল? শিক্ষিত সচেতন হিসেবে নিজেদের দাবিও করব, আবার এই বেসিক সেন্সও থাকবে না, এটা তো বিশ্বাস্য নয়! সুপ্রিম কোর্ট তাদের এই আচরণে চরম ক্ষোভ প্রকাশ করল। এতে বাংলার নাগরিকদের গায়েই তো অসম্মানের আঁচ লাগছে। কারা পা দিল ওই ফাঁদে? কে পেতেছে ফাঁদ? শিক্ষিত অশিক্ষিত এক পংক্তির হয়ে গেল কেন ফেক নিউজ ছড়ানোয়?
এত বছর সোশ্যাল মিডিয়া দেখার পরও এখনও কি সেই বুদ্ধিবৃত্তির ম্যাচিওরিটি আসেনি আমাদের যে, রাতদিন মোবাইল করার পরও শিখব না, যা পাচ্ছি সেটাই সত্যি নয়? ভাবব না যে, যা মোবাইলে দেখছি সেটাই প্রকৃত তথ্য নয়? একটু ক্রস চেক করে নিই। একটু ফ্যাক্ট চেক করি! এসব ইচ্ছাই করে না?
এখনও কি নিজের আদর্শ ও অভিমতের সঙ্গে যা সামঞ্জস্যপূর্ণ, যা শেয়ার করতে ভালো লাগছে, তা বিশ্বাস করতে ইচ্ছা করছে, সেটাকেই ধ্রুবসত্য ভেবে ধরে নেওয়ার শিশুসুলভ মনোবৃত্তি থেকে বেরিয়ে আসার পরিণতমনস্কতা আসেনি আমাদের অনেকের? আমরা কেন ভাবছি যে, আমরা সবাই পোস্টমর্টেম জানি, ভিসেরা জানি, অটোপসি জানি, ন্যায় সংহিতার সেকশন ৬৬ জানি। চার্জশিট জানি। কোর্ট হিয়ারিং জানি। ম্যাজিস্ট্রেটের সামনে ১৬৪ ধারা জানি। এসব নাই বা জানলাম। আমরা তো সামান্য লোক। এত জানাজানির দরকার কী? আমি কত জানি সেসব অন্যদের এত বোঝানোরই বা তাড়না কেন? আমাদের তো একটাই চাহিদা, বিচার চাই। সোজা চাওয়া, শাস্তি চাই। একরোখা দাবি, নিরাপত্তা চাই।
ধর্ষণের সময় অথবা পরে কোনও নৃশংসতম শারীরিক অত্যাচার যদি নাও হতো, তাহলেও এক বিন্দুও কমে না অপরাধের মাত্রা। সারারাত ডিউটি করার পর একজন নারী তাঁর কর্মস্থলের সেমিনার রুমকে সবথেকে নিরাপদ ভেবেই বিশ্রাম নিতে এসেছিল। সেখানেই প্রবেশ করে তাঁকে ধর্ষণ, অসহনীয় অত্যাচার এবং হত্যা করার স্পর্ধা, সাহস এবং বিকৃতমনস্কতার ঘটনা এমনিতেই চরমতম অপরাধ এবং ঘৃণ্য। এটুকুই যথেষ্ট আমাদের মস্তিষ্কে অগ্নিক্ষরণের জন্য। শাসককে চাপ দেওয়ার জন্য। পুলিশের কাছে কৈফিয়ত চাওয়ার জন্য। দোষীদের গ্রেপ্তার ও শাস্তি চাওয়ার জন্য। এর সঙ্গে একটিও ফেক নিউজের দরকার পড়ে না। তাহলে দরকার পড়ল কেন? কারা নাগরিকদের আবেগে কয়েক বিন্দু মিথ্যা মিশিয়ে দিল ফেক নিউজের বিষে? কারা তারা?
শাসককে কাঠগড়ায় দাঁড় করানো হোক যত
ইচ্ছা। কিন্তু এখন তো সিবিআই তদন্ত করছে!
তাহলে সিবিআইয়ের উপর সমানভাবে চাপ দেওয়া দরকার নেই? যদি তাদের চাপ না দেওয়া হয়, তাহলে কিন্তু নাগরিকদের নিজস্ব ‘দফা এক দাবি এক’—অর্থাৎ দোষীদের বিচার ও চরমতম শাস্তির প্রতি সুবিচার করা হবে না।
সিবিআইয়ের কাছে, সুপ্রিম কোর্টের কাছে করজোড়ে অনুরোধ, আমাদের মেয়ের উপর এই নির্মম ঘটনা ঘটেছে। ওসব সন্দীপ ঘোষ, রাজ্য সরকার, তৃণমূল, যাদের বিরুদ্ধে যা ইচ্ছা হয় তদন্ত করুন। যাকে পাবেন প্রেপ্তার করুন। কিন্তু সবার আগে বলুন, সেদিন ভোররাতে যদি একাধিক অপরাধী থাকে, তাদের নাম পরিচয় কী কী? কবে তদন্ত শেষ হবে? কবে হবে বিচার? কবে দেখব শাস্তি!
