শুরুর সময় থেকে কটাক্ষ-শ্লেষ কম শুনতে হয়নি। কেউ বলেছে, এ হল ‘ভিক্ষা দানে’র প্রকল্প। কেউ প্রশ্ন তুলেছিল, এটা কি দারিদ্র্য-নিবারক ভাতা, না গৃহশ্রমের মজুরি? অনেকের মত ছিল, এটা প্রাপ্য নয়, উৎকোচ। অনেক তাত্ত্বিক আবার বলেছিলেন, এই টাকা দেওয়ার চেয়ে পরিবারের বেকার ছেলেটার একটা চাকরি হলে মা বেশি খুশি হতেন। কিন্তু তিনি, বাংলার মুখ্যমন্ত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় বোধহয় তাঁর বাস্তববোধেই অন্যরকম ভেবেছিলেন। তিনি হয়তো চেয়েছিলেন, সংসারে মহিলারা নিজের টাকায় খুশি থাকুন, আত্মনির্ভর হোন। তাঁর সেই ভাবনারই ফসল লক্ষ্মীর ভাণ্ডার। পরিবারের ২৫ থেকে ৬০ বছর বয়সি মহিলারা মাস গেলে ১০০০ টাকা (অসংরক্ষিত) বা ১২০০ টাকা (তফসিলি) পাচ্ছেন। কোনও শ্রম, শর্ত ছাড়াই। ২০২১-এর বিধানসভা ভোটের আগে মমতার এই ‘মাস্টার স্ট্রোক’ প্রকল্পের ঘোষণাই ভোটদানে বিরত থাকা বিপুল সংখ্যক মহিলাকে টেনে এনেছিল ইভিএম পর্যন্ত। ২০১১ সালে ক্ষমতায় আসার পর থেকে রাজ্যের সংখ্যালঘুদের সিংহভাগ ভোট পেয়ে আসছে মমতার দল। ২০২১-এ লক্ষ্মীর ভাণ্ডারের ঘোষণার পর থেকে দেখা গেল, মহিলারাও তৃণমূলের ভোটবাক্স ভরিয়ে তুলছেন। বাংলায় শুধু এই একটা প্রকল্পই মহিলাদের আরও বেশি সংখ্যায় বুথমুখী করে তুলেছে—বলছে সমীক্ষা রিপোর্ট। গত দশ বছরে বিভিন্ন রাজ্যে যে ভোট হয়েছে, তাতে ভোটার সংখ্যা ও ভোটদানের হার বিশ্লেষণ করে এই সিদ্ধান্তে উপনীত হয়েছে স্টেট ব্যাঙ্ক। রিপোর্টে স্পষ্ট ইঙ্গিত দেওয়া হয়েছে, মহিলাদের ক্ষমতায়ন ও আর্থিক সমৃদ্ধির প্রভাব ফেলেছে নির্বাচনগুলিতে। তুলনা করে দেখা যাচ্ছে, ২০১৬ সালে ভোটদানে বিরত থেকেছেন এমন অতিরিক্ত ২৯ লক্ষ মহিলা ২০২১-এর ভোটে ভোট দিয়েছেন। এটা হয়েছে মূলত লক্ষ্মীর ভাণ্ডারের সৌজন্যে। এবং তারপর থেকে শেষ ছ’টি বিধানসভা কেন্দ্রের উপনির্বাচন পর্যন্ত যত ভোট হয়েছে তাতে ছবিটা এতটুকু বদলায়নি। ভোটব্যাঙ্ক নিশ্চিত করতে ২০২৬-এর নির্বাচনের আগে লক্ষ্মীর ভাণ্ডারের মাসোহারার পরিমাণ বৃদ্ধির সম্ভাবনাও দেখছেন অনেকে।
একসময়ে যারা লক্ষ্মীর ভাণ্ডার প্রকল্পটি নিয়ে বিস্তর বিভ্রান্তি ছড়িয়েছে, বিদ্রুপ করেছে, খয়রাতি বলে কটাক্ষ করেছে এ রাজ্যকে, এখন তারাই মহিলা ভোটের টানে এই প্রকল্পের অন্ধ অনুকরণ করছে! মমতা মডেলের হাত ধরে নির্বাচনে সাফল্যও মিলছে দেদার। তথ্য বলছে, এই মুহূর্তে দেশের ১০টি রাজ্যে বিভিন্ন নামে মহিলাদের আর্থিক সহায়তা প্রকল্প চালু রয়েছে। এজন্য রাজ্যগুলির মোট খরচের পরিমাণ ১.