অতিগভীর নিম্নচাপের প্রভাবে প্রবল বৃষ্টি হয়েছে টানা কয়েকদিন। তার সঙ্গে যুক্ত হয়েছে ডিভিসির তরফে আচমকা ছাড়া জল। সোমবার ও মঙ্গলবার দু’দিনে ডিভিসি মোট আড়াই লক্ষ কিউসেক জল ছেড়ে দিয়েছে। এই দুই উপর্যুপরি কারণে দক্ষিণবঙ্গের নয়টি জেলার বিস্তীর্ণ অংশে বন্যা পরিস্থিতির অবনতি হয়েছে। সব মিলিয়ে পুজোর মুখে বানভাসি দক্ষিণবঙ্গ। শোনা যাচ্ছে ১৯৭৮ এবং ২০০০ সালের দুর্যোগের পদধ্বনি। দুর্যোগের কারণে ইতিমধ্যে একাধিক মৃত্যুর খবরও পাওয়া গিয়েছে। একই সঙ্গে মিলেছে ব্যাপক মাত্রায় বৈষয়িক ক্ষয়ক্ষতিরও দুঃসংবাদ। অতিবৃষ্টির ফলে বিঘার পর বিঘা কৃষিজমি জলে তলিয়ে গিয়েছে। এর ফলে প্রচণ্ড ক্ষতি হয়েছে আমন ধান, লঙ্কা, উচ্ছে, বেগুন, পটোল, ওল-সহ বহু প্রকার সব্জি এবং কলা, ফুল প্রভৃতি চাষের। সাধারণভাবে বিশ্বকর্মা পুজো দিয়েই বঙ্গদেশে শারদোৎসবের ঢাকে কাঠি পড়ে। গতকাল মঙ্গলবার রাজ্যজুড়ে বিশ্বকর্মা পুজো অনুষ্ঠিত হয়। অর্থাৎ বন্যার ক্ষয়ক্ষতিকে সঙ্গী করেই শুরু হল এবার শারদোৎসবে পদার্পণ। ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে প্রচুর বাড়িঘর এবং রাস্তাঘাটের। তলিয়ে গিয়েছে বহু গ্রাম এবং কিছু শহরের নিচু এলাকা। একদিকে ঘরে জল ঢুকে গিয়েছে, অন্যদিকে সৃষ্টি হয়েছে পানীয় জলের সঙ্কট। বহু বাড়িতে রান্না করার পরিস্থিতি নেই। জল ঢুকে গিয়েছে কিছু স্কুল বাড়িতেও। ফলে হাজার হাজার দুর্গত মানুষকে নিরাপদ স্থানে সরিয়ে নিয়ে যাওয়াও কঠিন হয়ে পড়েছে কিছু এলাকায়।
সোমবার মুখ্যমন্ত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় অবশ্য সকলকে আশ্বস্ত করেছেন। এই পরিস্থিতি মোকাবিলার জন্য তাঁর প্রশাসন সবরকম ব্যবস্থা নিচ্ছে। সরকার দুর্গতদেরই পাশে রয়েছে। জেলা প্রশাসনগুলিকে যাবতীয় ব্যবস্থা গ্রহণের নির্দেশ দিয়েছে নবান্ন। বন্যা পরিস্থিতি সবচেয়ে উদ্বেগজনক দুই মেদিনীপুর, ঝাড়গ্রাম, পশ্চিম বর্ধমান, বীরভূম, মুর্শিদাবাদ, বাঁকুড়া ও হুগলি জেলায়। ওই জেলাগুলিতে ব্যাপক জল জমতে শুরু করেছে শনিবার থেকেই, মূলত টানা ভারী বৃষ্টির কারণে। সোমবার সন্ধ্যার পর নিম্নচাপটি ঝাড়খণ্ডের উপর সরে গেলেও বাংলার পশ্চিমাঞ্চলের জেলাগুলিতে ওইসময় দিনভর মারাত্মক বৃষ্টি হয়। অজয়, দামোদর, কংসাবতী, কেলেঘাই, দ্বারকেশ্বরী, গন্ধেশ্বরী, দ্বারকা ও কুয়ো নদী ফুঁসতে থাকে। এর মধ্যেই আবহাওয়া দপ্তর জানিয়ে দেয় যে, ঝাড়খণ্ডের দামোদর অববাহিকা ও সংলগ্ন অঞ্চলে ভারী বৃষ্টিপাত চলবে আরও কিছু সময়। দক্ষিণবঙ্গের জন্য উদ্বেগ বাড়িয়েছে