জুনিয়র ডাক্তারদের টানা কর্মবিরতির ফলে কলকাতায়সহ বাংলায় চিকিৎসা ক্ষেত্রে চরম অচলাবস্থাই কায়েম হয়েছে। খবরকাগজের পাতায় পাতায় মর্মান্তিক সংবাদ। শিরোনামগুলি এইরকম—‘কর্মবিরতির জের, সাপে কাটা তরুণীর মৃত্যুর অভিযোগ এনআরএসে’, ‘ব্রেন টিউমারের রোগীকে নিয়ে এসএসকেএমে অসহায় আত্মীয়রা, ভর্তির জন্য কাতর অনুরোধ’, ‘আর জি করে বিনাচিকিৎসায় মরতে হল ছেলেকে, যুবকের মৃত্যুতে অভিযোগ বাবার!’ শেষোক্ত ঘটনায় সন্তানহারা বাবা প্রশ্ন রেখেছেন, ‘আর কত প্রাণ গেলে হুঁশ ফিরবে প্রতিবাদীদের?’ কাজে ফেরার জন্য সময়সীমা বেঁধে দিয়েছিল আদালত। কাজে ফেরা তো দূর, উল্টে ব্যঙ্গই শুরু হয়েছে প্রতিবাদীদের তরফে! স্বাস্থ্যভবনের সামনের রাস্তায় লেখা হয়েছে, ‘ডাক ছাড়ো এত দূর/ যেন শুনতে পায় চন্দ্রচূড়!’ সেই লেখা মাড়িয়ে যাচ্ছেন অনেকে। দেওয়াল-গ্রাফিতিতে লালরঙে ‘চন্দ্রচূড়’ লিখে তার নীচে আঁকা হয়েছে বিষধর সাপের ছবি! রাজ্যে সম্প্রতি বিনামূল্যের সরকারি চিকিৎসা থেকে বঞ্চিত অন্তত ৯-১০ লক্ষ মানুষ। বিভিন্ন টেস্টের সুযোগ নষ্ট হয়েছে তারও বেশি। অপারেশন বাতিল অথবা পিছিয়ে গিয়েছে ৬-৭ হাজার। সর্বোপরি চিকিৎসা না-পেয়ে মৃত্যু হয়েছে অন্তত ২৯ জনের, যাঁদের পরিবার পিছু রাজ্য সরকার ২ লক্ষ টাকা ক্ষতিপূরণও দেবে। পাশাপাশি দেখুন, কাজ না-করেও জনগণের করের টাকা থেকে মাসিক ভাতা (মাথাপিছু ৩২-৭৫ হাজার টাকা) দিব্যি গুনে নিচ্ছেন আন্দোলনরত জুনিয়র ডাক্তাররা। বিভিন্ন ক্যাটিগরিতে জুনিয়র ডাক্তারের সংখ্যা ১০,৭৪৪। আন্দোলনে শামিল তাঁদের বেশিরভাগই। তাঁদের ভাতা দিতে মাসে খরচ হচ্ছে প্রায় ৫০ কোটি টাকা! সহকর্মীর জন্য ‘বিচার’ চেয়ে তাঁরা রাস্তায়। অন্যদিকে, তাতে জনগণ নাগাড়ে পরিষেবা-বঞ্চিত। একের পর এক রোগীর মৃত্যুর জন্য পরোক্ষে দায়ী তাঁরাই। এজন্যও রাজকোষ থেকে ৫৮ লক্ষ টাকা ক্ষতিপূরণ দিচ্ছে মানবিক রাজ্য সরকার। এখন আন্দোলনকারীরা যে সাফাইই দিন না কেন, তা কোনোভাবেই গ্রহণযোগ্য নয়। আর জি কর ইস্যুতে সমান সহমর্মী রাজ্যবাসী তাঁদের বিবেকদংশনও প্রত্যাশা করেছিল। কিন্তু জুনিয়র ডাক্তাররা নানাভাবে বুঝিয়ে দিয়েছেন যে তাঁরা আসলে অন্য ধাতুতে গড়া! তাঁরা শুধু নিজেদেরটাই বোঝেন। তার জন্য গরিব মানুষ চূড়ান্ত অবিচারের শিকার হলেও কুছ পরোয়া নেই!
