সঞ্জয় সিং, মণীশ সিশোদিয়া, কে কবিতা, হেমন্ত সোরেন, অরবিন্দ কেজরিওয়াল—গত লোকসভা নির্বাচনের আগে এই নামগুলি সংবাদের শিরোনামে উঠে এসেছিল। সৌজন্য, মোদি সরকার। অভিযোগ, সিবিআই এবং ইডির মতো দুই কেন্দ্রীয় তদন্তকারী সংস্থাকে দিয়ে বিরোধীপক্ষের এই নেতা-নেত্রীদের গ্রেপ্তার করিয়ে ভোটে জিততে মরিয়া হয়ে উঠেছিলেন নরেন্দ্র মোদি, অমিত শাহরা। ভোট মিটতেই দেখা যাচ্ছে, জেলবন্দি বিরোধী নেতারা এক এক করে জামিনে মুক্তি পেতে শুরু করেছেন। তালিকায় সর্বশেষ সংযোজন দিল্লির মুখ্যমন্ত্রী অরবিন্দ কেজরিওয়াল। ধৃতদের ক্ষেত্রে জামিন না দেওয়ার কোনও যুক্তিসঙ্গত কারণ খুঁজে পাননি বিচারপতিরা। কারও কারও ক্ষেত্রে গ্রেপ্তারের যৌক্তিকতা নিয়েও প্রশ্ন তুলেছে আদালত। সব মিলিয়ে গ্রেপ্তারের আসল ‘উদ্দেশ্য’ নিয়ে ফের প্রশ্ন উঠতে শুরু করেছে। ইতিহাস বলছে, ইউপিএ জমানাই হোক বা বিজেপি শাসন—বিরোধীদের ‘শায়েস্তা’ করতে শাসকগোষ্ঠী বরাবর ইডি-সিবিআইকে বদলা ও ভয় দেখানোর হাতিয়ার হিসেবে ব্যবহার করেছে। মনমোহন সিং-এর জমানায় সংগতিবিহীন সম্পত্তি থাকার অভিযোগ ওঠে সমাজবাদী পার্টির তৎকালীন সুপ্রিমো প্রয়াত মুলায়ম সিং যাদব ও তাঁর ছেলে অখিলেশ যাদবের বিরুদ্ধে। আবার ২০১৩ সালে নিজেদের জোটসঙ্গীকে চাপে রাখতে ডিএমকে নেতা এম কে স্ট্যালিনের বাড়িতে তল্লাশি চালায় সিবিআই। এই ঘটনায় ইউপিএ-র সঙ্গ ত্যাগ করে ডিএমকে। বিশেষজ্ঞদের মতে, মনমোহনের জমানায় তবু কিছু রাখঢাক ছিল। মোদি জমানায় কোনও আড়াল আবডাল নেই, সবই খুল্লাম খুল্লা চলছে। তথ্য বলছে, ২০২২ সাল পর্যন্ত মোদি জমানায় কেন্দ্রীয় সংস্থা যত মামলা করেছে তার ৯৫ শতাংশই বিরোধী দলের নেতা-নেত্রীদের বিরুদ্ধে। বস্তুত লোকসভা ভোটের আগে নানাবিধ দুর্নীতির অভিযোগ তুলে সারিবদ্ধভাবে গ্রেপ্তার করা হয়েছে ‘ইন্ডিয়া’ জোটের কর্মকর্তাদের। কিন্তু আদালত একের পর এক জামিন দিয়ে গ্রেপ্তারগুলি নিয়ে প্রশ্ন তুলে দিয়েছে।
অথচ সাধারণ মানুষের বিশ্বাস হল, কোনও অপরাধের কিনারা করতে কেন্দ্র ও রাজ্যের পুলিস প্রশাসন ব্যর্থ হলে ডাকা হয় সিবিআই, ইডির মতো কেন্দ্রীয় সংস্থাকে। কারণ, এরা অনেক বেশি দক্ষ ও পেশাদার। আশা থাকে, এই এজেন্সিগুলি রাজনীতির প্রভাবমুক্ত হয়ে কাজ করবে। কিন্তু এই ধারণার সঙ্গে বাস্তব প্রায় কোনও ক্ষেত্রেই মেলে না। প্রকৃত সত্য হল, এই দুই শীর্ষ সংস্থাই রাজনীতির অঙ্গুলিহেলনে পরিচালিত হচ্ছে। এই বিশ্বাস শুধু আম জনতার নয়, অনেক ক্ষেত্রে