প্রধানমন্ত্রী হিসাবে দশ বছর নরেন্দ্র মোদিকে দেখে ও তাঁর কথাবার্তা শুনে দেশবাসী একটা বিষয়ে নিশ্চিত হয়েছে। তা হল, তিনি যা বলেন, আসল সত্যটি অনেক সময়েই ঠিক তার উল্টো। নিজের সম্পর্কে একবার তিনি বলেছিলেন, ‘আমি তো ফকির (গরিব) মানুষ। কিছু হলেই ঝোলা নিয়ে বেড়িয়ে পড়ি’। অথচ নির্বাচন কমিশনের দেওয়া তথ্যে দেখা যাচ্ছে, এই স্বঘোষিত ‘ফকির’-এর ঝোলায় লক্ষ লক্ষ টাকা রয়েছে। প্রধানমন্ত্রী হিসাবে মাস গেলে বেতন ও ভাতাবাবদ তাঁর কয়েক লক্ষ টাকা রোজগার। এদেশের সংস্কৃতিতে ফকির মানে যাঁর ক্ষুন্নিবৃত্তি হয় কোনওমতে। কিন্তু আমাদের ‘ফকির’ প্রধানমন্ত্রী প্রায় ৯০০ কোটি টাকা দামের বিমান চড়েন, ১২ কোটির লিমুজিন গাড়ি চড়েন, আন্তর্জাতিক দামি ব্র্যান্ডের চশমা, ঘড়ি ও কলম ব্যবহার করেন। এই ঝোলাওয়ালার গায়ে দশ লাখি স্যুটও উঠেছিল। এমন ধনী-ফকির আবার পরের ধনে (জনগণের করের টাকায়) চমক দেখান। যেমন সম্প্রতি জানা গেল, আমেরিকার রাষ্ট্রপতি-পত্নীকে তিনি একটি হীরের আংটি উপহার দিয়েছেন, যার মূল্য ১৭ লক্ষ টাকা। দেশের মূল্যবান সম্পদও নিজের মনে করে ঘনিষ্ঠ ধনকুবেরদের হাতে তুলে দিতেও তাঁর জুডি মেলা ভার। সেই সম্পদের তালিকায় বিমানবন্দর, রাষ্ট্রায়ত্ত সংস্থা, ব্যাঙ্ক-বিমার মতো বহু ক্ষেত্র রয়েছে। বিরোধীদের অভিযোগ, এই বিপুল সম্পদের বিনিময়ে নিজের দলের আর্থিক স্বাস্থ্য মজবুত করছেন ‘ফকির’ প্রধানমন্ত্রী। শুধু ফকির নয়, অনেকসময় নিজেকে দেশের প্রধান সেবক বলেও পরিচয় দেন তিনি। কিন্তু তাঁর সেবার ঠেলায় দেশের আম জনতার নাভিশ্বাস ওঠার জোগাড়। দারিদ্র্য-বেকারি-বুভুক্ষা নিরসনে প্রধানমন্ত্রীর সেবার হাত পৌঁছায় না। তাঁর সেবা কাজে ক্রমেই সমৃদ্ধশালী হয়ে উঠছেন সমাজের ৫ শতাংশ মানুষ। এমন এক ব্যতিক্রমী ফকির, প্রধান সেবককে রাজনীতির ময়দানে ‘অবতার’-এর ভূমিকাতেও ‘অভিনয়’ করতে দেখা গিয়েছে। তিনি ‘পরমাত্মার দূত’—গত লোকসভা ভোটের আগে এই ছিল তাঁর দাবি। নির্বাচন পর্ব মিটতে তিনি অবশ্য আবার ধরাধামে অবতীর্ণ হয়েছেন মানবরূপে।
