পশ্চিমবঙ্গে মনরেগার (১০০ দিনের কাজের প্রকল্প) টাকা আসছে না তিনবছর যাবৎ। মোদি সরকার নানা অজুহাতে আটকে রেখেছে গরিব মানুষের জন্য পাকাবাড়ি তৈরির প্রকল্পের (আবাস) অর্থ বরাদ্দও। একের পর এক কেন্দ্রীয় প্রকল্পে বাংলার সঙ্গে আর্থিক বঞ্চনা চরম আকার ধারণ করেছে মোদি-যুগে। সেই সত্তরের দশকের শেষার্ধ থেকে কেন্দ্রের শাসক দলের কর্তৃত্ব নাকচ করেছে বাংলার মানুষ। ২১ জুন, ১৯৭৭ থেকে ২০ মে, ২০১১ পর্যন্ত—টানা ৩৪ বছর ছিল সিপিএমের নেতৃত্বে বামফ্রন্টের শাসন। তারপর থেকে এখনও পর্যন্ত সাড়ে ১৩ বছরের বেশি সময় ধরে চলছে মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ের মুখ্যমন্ত্রিত্বে তৃণমূল কংগ্রেসের মা-মাটি-মানুষের সরকার। মমতার পূর্বসূরি জ্যোতি বসু, বুদ্ধদেব ভট্টাচার্যকে লড়াই করতে হয়েছিল কেন্দ্রের তৎকালীন কংগ্রেস শাসকের বিরুদ্ধে। দিল্লীশ্বর হিসেবে ইন্দিরা থেকে রাজীব হয়ে রাও বা মনমোহন কেউই বাংলার প্রতি বিশেষ সহানুভূতিশীল ছিলেন না। বরং কেন্দ্র-রাজ্য সম্পর্কের যুক্তরাষ্ট্রীয় ব্যবস্থা বিভিন্ন ইস্যুতে বার বারই ধাক্কা খেয়েছে। তবু একটা লড়াইয়ের পর অনেক ক্ষেত্রেই সংযত হতে দেখা গিয়েছে দিল্লির তখনকার কর্তাদের। লড়াইয়ের মাধ্যমে দাবি আদায়ের পর বাংলা ফের কাজ শুরু করতে পেরেছিল, তার নজিরও কম নয়। আর সেখানেই পূর্বসূরিদের বলে বলে দশ গোল দিয়ে চলেছে ‘সিঙ্গল ইঞ্জিন’, ‘ডাবল ইঞ্জিন’ বিভাজনের সরকার।
মোদি সরকারের এই অন্যায় নীতিরই বার বার ‘বলি’ হচ্ছে বাংলা। বলা বাহুল্য, মনরেগা, আবাস প্রভৃতি সরকারি প্রকল্পের মূল্য লক্ষ্য গরিব মানুষের উন্নয়ন বা গরিবি দূর করা। স্বভাবতই, এই প্রকল্পগুলি বন্ধ হলে, এমনকী কিছুটা ব্যাহত হলেও তার দরুন গরিব মানুষ সরাসরি ক্ষতিগ্রস্ত হয়। পরোক্ষে ক্ষতি হয় অর্থনীতির, তার বিরূপ প্রভাব পড়ে অর্থনৈতিক ব্যবস্থার সঙ্গে নানাভাবে যুক্ত সকলেরই উপর, তার মধ্যে অবশ্যই পড়ে মধ্যবিত্ত শ্রেণিও। তাই মোদি সরকারের রাজনৈতিক সংকীর্ণতাদুষ্ট নীতি সর্বার্থে নিন্দনীয়। এই প্রসঙ্গেই লক্ষণীয়, কেন্দ্রের বেনজির বঞ্চনা সত্ত্বেও গ্রামবাংলার অর্থনীতিকে রীতিমতো সচল রাখতে পেরেছে মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ের সরকার। এর পুরো কৃতিত্ব জননেত্রীর বিকল্প অর্থনৈতিক ভাবনা। ২০১১ থেকেই তাঁর এই সমাজকল্যাণ ভাবনায় পুষ্ট হয়ে চলেছে