আর জি কর হাসপাতালে চিকিৎসক-পড়ুয়ার ধর্ষণ ও খুনের ঘটনার পর তিন সপ্তাহ অতিক্রান্ত। এর মধ্যে সতেরো দিন ধরে তদন্ত চালাচ্ছে সিবিআই। কিন্তু শুক্রবার পর্যন্ত এই ঘটনার পরতে পরতে জমতে থাকা রহস্যের কোনও কিনারা হয়নি। সিবিআই কী করছে, সেই প্রশ্ন এখন জোরালো হয়ে উঠেছে। শেষ পর্যন্ত এই ঘটনার জট কতটা খোলে, কোথায় গিয়ে দাঁড়ায় এর পরিণতি, ধৃত সিভিক ভলেন্টিয়ার ছাড়া আর কেউ এই ঘটনায় প্রত্যক্ষ বা পরোক্ষভাবে যুক্ত কি না, থাকলে তারা কারা এবং সংখ্যায় কতজন এমন একাধিক প্রশ্নের উত্তর পেতে চায় রাজ্য, রাজ্য থেকে দেশ, দেশের গণ্ডি ছাড়িয়ে অসংখ্য মানুষ। প্রত্যেকের একটাই দাবি, দোষী বা অপরাধীদের দৃষ্টান্তমূলক শাস্তি। রাস্তায় নেমে প্রতিবাদ জানানো মানুষের সেই দাবি পূরণ হবে কি না, ৩১ বছরের ওই তরুণী চিকিৎসকের মর্মান্তিক পরিণতির শেষপর্যন্ত সুবিচার মিলবে কি না তা এখনই হলফ করে বলা যাচ্ছে না। কিন্তু এই নৃশংস ঘটনার প্রেক্ষিতে আরও একটি তথ্য সাধারণ মানুষকে কম শিহরিত করেনি। সংবাদে প্রকাশ, এই মুহূর্তে নারী নিগ্রহের ঘটনায় অভিযুক্ত দেশের মোট ১৫১ জন সাংসদ ও বিধায়কের বিরুদ্ধে মামলা চলছে। এর মধ্যে যৌন হেনস্তা ও ধর্ষণের মতো অভিযোগও রয়েছে। তালিকায় দলগতভাবে শীর্ষে বিজেপি, রাজ্যগতভাবে পশ্চিমবঙ্গ! এই ১৫১ জন জনপ্রতিনিধির বিরুদ্ধে ওঠা অভিযোগ কতটা সত্যি, অভিযোগ তোলার পিছনে কোনও রাজনৈতিক অভিসন্ধি কাজ করেছে কি না, অভিযুক্ত সাংসদ-বিধায়ক মামলা ধামাচাপা দিতে কোনও প্রভাব খাটাচ্ছেন কি না, এমন প্রশ্ন ও বিতর্ক উঠতেই পারে। কিন্তু যেটা বিস্ময়ের তা হল, এই অভিযুক্তরাই হয়তো সংসদ কিংবা বিধানসভায় দাঁড়িয়ে নারী নির্যাতনের বিরুদ্ধে জ্বালাময়ী বক্তৃতা করেন, কোনও বিল এলে বোতাম টিপে সহমত জানান, এমনকী প্রতিবাদ মিছিলে পা ও কণ্ঠও মেলান! আর জি করের ঘটনার মতো এও কম লজ্জার নয়।
অ্যাসোসিয়েশন ফর ডেমোক্রেটিক রিফর্মস সংক্ষেপে এডিআর এই তথ্য সামনে এনেছে। ২০১৯ থেকে ২০২৪ সালের মধ্যে গোটা দেশে লোকসভা ও বিভিন্ন বিধানসভা নির্বাচনের আগে প্রার্থীরা যে হলফনামা পেশ করেছেন নির্বাচন কমিশনের কাছে, তা ঘেঁটেই এই লজ্জাজনক পরিসংখ্যান উঠে এসেছে। এই পাঁচ বছরে কমিশনে মোট ৪ হাজার ৮০৯টি হলফনামা জমা পড়ে। এর মধ্যে ৪ হাজার ৬৯৩টি হলফনামা বিশ্লেষণ করে ৩০০ পাতার দীর্ঘ রিপোর্ট