এই প্রথম নয়, লোকসভা ভোটে বিজেপি ২৪০ আসনে আটকে যাওয়ার পর প্রকাশ্যে সরব হয়েছিলেন তিনি। ভোটের প্রচারে নরেন্দ্র মোদিকে ‘ভগবান’ হিসেবে তুলে ধরা যে ভালোভাবে নেয়নি সঙ্ঘ পরিবার, সেই বার্তা শোনা গিয়েছিল তাঁর মুখে। এর পরেও দেখা গিয়েছে, সঙ্ঘের মুখপত্রে শাসকদল ও সরকারের কৌশল নিয়ে নানা প্রশ্ন তুলতে। এবার দিকে দিকে মসজিদের অতল গহ্বরে মন্দির খোঁজার খেলায় দাঁড়ি টানার বার্তা দিলেন আরএসএস প্রধান মোহন ভাগবত। এই সমালোচনা আসলে বোধোদয়, নাকি কৌশল তা নিয়ে চর্চা তুঙ্গে। প্রায় শতাধিক বছরের পুরনো আরএসএস বা রাষ্ট্রীয় স্বয়ংসেবক সঙ্ঘ যে বিজেপির প্রাণভোমরা, তা কোনও নতুন তথ্য নয়। মতাদর্শগতভাবে মোদির সরকার যে নাগপুরের হিন্দুরাষ্ট্র গঠনের এজেন্ডার বাস্তবায়নকে ‘পাখির চোখ’ করে গত প্রায় এগারো বছর ধরে কাজ করে চলেছে—তাও কারও অজানা নয়। অযোধ্যায় রামমন্দির নির্মাণ, জম্মু-কাশ্মীরে ৩৭০ ধারার বিলুপ্তি, তিন তালাক তুলে দেওয়া, সিএএ-এনআরসি প্রয়োগে তৎপরতা, সংসদে ‘এক দেশ এক ভোট’ বিল পেশ কিংবা অভিন্ন দেওয়ানি বিধি লাগু করার মতো একাধিক কর্মসূচির লক্ষ্য যে হিন্দুরাষ্ট্র গঠনের দিকে এগিয়ে যাওয়া এবং তা আরএসএসের দেখানো পথে, তা বলাই বাহুল্য। ভারতীয় সংবিধান থেকে সমাজতন্ত্র ও ধর্মনিরপেক্ষতা শব্দ দুটি তুলে দেওয়া বা সামগ্রিকভাবে সংবিধান বদলে ফেলার প্রবল ইচ্ছা ও চেষ্টা— তাও হচ্ছে নাগপুরেরই নির্দেশে। ঘটনা হল, বহু বর্ণ-ধর্ম-ভাষাভাষী এই দেশটাকে হিন্দুরাষ্ট্র করে তোলা, সেইসঙ্গে প্রতিদিন প্রতিনিয়ত সংখ্যালঘু বিদ্বেষ প্রচার মোদি-যোগী-শাহদের প্রত্যক্ষ মদতে সপ্তমে পৌঁছলে তা নিয়ে সেভাবে বিচলিত হতে দেখা যায় না সঙ্ঘপ্রধান বা সঙ্ঘ পরিবারের মাথাদের। এখন কৌশলগত কারণেই সংগঠনের ঊর্ধ্বে মোদির ‘ভগবান ইমেজ’ কিংবা শত শত বছরের পুরনো ধর্মস্থানের চরিত্রহরণ করে মন্দির খোঁজার চেষ্টায় রাশ টানতে চায় আরএসএস। কারণ এই তাড়াহুড়োয় সামাজিক অস্থিরতা তৈরি হলে সরকারের উপর চাপ বাড়বে। পায়ের তলার মাটি আলগা হবে। আসল লক্ষ্যপূরণের কর্মসূচি রূপায়ণে জটিলতাও দেখা দিতে পারে। অতএব, সাধু সাবধানের বাণী।