আর জি কর মামলায় বিক্ষোভরত চিকিৎসকদের উদ্দেশে ৯ সেপ্টেম্বর দেশের প্রধান বিচারপতি ডি ওয়াই চন্দ্রচূড়ের স্পষ্ট নির্দেশ ছিল, ‘দায়িত্বে অবহেলা করে প্রতিবাদ হয় না। ১০ সেপ্টেম্বর বিকেল ৫টার মধ্যে জুনিয়র ডাক্তাররা কাজে যোগ দিন।’ একইসঙ্গে তাঁর স্পষ্ট বার্তা, ‘নির্ধারিত সময়ের মধ্যে কাজে ফিরলে রাজ্য সরকার তাঁদের বিরুদ্ধে কোনও ব্যবস্থা নেবে না। বাকিটার জন্য সিবিআই তদন্ত যথারীতি চলবে। ১৭ সেপ্টেম্বর পরবর্তী শুনানির দিনই নতুন স্টেটাস রিপোর্ট দেবে সিবিআই।’ আর জি কর কাণ্ডে সুপ্রিম কোর্টের স্বতঃপ্রণোদিত মামলায় তৃতীয় শুনানি শেষে এটাই ছিল সিদ্ধান্ত। পরিষ্কার যে, অপরাধের তদন্তের পাশে কোর্ট সমান গুরুত্ব দিয়েছে চিকিৎসা সঙ্কটকেও। তাদের সেদিনের ভূমিকায় দেশের বিচার ব্যবস্থার মানবিক মুখটিই পরিস্ফুট হয়ে ওঠে। এর থেকেই বোঝা যায়, আদালতের উপরেই কেন মানুষ তার শেষ আস্থাটি স্থাপন করেছে। সেদিন নিরপেক্ষ অভিভাবকের মতো শীর্ষ আদালত সাবধানও করে দিয়েছিল, ‘এরপরও যদি জুনিয়র ডাক্তাররা কাজে না ফেরেন এবং তার প্রেক্ষিতে সরকার ডিসিপ্লিনারি অ্যাকশন নিলে আমাদের কিছু বলার থাকবে না।’
রাজ্যে জুনিয়র ডাক্তারদের কর্মবিরতিসহ ধর্না কর্মসূচির শুরু ৯ আগস্ট। অর্থাৎ, শীর্ষ আদালতে ওই নির্দেশ ঘোষিত হয় আন্দোলনের একমাসের মাথায়। আমরা জানি, আদালতের নির্দেশ সত্ত্বেও জুনিয়র ডাক্তাররা যথাসময়ে কাজে যোগ দেননি। তবু তাঁদের বিরুদ্ধে কোনও ব্যবস্থা নেয়নি রাজ্য সরকার। উল্টে, স্বয়ং মুখ্যমন্ত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ই বারবার অনুরোধ করেছেন তাঁদের কাজে ফেরার জন্য। তার উপযুক্ত পরিবেশ সৃষ্টি করতে আলোচনাও চেয়েছেন তিনি একাধিকবার। মুখ্যমন্ত্রী জানিয়েছেন, তরুণী চিকিৎসকের উপর সংঘটিত অপরাধের শাস্তির ব্যাপারে আন্দোলনকারীদের সঙ্গে তিনিও সহমত পোষণ করেন। এমন অপরাধীর ফাঁসিই চান তিনি। সেই শাস্তি দ্রুত দিতে ইতিমধ্যেই তাঁর সরকার নতুন আইন তৈরিরও উদ্যোগ নিয়েছে। মুখ্যমন্ত্রী মনে করেন, গণতন্ত্রে জট খোলার শ্রেষ্ঠ উপায় হল আলোচনা। এই ব্যাপারে মুখ্যমন্ত্রীর সঙ্গে তাঁর প্রশাসনের সংশ্লিষ্ট অফিসারদেরও আন্তরিক ভূমিকা প্রশংসনীয়। কিন্তু আলোচনায় বসার চার চারটি সুযোগ নষ্ট করা হয়েছে আন্দোলনকারীদেরই তরফে। নেপথ্যে, লাশের উপর দিয়ে ক্ষমতা দখলের রাজনীতির কারবারিদের কালো ছায়া আর গোপন নেই। সব মিলিয়ে, আদালত কঠোর অবস্থান গ্রহণের পরও একসপ্তাহ অতিক্রান্ত। জুনিয়র ডাক্তারদের আন্দোলনের এটি ষষ্ঠ সপ্তাহ। সুপ্রিম কোর্টে আজ ফের শুনানি। আদালত নিশ্চয় এই প্রত্যাশায় আছে যে চিকিৎসা চালুর ব্যাপারে এদিন কোনও সুখবরই আসছে বাংলা থেকে। রাজ্যবাসীও জুনিয়র ডাক্তারদের বিবেক জাগ্রত হওয়ার প্রহর গুনছে।