আন্দোলনের দুর্বলতা কাকে বলে? যখন আন্দোলনকে দেখে সন্দেহ হবে এটা আরবান মিডল এবং আপার মিডল ক্লাসের আন্দোলন নয় তো? মাঝেমধ্যেই বিক্ষোভ মিছিলকে তকমা দেওয়া হচ্ছে কেন, ডাক্তারদের মিছিল, আইনজীবীদের মিছিল, সঙ্গীতশিল্পীদের মিছিল, নাট্যকারদের মিছিল, টলিউডের মিছিল, ছাত্রদের মিছিল...? পৃথকভাবে পেশাগত মিছিলের এই তালিকা তো আপার
মিডল ক্লাসের বার্তাবাহক? কৃষকদের মিছিল, তন্তুবায়দের মিছিল, আয়া সংগঠনের মিছিল, মৎস্যজীবীদের মিছিল, শ্রমিকদের মিছিল...এরকম পেশাগত তকমা কোনও মিছিলের বিবরণ পাওয়া গেল না কেন? অথচ তারা তো সবাই বিচ্ছিন্নভাবে আছে এই আন্দোলনে? পুরোভাগে আনা হচ্ছে না কেন? মানুষের মিছিল হোক! আইডেন্টিফাই করতে হচ্ছে কেন কারা কোন পেশার!
যে গান মিছিলে মিছিলে গাওয়া হচ্ছে, যে বাদ্যযন্ত্র বাজানো হচ্ছে, যে ছড়ার মতো অন্ত্যমিল থাকা স্লোগানের জন্ম হচ্ছে, চে গ্যেভারার যে টি শার্ট পরা হচ্ছে, এসবের মধ্যে কেন বারংবার তীব্রভাবে ফুটে বেরচ্ছে আধুনিক শহুরে আপার ক্লাসের সাংস্কৃতিক প্রতিধ্বনি? হোক কলরবের সঙ্গে পার্থক্য থাকবে না এই আন্দোলনের চেহারায়? সামাজিক প্রান্তিক, সাব অলটার্নরাও তো সমানভাবে আছে এই আন্দোলনের সমর্থনে। তাদের মন রিলেট করতে পারবে এরকম উচ্চশ্রেণির সাংস্কৃতিক, সামাজিক উচ্চারণে? কলকাতার এই অন্যায়ের কঠোরতম প্রতিবাদ ও বিক্ষোভে ফেটে পড়েছে জেলা, মফস্সল ও গ্রামবাংলাও! গোটা রাজ্য গর্জে উঠছে। তাহলে সেই গ্রামবাংলা থেকে যারা শিশু, বাবা, মা, স্ত্রী এবং ভাইবোনকে নিয়ে আসছে আকুল হয়ে কলকাতার হাসপাতালে, তাদের দিনের পর দিন ফিরিয়ে দিচ্ছে কেন কলকাতা?
আমরা বেড়াচাঁপায় চাষ করি, আমরা বেগমপুরে তাঁত চালাই, আমরা কাকদ্বীপ মাছ ধরি, আমরা পাঁশকুড়ায় ফুল তুলি, আমরা ধুলিয়ানে বিড়ি বাঁধি, আমরা বাসন্তীর মৃৎশিল্পী...। আমরা কী দোষ করেছি? আমাদের অপারেশন হল না। আমাদের সন্তানের মৃত্যু হল। আমরা টিউমার নিয়ে ফিরে গেলাম। আমরা ইনজেকশন পেলাম না। গরিবের চিকিৎসা না দেওয়ার সমর্থন করছে কেন নাগরিকদের একাংশ? একে কী বলে? আরবান অটোক্রেসি?
আমরা গ্রাম মফস্সল। আমরা কলকাতার যে কোনও দাবি ও দুঃখকে নিজেদের দাবি ও দুঃখ
ভেবে পাশে দাঁড়াই। সাধ্যমতো। এবার থেকে আমাদের দুঃখ ও দাবির পাশেও কলকাতা থাকবে তো? আমাদের পুরুলিয়া অথবা আমাদের মাথাভাঙায় কোনও অন্যায় হলে কলকাতা তাদের পাড়ায় মিছিল করবে তো? যদি না করে, তাহলে কিন্তু এই আশ্চর্য এক ঐতিহাসিক নাগরিক আন্দোলন ভবিষ্যৎকে আলো দেখাতে ব্যর্থ হবে।
একটি আন্দোলন অনেক কিছু শিক্ষা দিচ্ছে আমাদের। আমাদের শক্তিকে দেখিয়ে দিল।
আমাদের দুর্বলতাকে চিহ্নিত করল। আমাদের ঐক্যকে সংঘবদ্ধ করল। আমাদের বিভাজনকে চিহ্নিত করল। লড়াই সমাপ্ত হয়নি। শুরু হয়েছে। তাই সুযোগসন্ধানীদের এখন ব্রাত্য করার সময়। ছিদ্রান্বেষীদের বিচ্ছিন্ন করার পালা।
দফা এক। দাবি এক। শাস্তি। শাস্তি। শাস্তি!