এমন দিনকে রাত, রাতকে দিন করে দিতে অভ্যস্ত প্রধানমন্ত্রীকে দেখা গেল গ্রামের গরিব মানুষের ‘ত্রাতার’ ভূমিকায়! দিন তিনেক আগে এক সরকারি অনুষ্ঠানে দাবি করেছেন, স্বাধীনতার পর কোনও সরকার যা পারেনি, তিনি তা করে দেখিয়েছেন। দশ বছরে গ্রাম-শহরের দারিদ্র্য কমিয়ে দিয়েছেন! বছরের শুরুতেই এটাকে প্রধানমন্ত্রীর জোকস হিসেবে না ভেবে তার ব্যাখ্যাও শুনতে হবে। ২০১২ সালে ভারতে গ্রামীণ দারিদ্র্যের হার ছিল ২৬ শতাংশ। এখন তা ৫ শতাংশের কম। দশ বছরে ২৫ কোটি মানুষ দারিদ্র্যসীমা থেকে বেরিয়ে এসেছে—বলেছেন প্রধানমন্ত্রী। তাঁর হিসাব মতো, এই মুহূর্তে গ্রামীণ জনতার ৯৫ শতাংশকে আর গরিব বলা যাবে না। প্রধানমন্ত্রীর এই দাবির উৎস স্টেট ব্যাঙ্কের একটি সমীক্ষা রিপোর্ট। ওই সমীক্ষায় গ্রামীণ অর্থনীতির মূল উপাদান ১০০ দিনের কাজ কিংবা দরিদ্র পরিবারের শিশুদের স্কুলমুখী করতে চালু মিড ডে মিল প্রকল্প নিয়ে একটি শব্দও খরচ করা হয়নি। তবে বলা হয়েছে, মোদির ভারতে ভাত-রুটির থালায় খাবারের বৈচিত্র্য ক্রমেই কমছে। আসলে সরকারি তথ্যই বলছে, এই দুটি প্রকল্পেই সরকার বরাদ্দ বছর বছর কমিয়েছে। অবহেলিত হচ্ছে প্রকল্প দুটি। মোদির আরও দাবি ছিল, তাঁর আমলে গ্রাম-শহরের ভোগব্যয় বেড়েছে। গ্রামের মানুষ খাদ্যের বাইরেও অনেক টাকা খরচ করছে। তিনি বলেছেন, মাঝারি ও ছোট শিল্পের হাত ধরে গ্রামাঞ্চলে এখন বাড়তি রোজগারের ব্যবস্থা হয়েছে। কমেছে কৃষি নির্ভরতা। কিন্তু আসল সত্য হল, তাঁর জমানায় দেশে লক্ষ লক্ষ ক্ষুদ্র কুটির শিল্প বন্ধ হয়ে গিয়েছে। শুধু ২০২২ সালেই বন্ধ হয়েছে ১৩ হাজারেরও বেশি। এর বেশিটাই গ্রামীণ। মোদির দাবিকে অতিরঞ্চিত বলে মনে করেন অর্থনীতিবিদদের একাংশ। তাঁদের মতে, গত এক দশকে জিনিসপত্রের দাম দুই থেকে চার গুণ বেড়েছে। টাকার মূল্য কমেছে। এই প্রয়োজনীয় উপাদানগুলি যোগ করলেই প্রকৃত ভোগব্যয় বেড়েছে কি না বোঝা যাবে। ভোগ্যপণ্য উৎপাদক সংস্থাগুলিও পাল্টা দাবি করেছে, তাদের বিক্রি কমেছে।
রং চড়ানো বিষয়কে সামনে রেখে ‘ফকিরের’ এই কেরামতি দেখানোকে অবশ্য চ্যালেঞ্জ ছুড়ে দিয়েছে রাষ্ট্রসঙ্ঘ। তাদের সংস্থার রিপোর্টে বলা হয়েছে, বিশ্বে ১১০ কোটি মানুষ তীব্র দারিদ্র্যের মধ্যে রয়েছে। এর অর্ধেক মূলত পাঁচটি দেশে, যার শীর্ষে রয়েছে ভারত। এদেশে দরিদ্র মানুষের সংখ্যা প্রায় ২৫ কোটি। তালিকায় বাকি চারটি দেশ পাকিস্তান, ইথিওপিয়া, নাইজিরিয়া ও কঙ্গো। এই দরিদ্রদের ৮৩ শতাংশই গ্রামাঞ্চলে বসবাস করেন। বিশ্বের ১১২টি দেশের ৬৩০ কোটি মানুষের মধ্যে সমীক্ষা চালিয়ে এই রিপোর্ট তৈরি হয়েছে। নরেন্দ্র মোদি এই তথ্য না মানতে চাইলেও তাঁর সরকারই দেশের ৮২ কোটি মানুষকে বিনামূল্যে রেশন দিয়ে বুঝিয়ে দিয়েছে আসল সত্যটা কী।