হুমকির পর হুমকি! বাংলাদেশের প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা দেশ ছাড়তেই সীমান্তের ওপার থেকে শোনানো হল, তারা ভারতের ‘সেভেন স্টারস’ ছিনিয়ে নেবে। তার মানে, উত্তর-পূর্বাঞ্চলের অসমসহ সাতটি রাজ্য জুড়ে দেবে বাংলাদেশের মানচিত্রে। আর এই স্বপ্নের পোলাও খাওয়া শুরু হতেই টের পাওয়া যাচ্ছে তাতে ঘি ঢালতে কোনও কার্পণ্য করছে না ওদেশের উগ্র মৌলবাদী মুসলিমরা। তারা ইতিমধ্যে একদিন শোনাল, মাত্র চারদিনেই কলকাতার দখল নেবে। তাতেও থামতে রাজি না পাকিস্তানের হাতের পুতুলগুলি। তাদের পরবর্তী সংযোজন আরও রোমহর্ষক: ‘আমরা বাংলা, বিহার ও ওড়িশার পূর্ণ দখল চাই।’ মানে পূর্ববঙ্গের সঙ্গে পশ্চিমবঙ্গ, বর্তমান বিহার ও ঝাড়খণ্ড এবং ওড়িশা তারা চায়। ওই উন্মাদদের বক্তব্য, বাংলা, বিহার ও ওড়িশা মিলিয়ে নবাব সিরাজের যে সাম্রাজ্য একদা ছিল, তাতে নাকি একমাত্র বাংলাদেশেরই হক রয়েছে। বলা বাহুল্য, এই উগ্র মৌলবাদী মুসলিমদের কাছে বাংলাদেশ মানে সব ধর্ম বর্ণের দেশ নয়, সেটা একমাত্র মুসলিমদেরই রাষ্ট্র। সেখানে হিন্দু, বৌদ্ধ, খ্রিস্টান, আদিবাসী প্রভৃতি সংখ্যালঘু সম্প্রদায়কে তারা বাংলাদেশের নাগরিক মানতে নারাজ। ১৯৪৭ পরবর্তীকালে বিশেষভাবে টার্গেট করা হয়েছে হিন্দুদের। জমিজমা, ব্যবসা, চাকরি, উচ্চশিক্ষার সুযোগ প্রভৃতি গায়ের জোরে কেড়ে নিতে লাগাতার অত্যাচার হয়েছে তাদের উপর।
এই দুর্বৃত্তায়নকে আইনসিদ্ধ করতেই ছুড়ে ফেলা হয়েছে শেখ মুজিবুর রহমান প্রবর্তিত ‘ধর্মনিরপেক্ষ’ সংবিধান, সাংবিধানিকভাবে সব ধর্মের মানুষের ঘাড়ে চাপিয়ে দেওয়া হয়েছে ‘রাষ্ট্রধর্ম ইসলাম’-এর যন্ত্রণা। বলা বাহুল্য, বঙ্গবন্ধু ধর্ম বর্ণ নির্বিশেষে সবার জন্য স্বাধীন, সার্বভৌম বাংলাদেশের স্বপ্ন দেখেছিলেন। এই ‘অপরাধেই’ তাঁর প্রাণ নিয়েছিল উগ্র মুসলিম মৌলবাদী শক্তি। হাসিনা ও রেহানা—মুজিবের এই দুই কন্যা বাদে পরিবারের বাকিদেরও হত্যা করা হয় ওই ঘটনায়। তারপরই ওপার বাংলা হিন্দুসহ অন্যান্য সংখ্যালঘু শ্রেণির জন্য সাক্ষাৎ নরক হয়ে ওঠে। তীব্র গণ আন্দোলনের মধ্য দিয়ে শেখ হাসিনাই ওই অশুভ শক্তিকে পরাস্ত করেন এবং তিনি আপ্রাণ চেষ্টায় ছিলেন দেশটিকে আধুনিকতার আলোয় তুলে আনতে। তিনি যে অনেকখানি সফলও হয়েছিলেন আন্তর্জাতিক মহল বার বার তা স্বীকারও করেছে।