বাংলার অর্থনীতি। শুরু থেকেই তাঁর অগ্রাধিকারের তালিকার উপরের দিকে রয়েছে গ্রাম, গরিব এবং গরিব ঘরের কন্যা। তার জন্য মমতা চালু করেছেন কন্যাশ্রী, রূপশ্রী, সবুজ সাথী, খাদ্যশ্রী এবং দুর্বল শ্রেণির জন্য আরও নানারকম ভাতা ও অনুদান বণ্টনের প্রকল্প। স্বনির্ভর গোষ্ঠীর মাধ্যমে মহিলাদের যে আর্থিক উন্নয়ন ঘটেছে এরাজ্যে এই জমানায় তা নিঃসন্দেহে অভূতপূর্ব। এমনকী, মোদি সরকার বাংলার বিরুদ্ধে জব্দনীতি নেওয়ার কারণে মনরেগা এবং আবাসেরও বিকল্প কর্মসূচি চালু করেছেন মমতা। সব মিলিয়ে দিল্লির ধাক্কা নস্যাৎ করেও পূর্ববৎ এগিয়ে যাওয়ার সংকল্পে অনড় মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ের অর্থনীতি।
মোদির পার্টির নেতারা মেঠো ভাষণে অনেক কিছুই অস্বীকার করতে পারেন, কিন্তু সরকারি তথ্য যে সাক্ষ্য দিচ্ছে তাকে নস্যাৎ করবে কী করে দিল্লির সরকার? সেটা যে সম্ভব নয় এবং পারেননিও মোদির অর্থমন্ত্রী নির্মলা সীতারামন। অতএব শনিবার তাঁরই মুখে শোনা গেল বাংলার গ্রামীণ অর্থনীতির দরাজ প্রশংসা! বাংলাসহ পুবদিকের চার রাজ্যের আঞ্চলিক গ্রামীণ ব্যাঙ্কগুলি গত অর্থবর্ষে ৬২৫ কোটি টাকা মুনাফা করেছে। মোদিরা দরাজ হাতে টাকা বিলিয়েছেন উত্তরপ্রদেশ, গুজরাত প্রভৃতি বিজেপি শাসিত রাজ্য সরকারগুলিকে। আর কৃষি, বাণিজ্য ও শিল্প ক্ষেত্রে উল্লেখযোগ্য অবদান রেখেছে বাংলাসহ পূর্বাঞ্চলের চার রাজ্য। বঞ্চনার অহিংস প্রতিবাদের এমন দৃষ্টান্ত সত্যিই সকলের নজর কাড়ে। যাই হোক, এতে খুশি অর্থমন্ত্রী। এই প্রেক্ষিতে গ্রামীণ ব্যাঙ্ক কর্তাদের প্রতি তাঁর নির্দেশ, পশ্চিমবঙ্গ, ঝাড়খণ্ড, ওড়িশা ও বিহারের গ্রামীণ মানুষকে আরও বেশি করে ব্যাঙ্কঋণ দেওয়া হোক। তাদের ডিজিটাল ব্যবস্থার আওতায় আনার কাজে গতিবৃদ্ধির উপরেও গুরুত্ব আরোপ করেছেন তিনি। যদি বিচারের নিরপেক্ষ মাপকাঠির নাম হয় পারফর্ম্যান্স, তবে সেই মানদণ্ডে মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ের সরকার নিজেকে বার বার দেশের মধ্যে যোগ্যতম হিসেবে প্রমাণ করেছে। এরপরও কি বাংলার মানুষের ন্যায্য প্রাপ্য মেটাতে উদ্যোগী হবে মোদি সরকার? এই প্রশ্নের উত্তর ইতিবাচক না-হলে বুঝতে হবে, মোদিরা মানুষের ও দেশের উনয়ন চান না, নিছক ক্ষমতার রাজনীতিই তাঁদের ব্রত। শাসকের এই অসাংবিধানিক ভূমিকার জবাব উপযুক্ত সময়ে এবং যথাস্থানে নাগরিককেই দিতে হবে।