তৈরি করে এডিআর। তাতে দেখা যাচ্ছে, অভিযুক্ত ১৫১ জনের মধ্যে ১৬ জনের বিরুদ্ধে ধর্ষণের মামলা রয়েছে। এর মধ্যে বিজেপি ও কংগ্রেসের পাঁচজন করে জনপ্রতিনিধি রয়েছে। ধর্ষণ ছাড়াও অভিযোগের মধ্যে রয়েছে শ্লীলতাহানি, অ্যাসিড হামলা, যৌন হেনস্তা, পতিতাবৃত্তিতে নিযুক্ত করা বা বিয়ের প্রতিশ্রুতি দিয়ে নাবালিকা কেনাবেচা করার মতো ভয়ঙ্কর অভিযোগ। অভিযুক্তদের তালিকায় বিজেপির ৫৪ জন, কংগ্রেসের ২৩ জন, তেলুগু দেশমের ১৭ জন রয়েছে। দলগত তালিকায় এরাই তিন শীর্ষ স্থানাধিকারী। রাজ্যগতভাবে এক নম্বরে রয়েছে পশ্চিমবঙ্গ। এ রাজ্যে মোট ২৫ জনের বিরুদ্ধে মামলা রয়েছে। তালিকায় দ্বিতীয় ও তৃতীয়স্থানে রয়েছে যথাক্রমে অন্ধ্রপ্রদেশ (২১ জন অভিযুক্ত) এবং ওড়িশা (১৭ জন অভিযুক্ত)। শঙ্কা জাগানোর মতো বিষয় হল, তালিকায় কোনও রাজ্যের মুখ্যমন্ত্রী, কোনও কেন্দ্রীয়মন্ত্রী, বিরোধীপক্ষের নামজাদা নেতার নামও রয়েছে।
এটা ঠিক যে, অভিযোগ মানেই প্রমাণ নয়। কিন্তু অভিযোগ যে প্রমাণিত হবে না এমন গ্যারান্টিও কেউ জোর দিয়ে দিতে পারে না। স্বভাবতই প্রশ্ন উঠেছে, এমন অভিযোগের কুশীলবরা কী করে প্রার্থী হতে পারেন? জনসাধারণের কাছে রাজনৈতিক দল, নির্বাচন কমিশনের মতো সংস্থা এবং কেন্দ্র অথবা রাজ্যের সরকারের ভাবমূর্তি রক্ষা করাটাই একটা বড় বিষয়। তাহলে তো এমন একজন অভিযুক্তকে কোনওভাবেই প্রার্থী করা উচিত নয় কোনও দলের। বরং তাঁকে অনির্দিষ্টকালের জন্য দল থেকে ‘সাসপেন্ড’ করা উচিত। অথবা কোনও প্রার্থী হলফনামায় নিজেই এমন অভিযোগের কথা জানালে তাঁর মনোনয়নপত্র বাতিল করা উচিত নির্বাচন কমিশনের। অথবা এই ধরনের অভিযুক্তদের দল ও সরকারের কোনও পদে বসানোই উচিত নয়। যদি অভিযোগ প্রমাণিত না হয় সেক্ষেত্রে তাঁকে সসম্মানে ফিরিয়ে আনা যায়। আর জি করের ঘটনার পর প্রধানমন্ত্রী থেকে মুখ্যমন্ত্রী, বাম-ডান-মধ্যপন্থী সব রাজনৈতিক দল নারী নির্যাতন নিয়ে গভীর উদ্বেগ প্রকাশ করে কঠোর আইনের পক্ষে জোরালো সওয়াল করেছেন। কিন্তু এই কঠোর অনুশাসন তো ঘর থেকেই শুরু করা উচিত। ‘আপনি আচরি ধর্ম পরেরে শিখাও’। প্রত্যেক রাজনৈতিক দল ও শাসক এমন দৃষ্টান্ত তৈরি করতে পারলে তা নজির হয়ে থাকবে তাতে সন্দেহ নেই। মানুষও তাদের উপর আস্থা ভরসা ফিরে পাবে। কিন্তু বাস্তবে এমন হওয়াটা বোধহয় সিবিআই তদন্তের মতোই ধোঁয়াশাপূর্ণ।