আসলে একটা সুস্থ সমাজে যা প্রত্যাশিত, ১৯৯১ সালের আইনে যা বলা হয়েছে, সেটাই ব্যাখ্যা করে শাসকদলকে সতর্ক করতে চেয়েছেন আরএসএস প্রধান। তাঁর কথায়, এদেশে কোনও সংখ্যাগুরু নেই, সংখ্যালঘু নেই। সকলেই সমান। প্রত্যেকের অধিকার আছে নিজের ধর্মপালনের। ভারতে সব ধর্মের প্রতি সমান মনোভাবের দীর্ঘ ঐতিহ্য আছে। অযোধ্যায় রামমন্দির নির্মাণ একটা ধর্মীয় আবেগ, বিশ্বাসের প্রতিফলন। সব হিন্দুই চেয়েছেন, রামমন্দির হোক। কিন্তু এর অর্থ এই নয় যে, সর্বত্র ধর্মস্থানের মধ্যে মন্দির খুঁজে দেখতে হবে। এটা সাম্প্রদায়িক ক্ষমতার মনোভাব। কেউ কেউ ভাবছেন, রামমন্দিরের অনুকরণ করে হিন্দুদের নেতা হয়ে উঠবেন। কিন্তু এভাবে হিন্দুনেতা হওয়া যায় না। এটা মেনেও নেওয়া যায় না। গত লোকসভা নির্বাচনে মোদির ‘ভগবান ইমেজ’ ধাক্কা খাওয়ায় ভোটের ময়দানে আরএসএস যে ফের চালকের আসনে বসেছে, সম্প্রতি হরিয়ানা ও মহারাষ্ট্রের নির্বাচনে তা দেখা গিয়েছে। এই দুটি রাজ্যেই বিজেপি অভূতপূর্ব সাফল্য পেয়েছে। কিন্তু মন্দির-মসজিদ বিতর্কে সঙ্ঘের
‘সকলের সমান অধিকার’ বলার আড়ালে ‘ধীরে চলো’ নীতি আগুনে হিন্দুবাদী নেতারা মেনে চলবেন— এমন সম্ভাবনা যে কম তার প্রমাণ রেখেছেন বিজেপির ‘পোস্টার বয়’ উত্তরপ্রদেশের মুখ্যমন্ত্রী যোগী আদিত্যনাথ। সঙ্ঘপ্রধানের নাম না করেই শুক্রবার অযোধ্যায় দাঁড়িয়ে ফের হিন্দুত্ব আবেগ উস্কে দিয়ে তিনি বলেছেন, হিন্দুদের মন্দির বারবার ধ্বংস করা হয়েছে, ভবিষ্যতে যাতে এই ধরনের পরিণতি না হয় তা নিশ্চিত করতে হবে। যোগীর এই বক্তব্য জেনে মোহন ভাগবত কি কোনও কঠোর বার্তা দিতে পারবেন?
অযোধ্যাকে উদাহরণ করে গত দু’বছরে দেশের নানা প্রান্তে মসজিদ বা দরগায় মন্দিরের অস্তিত্ব রয়েছে বলে আন্দোলন হচ্ছে। এর মধ্যে অন্তত তিনটি ক্ষেত্রে মসজিদের অতীত যাচাইয়ে সমীক্ষার অনুমতি দিয়েছিল আদালত। এর পর উত্তরপ্রদেশের সম্ভলে হিংসায় প্রাণ গিয়েছে একাধিক ব্যক্তির। এই প্রেক্ষিতে কোনও ধর্মীয় উপাসনাস্থলে চরিত্র বদল সংক্রান্ত নতুন কোনও মামলা করা যাবে না এবং যেসব মামলা চলেছে সেসব ক্ষেত্রে আপাতত কোনও পদক্ষেপ করা যাবে না বলে সম্প্রতি জানিয়ে দিয়েছে সুপ্রিম কোর্ট। ফলে আপাতত স্বস্তি মিলেছে। কিন্তু ধর্মস্থানের চরিত্র বদল করা যাবে না বলে ১৯৯১ সালে যে আইন তৈরি হয়েছিল তা ‘সংবিধান সম্মত’ কি না, সেই মূল প্রশ্নটি সর্বোচ্চ আদালতের বিচারাধীন। ভাগবত অবশ্য এই প্রশ্নে সংখ্যালঘুদের আশ্বস্ত করার বার্তা দিয়েছেন। এখন পরিস্থিতি অনেকটা ক্রিকেটের ২২ গজের দুই প্রান্তে থাকা ব্যাটারদের মতো। একজনকে দলের ক্যাপ্টেন বলছেন চালিয়ে খেলতে, অন্যজনকে দলের মেন্টর বলছেন ঘূর্ণি পিচে বল দেখে খেলতে। ভারসাম্যের খেলা। তবু আশায় মরে চাষা। এইভাবে খুঁড়তে খুঁড়তে ভারত আবার প্রস্তর যুগে ফিরে যাবে কি না সেটাই দেখার।