আগামী ৯ সেপ্টেম্বর, সোমবার সুপ্রিম কোর্টের প্রধান বিচারপতির তিন সদস্যের বেঞ্চে আর জি কর মামলার শুনানি হওয়ার কথা। সেই দিনই রাজ্যের জুনিয়র ডাক্তারদের কর্মবিরতি ও নাগরিক আন্দোলনের এক মাস পূর্ণ হবে। সরকারি হাসপাতালে একজন তরুণী চিকিৎসককে ধর্ষণ ও খুনের ঘটনার প্রতিবাদে যে স্বতঃস্ফূর্ত জনবিস্ফোরণ দেখা গিয়েছে, কোনও তুলনা না টেনেই বলা যায় তা নজিরবিহীন। ঘটনার উৎসস্থল কলকাতা হলেও তার প্রতিক্রিয়া এই মহানগর, রাজ্য, দেশের গণ্ডি ছাড়িয়ে ছড়িয়ে পড়েছে বিশ্বের বিভিন্ন প্রান্তে। কারণ জাস্টিস চায় দলমত নির্বিশেষে সকলে। মহিলাদের রাত দখল, এক ঘণ্টা ঘরের আলো নিভিয়ে রাখা, মোমবাতি হাতে রাস্তায় মানববন্ধন তৈরি, ‘চিরশত্রু’ দুই ফুটবল ক্লাব সদস্য-সমর্থকদের পা মিলিয়ে প্রতিবাদ, ধর্মতলায় নাগরিকদের সারা রাত ধর্না, লালবাজারের বুকে দাঁড়িয়ে পুলিসকে দাবি মানতে বাধ্য করা জুনিয়র ডাক্তারদের—আন্দোলনের এমন নতুন নতুন প্রয়াস আগে দেখেনি সমাজ। সমবেত প্রতিবাদের গান, পথনাটিকা, মশাল, রাজপথে রং তুলিতে সুবিচারের দাবি ফুটিয়ে তোলা—প্রতিবাদ আন্দোলন যেন নতুন ভাষা ও আবেগে বহমান। কেউ কেউ কটাক্ষ করে বলছেন, এ হল ‘গণহিস্টিরিয়া’। আবার অনেকের মতে, এই গণউন্মাদনা ক্রমশ ‘হুজুগে’ পরিণত হচ্ছে। সত্য যাই হোক, ঘটনা হল প্রায় প্রতিদিন আলপথ থেকে রাজপথে ওঠা অবাধ্যতার ঢেউ বিদ্রোহ হয়ে আছড়ে পড়ছে। কিন্তু দুর্ভাগ্যের হলেও সত্যি, এই স্বতঃস্ফূর্ত প্রতিবাদের আঙিনায় মাঝেমধ্যেই তাল কাটছে। লেগে যাচ্ছে রাজনীতির রং। হচ্ছে বিক্ষিপ্ত অশান্তি। ৪ সেপ্টেম্বর শ্যামবাজারে রাত দখলের কর্মসূচিতে মৃত চিকিৎসকের প্রতি সুবিচারের দাবিতে পা মেলাতে গিয়ে একজন নারীই হলেন অসম্মানিত, লাঞ্ছিত! তাতে প্রশ্ন উঠল নাগরিক সমাজের আড়ালে ‘ওরা’ কারা? তাল কেটেছে আরও কিছু বিক্ষিপ্ত ঘটনায়। গড়িয়ায় পুলিস কর্মীদের মারধর করার অভিযোগও উঠেছে আন্দোলনকারীদের বিরুদ্ধে। তাল কেটেছে মাথাভাঙায়, বারাসতে। ডাক্তার ও নাগরিকদের আন্দোলনে কোনওরকম অশান্তি না করতে কড়া বার্তা দিয়েছিল শাসকদলের শীর্ষ নেতৃত্ব। অথচ কোচবিহারের মাথাভাঙায় সেই শাসকদলের লোকজনের বিরুদ্ধেই আন্দোলনকারীদের উপর হামলার অভিযোগ ওঠে। পুলিস অবশ্য ব্যবস্থাও নেয়। একইভাবে শান্তিপূর্ণ আন্দোলনে কোনও বাধা সৃষ্টি না করতে পুলিসকে নির্দেশ দিয়েছিল আদালত। অথচ ৪ সেপ্টেম্বরের রাতে বারাসতে সেই পুলিসের বিরুদ্ধেই আন্দোলনকারীদের মারধর করে গ্রেপ্তারের অভিযোগ উঠেছে! নিঃসন্দেহে এসব ঘটনা অনভিপ্রেত। না হলেই শাসক ও পুলিসের মুখ উজ্জ্বল হতো।
