ব্যবসায় অগ্রগতি ও শুভত্ব বৃদ্ধি। ব্যয়ের চাপ থাকায় সঞ্চয়ে বাধা থাকবে। গলা ও বাতের সমস্যায় ... বিশদ
এ ভারত আর জাগে না।’
এই লেখা জীবনের প্রথম উপন্যাস ‘শোভনা’তে যিনি লিখেছিলেন, তিনি হলেন ভারতের স্বাধীনতা সংগ্রামের অন্যতম মহান নেতা বিপ্লবী বিপিনচন্দ্র পাল। ১৮৫৮ সালের ৭ নভেম্বর শ্রীহট্ট জেলার হবিগঞ্জের পইল গ্রামে তাঁর জন্ম। বাবা রামচন্দ্র পাল ও মা নারায়ণী দেবী। রামচন্দ্র ছিলেন মাঝারি জমিদার, সেইসঙ্গে ঢাকার সাব-জজ কোর্টের পেশকার ও পরবর্তীকালে আইনজীবী। তিনি এতটাই শিক্ষানুরাগী ছিলেন যে, নিজের বাড়িতে রেখে বহু ছাত্রদের উচ্চশিক্ষার ব্যবস্থা করে দিতেন। আর নারায়ণী দেবী সেই সব ছাত্রদের মাতৃস্নেহে যত্ন করতেন। তাই উত্তরাধিকার সূত্রেই বিপিনচন্দ্র পড়াশোনা যেমন ভালোবাসতেন, তেমনই ছিলেন সংবেদনশীল মনের।
বিপিনচন্দ্রের পড়াশোনা শুরু হয় মৌলবীর কাছে। পরে ভর্তি হন সিলেট গভর্নমেন্ট স্কুলে। ছেলেবেলায় খেলাধুলোর বদলে তাঁর মন পড়ে থাকত লেখাপড়ায়। ভালোবাসতেন মনীষী ও সাহিত্যিকদের বই পড়তে। প্রবেশিকা পরীক্ষায় স্কলারশিপ পেয়ে পাশ করে আইএ ক্লাসে ভর্তি হন কলকাতার প্রেসিডেন্সি কলেজে। কলকাতায় ছাত্রাবস্থাতেই তাঁর ব্রাহ্মসমাজে যাতায়াত শুরু হয়। ১৮৭৭ সালে শিবনাথ শাস্ত্রীর অনুপ্রেরণায় তিনি ব্রাহ্মধর্মে দীক্ষা নেওয়ায় বাবা তাঁকে ত্যাজ্যপুত্র করেন। ফলে জীবিকার জন্য তাঁকে ১৮৭৯ সালে কটকের একটি স্কুলে প্রধানশিক্ষকের চাকরি নিতে হয়। মতের অমিল হওয়ায় সে চাকরি ছেড়েও দেন কিছুদিন পর। স্বাধীনচেতা বিপিনচন্দ্র মতের অমিল হলেই চাকরি ছেড়ে দিতে কোনওদিনও কুণ্ঠা বোধ করেননি। সারাজীবনে তিনি কটক, শ্রীহট্ট, কলকাতা, মাদ্রাজ বহু স্থানেই শিক্ষকতা করেছেন। ১৮৮০ সালে সিলেটের ন্যাশনাল ইনস্টিটিউটকে তিনি অবিভক্ত ভারতের প্রথম জাতীয় প্রতিষ্ঠান শ্রীহট্ট জাতীয় বিদ্যালয়ে রূপান্তরিত করেন ও সেখানে প্রধানশিক্ষক হিসেবে কাজ শুরু করেন।
১৮৮৭ সাল থেকেই রাজনৈতিক আবর্তে জড়িয়ে পড়তে শুরু করেন বিপিনচন্দ্র। জাতীয় মহাসমিতির তৃতীয় অধিবেশন ডাকা হয় মাদ্রাজে। সেখানে তিনি প্রতিনিধিত্ব করেন এবং অস্ত্র আইন প্রত্যাহারের দাবি সমর্থন করে বক্তৃতাও দেন। ১৮৯৮ সালে বৃত্তি পেয়ে তুলনামূলক ধর্মতত্ত্ব পড়ার জন্য বিলেত গিয়ে এক বছর অক্সফোর্ডে থাকেন। ভারতে ফিরে ১৯০১ সালে প্রকাশ করেন একটি ইংরেজি সাপ্তাহিক পত্রিকা ‘নিউ ইন্ডিয়া’।