সেই প্রধানমন্ত্রীই তথাকথিত ‘বৈষম্যবিরোধী’ বা ‘দ্বিতীয় স্বাধীনতা’র আন্দোলন নামে এক রক্তক্ষয়ী ষড়যন্ত্রের শিকার হলেন। তাঁকে দেশ ছাড়তে বাধ্য করা হল। তাঁর স্থলাভিষিক্ত হয়েছেন নোবেলজয়ী অর্থনীতিবিদ মহম্মদ ইউনুস। উগ্র মৌলবাদীদের উপর তত্ত্বাবধায়ক সরকারের প্রধানের যে কিছুমাত্র নিয়ন্ত্রণ নেই তার প্রমাণ মিলছে প্রতিদিন, প্রতিমুহূর্তে। দিকে দিকে আক্রান্ত হচ্ছেন হিন্দু, বৌদ্ধ, খ্রিস্টান ও আদিবাসীরা। তাঁদের ঘরবাড়ি, ব্যবসাপত্র লুট করা হচ্ছে এবং ভাঙচুর ও অগ্নিসংযোগ করা হচ্ছে একের পর এক মন্দিরে। কিন্তু সরকারি প্রশাসন বেশিরভাগ ক্ষেত্রেই দুর্বৃত্তদের বিরুদ্ধে কোনও ব্যবস্থা নিচ্ছে না। উল্টে, রোষের মুখে পড়ছেন তাঁরাই, এই সীমাহীন অত্যাচারের যাঁরা প্রতিবাদ করছেন। যেমন বাংলাদেশ সনাতন জাগরণী মঞ্চের নেতা চিন্ময়কৃষ্ণ দাসকে আইনি জালে ফাঁসানো হয়েছে। তাঁর জামিন নাকচ করেছে চট্টগ্রাম আদালত। এমনকী কোর্টে আইনজীবী গ্রহণের সুবিধাটুকুও তাঁকে দেওয়া হয়নি। তাঁর পক্ষে সওয়াল করতে আগ্রহী আইনজীবীদের নৃশংস আক্রমণের শিকার হতে হয়েছে। সবচেয়ে পরিতাপের বিষয়, এক্ষেত্রে আক্রমণকারীরা পেশায় উকিল! আরও ভয়াবহ ব্যাপার, এই লোকগুলি চিন্ময়কৃষ্ণ দাসের ফাঁসির দাবিতে সরব হয়েছে। হায়, বাংলাদেশ! অন্যায়ের প্রতিবাদীদেরই চরম সাজা চায় সমাজের একটি অংশ এবং অন্যায়কারীরা বেড়ায় বুক ফুলিয়ে! এটা কেন সম্ভব হচ্ছে তা পরিষ্কার হল, সৈয়দা রিজওয়ানা হাসানের দাবিতে, ‘হামলার অভিযোগগুলির বেশিরভাগই রাজনৈতিক!’ সোমবার ভারতের বিদেশ সচিব বিক্রম মিস্রির সঙ্গে ঢাকায় তত্ত্বাবধায়ক সরকারের একটি বৈঠক হয়। অতঃপর যৌথ সাংবাদিক সম্মলেনে বাংলাদেশ সরকারের পরিবেশ উপদেষ্টা ওই দায় এড়ানো দাবি করেন। বাংলাদেশ কেন অগ্নিগর্ভ, তার কারণ নিহিত এখানেই। উগ্র মুসলিম মৌলবাদী আক্রমণকারীদের একতরফাভাবে আড়াল করা হচ্ছে সেখানে। আর সেখান থেকেই ভারত আক্রমণের আস্ফালন ছড়াচ্ছে ওপার বাংলা। এই অসভ্যতার মুখতোড় জবাব দিতে দেরি করেননি বাংলার মুখ্যমন্ত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ও। সোমবার বিধানসভায় তিনি বলেন, ‘এত বড় হিম্মত শুধু আপনাদের কেন, কারও নেই! আপনারা দখল নেবেন, আর আমরা কি বসে বসে ললিপপ খাব? আমরা যথেষ্ট সচেতন ও সক্রিয় নাগরিক। তবে আমরা ধৈর্যের পরীক্ষা দিই। মানুষকে রক্ষা করব।’ এর আগে পদ্মাপারে আটকে পড়া ভারতীয় নাগরিকদের উদ্ধারে রাষ্ট্রসঙ্ঘের শান্তিরক্ষী বাহিনী পাঠানোরও দাবি জানান তিনি। যাই হোক, পরিস্থিতি মোটেই সুখকর নয়, অর্বাচীন বাংলাদেশ এখনই সংযত না-হলে ভারত সরকারের উচিত তাদের সবরকমে সমঝে দেওয়া।