আসলে এই অনভিপ্রেত ঘটনার তালিকা যেন দীর্ঘ হচ্ছে। খবরে প্রকাশ, সেই রাতে শ্যামবাজারে জনতার স্রোতে মিশে থাকা একদল মানুষ বাংলার এক প্রতিভাময়ী অভিনেত্রীকে রীতিমতো হেনস্তা করেছে। প্রায় প্রাণ হাতে করে তাঁকে ঘটনাস্থল ছাড়তে হয়েছে। নারীর সম্মান, নিরাপত্তা ও অধিকারের দাবিতে যে আন্দোলন, তার জঠর থেকেই কি না নারী বিদ্বেষের এমন কদর্য আস্ফালন! খবর আরও, শহরের অন্যত্র আন্দোলনরত দুই অভিনেত্রীর হাসিমুখের ছবি নিয়ে বিদ্রুপ, কটাক্ষে সোশ্যাল মিডিয়ার দেওয়াল ভরিয়ে তুলেছে নাগরিকদেরই একাংশ। দুর্ভাগ্যের এখানেই শেষ নয়। সম্পূর্ণ ‘অরাজনৈতিক’ নাগরিক আন্দোলনের কণ্ঠে অহরহ শোনা যাচ্ছে মুখ্যমন্ত্রীর পদত্যাগ, সরকার ফেলে দেওয়ার হুমকি। আকাশ কাঁপিয়ে উঠছে ‘আজাদি’-র স্লোগান। শ্যামবাজারেই জনতার ভিড়ে পোড়ানো হয়েছে শাসক তৃণমূল দলের পতাকা। কোনও বিতর্ক ছাড়া বলা যায়, এসব রাজনৈতিক কারবারিদের চেনা কাজ। আরও সোজা ভাষায় বললে, এই পরিস্থিতিকে শাসকের বিরুদ্ধে কাজে লাগাতে প্রায় সব বিরোধী দলই দলীয় পতাকা আস্তিনে গুটিয়ে ভিড়ের মধ্যে মিশে থেকে নিজেদের এজেন্ডা চরিতার্থ করার চেষ্টা করছে। দখল নিতে চাইছে নাগরিক আন্দোলন। অভিযোগ উঠেছে, শান্তিপূর্ণ আন্দোলনের নামে যাদবপুর বা বারাসতে পুলিসকে হেনস্তাও করা হয়েছে।
এই আন্দোলন কি স্বাধীনতার আন্দোলন? তাহলে কেন ‘আজাদি’র স্লোগান উঠছে? মুখ্যমন্ত্রীর পদত্যাগ বা সরকার ফেলে দেওয়ার ডাক দিয়েছে রাম-বামের দল। সেই দাবি কেন অরাজনৈতিক মঞ্চের আন্দোলনে শোনা যাচ্ছে? শ্যামবাজারে অভিনেত্রীকে হেনস্তাকারীদের অনেকে নাকি মদ্যপ ছিল! ভয়ঙ্কর অভিযোগ। প্রশ্ন উঠেছে, যাঁরা সেই মদ্যপদের পাশে দীর্ঘপথ হাঁটলেন তাঁরা কেউ এর (গন্ধ) পেলেন না? কেউ কি মদ্যপদের পথ হাঁটার বিরোধিতা করেছেন? প্রশ্ন হল, এইসব অনভিপ্রেত ঘটনার দায় কার? পুলিস কি স্লোগানকারীদের গলা চেপে ধরবে? হাজারো মানুষের মধ্যে মদ্যপ খুঁজে বেড়াবে? নাকি ভিড়ের মধ্যে কেউ হেনস্তা হলে বাধা দিতে গিয়ে নতুন কোনও অনভিপ্রেত পরিস্থিতি তৈরি করবে? দেখা যাচ্ছে, রাজনৈতিক দলের নেতা-নেত্রীরাও এইসব ঘটনা দেখেশুনে খুব বেশি রা কাটছেন না! পাছে ঝুলি থেকে বেড়াল বেরিয়ে পড়ে। তাই বলা যায়, বিচার চেয়ে আন্দোলন চলুক, কিন্তু শুভবুদ্ধিসম্পন্ন নাগরিক সমাজ নিজেরাই এর রাশ টানতে না পারলে এই আন্দোলন ব্যুমেরাং হতে পারে।