৮ লক্ষ কোটি টাকা। তালিকায় সাম্প্রতিক সংযোজন মহারাষ্ট্র। গত লোকসভা ভোটে ওই রাজ্যে এনডিএ জোটের ভরাডুবি হয়েছিল। কিন্তু তারপরেই বিধানসভা ভোটের আগে ‘লাড়কি বহিন’ প্রকল্পের কথা ঘোষণা করে বিপুল জয় হাসিল করেছে সেই এনডিএ জোট। সেই রাজ্যেও পাঁচ বছর আগের তুলনায় ৫৩ লক্ষেরও বেশি মহিলা ভোট দিয়েছেন বলে জানিয়েছেন নির্বাচন কমিশন। লক্ষ্মীর ভাণ্ডারের আদলে মধ্যপ্রদেশ, কর্ণাটক, ওড়িশা, তামিলনাড়ু, অসম, ঝাড়খণ্ড, হিমাচলপ্রদেশের মতো রাজ্যগুলিতে প্রকল্প চালু হয়েছে, ভোটবাক্সে অভূতপূর্ব সাফল্যের তাগিদে। মধ্যপ্রদেশের ‘লাডলি বহেনা’, কর্ণাটকের ‘গৃহলক্ষ্মী’, তামিলনাড়ুতে ‘কালাইগনার মাগালি উরিমাই তিট্টম’, তেলেঙ্গানায় ‘মহালক্ষ্মী’, হিমাচলপ্রদেশে ‘ইন্দিরা গান্ধী পেয়ারি বহেনা’ প্রকল্পে মাস গেলে ১০০০ থেকে ২৫০০ টাকা পর্যন্ত পাচ্ছেন মহিলারা। দিল্লি বিধানসভা ভোটের আগেও মহিলা সম্মান যোজনা প্রকল্পের কথা ঘোষণা করেছে শাসকদল আম আদমি পার্টি। শোনা যাচ্ছে, দিল্লির আসন্ন নির্বাচনে এবং নিকট ভবিষ্যতে বিহারের ভোটে মহিলাদের জন্য কোনও সহায়তা প্রকল্পের ঘোষণা করতে পারে একদা লক্ষ্মীর ভাণ্ডারের বিরোধী মোদির দল। সব মিলিয়ে দেশের ১৬ শতাংশ মহিলা (১১ কোটি) রাজ্যগুলি থেকে এমন নগদ সহায়তা পাচ্ছেন। মহিলাদের এমন নগদ দেওয়ার প্রকল্পে বিপুল সাড়া মেলায় বিভিন্ন রাজ্য সরকার নাকি অন্য খাতের টাকা ঢালছে এই প্রকল্পের জন্য। ভোটের বাক্সে মহিলাদের আশীর্বাদ মেলায় বাংলার দেখানো পথ অনুকরণ করে মহারাষ্ট্রে ১১ শতাংশ, কর্ণাটকে ১৫ শতাংশ, ওড়িশার মতো রাজ্যে ৮-১০ শতাংশ অর্থ এই কল্যাণকর প্রকল্পের জন্য বাজেট বরাদ্দও হচ্ছে।
শুধু লক্ষ্মীর ভাণ্ডার নয়, এ রাজ্যে অবশ্য মেয়েদের জন্য সবুজ সাথী, কন্যাশ্রী, রূপশ্রীর মতো একাধিক জনকল্যাণমূলক প্রকল্প বহুদিন ধরেই চলছে। জনস্বাস্থ্য বিভাগের স্বাস্থ্যসাথী প্রকল্পটি রয়েছে মহিলাদের নামে। সেখানে স্বামী-সন্তান বা পরিবারের অন্যরা বিমার সুবিধা পাচ্ছেন। কিন্তু স্বাস্থ্যসাথী কার্ডটি হচ্ছে পরিবারের গৃহকর্ত্রী কোনও মহিলার নামে। আসলে বাংলার ঘরের মেয়েরা, সংসারে শ্রমদান করে যাঁরা এতকাল শুধু খাওয়া-পরা পাচ্ছিলেন, যে কোনও প্রয়োজনে যাঁদের স্বামী-পুত্রের কাছে নগদের জন্য হাত পাততে হতো তাঁরাই এখন খুশিমতো নিজেদের টাকায় ঘর-গৃহস্থালির থেকে সামান্য শখ মেটানোর জিনিস কিনতে পারছেন। এই নিজের টাকা নিজের মতো খরচ করতে পারার স্বাধীনতা সংসারে তাঁদের মাথা উঁচু করে দেয়। বাড়ে আত্মনির্ভরতা, আত্মসম্মানও। এ বড় কম কথা নয়। মমতাই প্রথম ঘরে ঘরে মহিলাদের আর্থিক সহায়তার ব্যবস্থা করে দিয়ে তাঁদের স্বাবলম্বী হতে সাহায্য করেছেন। ভোটের ছবি বলছে তার প্রতিদানও পাচ্ছেন।