এই পূর্বাভাসই। কারণ, ডিভিসির অন্তর্ভুক্ত মাইথন এবং পাঞ্চেত বাঁধ থেকে জল ছাড়ার হার ক্রমে বাড়ানো হয়েছে। সেই জল দুর্গাপুর ব্যারেজে এসে জমা হওয়ায় সোম ও মঙ্গলবার বিপুল পরিমাণে জল ছাড়া হয়েছে। ঝাড়খণ্ডে দামোদর অববাহিকায় আরও বেশি বৃষ্টি হলে ডিভিসি জল ছাড়ার পরিমাণ বাড়াতে বাধ্য হবে বলেই আশঙ্কা প্রশাসনের। সেক্ষেত্রে ঝাড়গ্রাম, বাঁকুড়া, পূর্ব বর্ধমান, হুগলি ও হাওড়া জেলার নিম্ন দামোদর অববাহিকা এলাকা আরও প্লাবিত হওয়ার আশঙ্কা বাড়বে। এছাড়া, কংসাবতী নদীর উপর মুকুটমণিপুর জলাধার থেকেও বিপজ্জনক হারে জল ছাড়া হচ্ছে। সেচদপ্তর বলছে, সোমবারই মাইথন, পাঞ্চেত, মুকুটমণিপুর, ম্যাসাঞ্জোর, তেনুঘাট ও চান্ডিল বাঁধের জলস্তর সর্বোচ্চ ধারণ ক্ষমতার কাছাকাছি চলে এসেছে। এদিকে, দুর্যোগের ফলে পশ্চিম বর্ধমানের রানিগঞ্জে দেওয়াল চাপা পড়ে এক ব্যক্তির মৃত্যু হয়েছে। দেওয়াল চাপা পড়ে মৃত্যু হয়েছে বীরভূমেও। এক সেখানে মারা গিয়েছেন এক মহিলা। এই জেলাতেই দেড়শোর বেশি মাটির বাড়ি পুরোপুরি ভেঙে গিয়েছে। সতীপীঠ কঙ্কালীতলার মন্দির প্রাঙ্গণ এক কোমর জলের নীচে। তলিয়ে গিয়েছে তারাপীঠ শ্মশানও। পরিস্থিতি এমনই যে সেখানে শবদাহ পর্যন্ত বন্ধ হয়ে গিয়েছে।
পশ্চিম মেদিনীপুরে ঘাটালের বন্যা পরিস্থিতি রীতিমতো উদ্বেগজনক। মুর্শিদাবাদে নদীর জলস্তর বৃদ্ধির পাশাপাশি বাসিন্দাদের মধ্যে ভাঙনের আশঙ্কা চেপে বসেছে। দুঃখের বিষয়, ঘাটালকে বন্যার অভিশাপমুক্ত করার জন্য জনকণ্ঠ উচ্চগ্রামে কয়েক দশক যাবৎ। কিন্তু আগের কেন্দ্রীয় সরকার এবং রাজ্যসরকারগুলি ঘাটাল মাস্টার প্ল্যান রূপায়ণে কোনও ফলপ্রসূ উদ্যোগ নেয়নি। ফলে দুর্ভোগের পরম্পরাই বয়ে চলেছেন ঘাটালবাসী। অন্যদিকে, নদী ভাঙনের যন্ত্রণায় বিদ্ধ নদীয়া, মুর্শিদাবাদ ও মালদহের অসংখ্য পরিবার। বিশেষত, গঙ্গাভাঙনের সমস্যা বন্যার সময়ই চূড়ান্ত আকার নেয় এবং প্রতিবছর। নিম্ন দামোদর ও ঘাটালের বন্যা এবং গঙ্গার ভাঙন রোধে স্থায়ী ব্যবস্থা নেওয়া দরকার। রাজ্যের উচিত, এই ব্যাপারে কেন্দ্রীয় সরকারকে চেপে ধরা। কারণ এই জিনিস অনন্তকাল চলতে পারে না। তবে এই মুহূর্তে রাজ্যের দুর্গত মানুষের পাশে সবাইকেই দাঁড়াতে হবে। বন্যার সময় জলবাহিত রোগের প্রাদুর্ভাব ঘটে থাকে। এছাড়া জ্বর, সর্দিকাশি, ম্যালেরিয়া, ডেঙ্গু ও চর্মরোগের প্রকোপ বাড়ে। তাই সরকারি স্বাস্থ্য ব্যবস্থাও এইসময় চাঙ্গা থাকা জরুরি। ব্যাপারটা চিকিৎসক সমাজকেও গুরুত্ব দিয়ে ভাবতে হবে। নতুবা উৎসবের মরশুমও আনন্দ বয়ে আনতে পারবে না।