আদালতও তাই মনে করে। ফলে বিভিন্ন মামলায় এই দুই সংস্থাকে তিরস্কৃত হতে হচ্ছে বারবার। তেলেঙ্গানার প্রাক্তন মুখ্যমন্ত্রীর কন্যা কে কবিতাকে জামিন দিতে গিয়ে সুপ্রিম কোর্ট বলেছে, তদন্তকারী সংস্থা মামলার অন্যতম অভিযুক্তকে রাজসাক্ষী করে পরে তাঁকেই আবার সাক্ষী হিসেবে তুলে ধরে! এই ঘটনা সন্দেহের উদ্রেক করে। দিল্লির মুখ্যমন্ত্রী কেজরিওয়ালের ক্ষেত্রে সর্বোচ্চ আদালতের বিচারপতি প্রশ্ন তুলেছেন, অভিযুক্তের বিরুদ্ধে এফআইআর করার ২২ মাস পরে তাঁকে গ্রেপ্তার করল সিবিআই! এটা যথেষ্ট সন্দেহের। ইডির মামলায় জামিন পেতে পারেন বুঝেই তাঁকে গ্রেপ্তার করে সিবিআই, এই অনুমানের কারণ আছে। অর্থাৎ, যথেষ্ট যুক্তিসঙ্গত কারণ ছাড়াই কোনও অভিযোগ তুলে জেলে ঢোকানো হয়েছে বিরোধী নেতা-নেত্রীদের, যা এখন ব্যুমেরাং হয়ে ফিরে আসছে। বিরোধীদের অভিযোগ এটাই ছিল। এ রাজ্যেও দেখা যাচ্ছে, বিভিন্ন দুর্নীতি মামলায় ধৃতরা একে একে জামিন পেয়ে যাচ্ছেন। যেমন মানিক ভট্টাচার্য, জীবনকৃষ্ণ সাহা, সুকন্যা মণ্ডল প্রমুখ। এই যে ঢাকঢোল পিটিয়ে গ্রেপ্তার করার পর কার্যত আদালতে গিয়ে ল্যাজেগোবরে হতে হচ্ছে—এই কারণেই কেন্দ্রীয় এজেন্সিগুলির কাজকর্ম ও নিরপেক্ষতা নিয়ে জোরালো প্রশ্ন উঠেছে। এই কারণেই হয়তো কেজরিওয়ালকে জামিন দিতে গিয়ে সিবিআইকে আরও একবার ‘খাঁচাবন্দি তোতাপাখি’ বলে কটাক্ষ করেছে আদালত। রীতিমতো ক্লেশ মিশিয়ে বিচারপতি বলেছেন, ‘আপনাদের প্রমাণ করতে হবে আপনারা খাঁচার পাখি নন। খাঁচা থেকে মুক্ত।’
শুধু তো বিরোধীদের গ্রেপ্তার নয়, সাম্প্রতিক অতীতে নানা রাজ্যে বিশেষত অবিজেপি শাসিত রাজ্যগুলিতে বিধানসভা ভোটের আগে সিবিআই-ইডির অতি সক্রিয়তা দেখতে অভ্যস্ত হয়ে উঠেছে আম জনতা। অভিযোগ, অনৈতিকভাবে সরকার গড়তে ও নির্বাচিত সরকার ভাঙতে মোদি-শাহর দুই বাহু হিসেবে কাজ করে চলেছে এই দুই সংস্থা। এই অভিযোগ যে অনেকাংশে সত্য অর্থাৎ কেন্দ্রীয় এজেন্সিগুলির উপর যে রাজনৈতিক প্রভাব খাটানো হয় তা নিয়ে মুখ খুলেছেন সিবিআইয়েরই দুই প্রাক্তন ডিরেক্টর। এমনকী নানা সময়ে ক্ষমতাসীন শাসক তদন্তকারী ব্যক্তিত্বকে প্রলোভনও দেখায় বলে অভিযোগ। যে দলই ক্ষমতায় আসে তারা বিপক্ষ দলের বিরুদ্ধে সিবিআই-ইডির মতো তদন্তকারী সংস্থাকে হাতিয়ার করতে চায়। তাই শাসক বদলালেও এই অবাঞ্ছিত প্রচেষ্টা চলতেই থাকে। ফলে ‘খাঁচাবন্দি তোতাপাখি’ খাঁচাতেই থেকে যায়। বদনাম ঘোচে না। মুক্ত স্বাধীনভাবে কাজ করার সুযোগ তারা কমই পায়।