দেশে তখন জাতীয়তাবাদী আন্দোলন নতুন পথ খুঁজে পেয়েছে। রাষ্ট্রগুরু সুরেন্দ্রনাথ বন্দ্যোপাধ্যায়ের অনুগামী হয়ে ১৯০৫ সালের বঙ্গভঙ্গ বিরোধী আন্দোলনে যোগ দিয়ে বিভিন্ন সভায় বিপিনচন্দ্র তাঁর জ্বালাময়ী বক্তৃতার মাধ্যমে জাতিকে উদ্বুদ্ধ করতে শুরু করলেন। চারদিকে শুরু হল জনসভা, মিছিল, বিলিতি কাপড় পোড়ানোর বহ্নি উৎসব। ১৯০৬ সালে প্রকাশিত হল ইংরেজি দৈনিক ‘বন্দেমাতরম’। যার প্রথম সম্পাদক হন বিপিনচন্দ্র। ‘বন্দেমাতরম’ পত্রিকায় বিপিনচন্দ্র লিখেছিলেন, ‘...আমরা যদি সরকারকে কোনওরূপ সাহায্য করতে অস্বীকৃত হই তাহলে একদিনেই শাসনতন্ত্র অচল হয়ে পড়বে।’ ১৯০৭ সালে মাদ্রাজে যে বক্তৃতা বিপিনচন্দ্র দেন, তাতে সারা দেশে এমন এক জাগরণের সৃষ্টি হয় যে, ভীত ব্রিটিশ সরকার একদিকে শুরু করল দমন-পীড়ন এবং অন্যদিকে সেক্রেটারি অব স্টেট ও বড়লাট তৎপর হয়ে উঠলেন বিপিনচন্দ্রকে গ্রেপ্তার করতে!
মুরারিপুকুর বাগানে বোমার কারখানা আবিষ্কৃত হল। গ্রেপ্তার হলেন বিপ্লবী অরবিন্দ ঘোষ। তাঁর বিরুদ্ধে রাজদ্রোহিতার মামলা শুরু হল। ‘বন্দেমাতরম’ পত্রিকার সম্পাদক হিসেবে বিপিনচন্দ্রকে সাক্ষ্য দিতে আনা হল কোর্টে। তিনি সত্যকথা বললেই অরবিন্দ ঘোষের জেল নিশ্চিত। কিন্তু বিপিনচন্দ্র সাক্ষ্য দিতে উঠে নীরব রইলেন। ফলে আদালত অবমাননার দায়ে তাঁর নিজেরই জেল হল!
১৯০৮ সালে আবার তিনি বিলেত যান। ‘স্বরাজ’ ও ‘ইন্ডিয়ান স্টুডেন্ট’ নামে সেখানে দু’টি পত্রিকা প্রকাশ করেন। ‘স্বরাজ’ পত্রিকায় তাঁর ‘দ্য এটিওলজি অব দ্য বম্ব ইন বেঙ্গল’ প্রবন্ধের জন্য ১৯১১ সালে বম্বে পৌঁছনো মাত্র তাঁকে গ্রেপ্তার করা হয়! জেল থেকে বেরনোর পর তাঁর সংবর্ধনা সভায় সঙ্গীত রচনা করে দ্বিজেন্দ্রলাল রায় গেয়েছিলেন, ‘বঙ্গ আমার জননী আমার ধাত্রী আমার আমার দেশ...’।
উনিশ শতকের শুরুতে যে জাতীয়তাবাদী ঢেউ উঠেছিল, তার পুরোধা ছিলেন স্বাধীনতা সংগ্রামের চরমপন্থী ত্রয়ী। ইতিহাস যাঁদের ‘লাল-বাল- পাল’ নামে চিরস্মরণীয় করে রেখেছে। তাঁরা হলেন পাঞ্জাবের লালা লাজপত রায়, মহারাষ্ট্রের বালগঙ্গাধর তিলক ও বাংলার বিপিনচন্দ্র পাল! লোকমান্য তিলকের ‘হোমরুল আন্দোলন’-এ বিপিনচন্দ্র যোগ দিয়েছিলেন। তাঁরা ছিলেন পূর্ণ স্বরাজ ও বয়কট আন্দোলনের প্রবর্তক।
বিভিন্ন পত্রিকা সম্পাদনার পাশাপাশি অসংখ্য বই লিখেছেন সুসাহিত্যিক বিপিনচন্দ্র। যার মধ্যে উল্লেখযোগ্য ‘শোভনা’,‘ভারত সীমান্তে রুশ’, ‘সত্তর বৎসর’, ‘জেলের খাতা’, ‘স্বরাজ অ্যান্ড দ্য প্রেজেন্ট সিচ্যুয়েশন’, ‘ইন্ডিয়ান ন্যাশনালিজম’ প্রভৃতি। বিপিনচন্দ্র ছিলেন নারীশিক্ষা প্রচলনের প্রবক্তা। জাতীয়তাবাদী নেতা চিদম্বরম পিল্লাই বিপিনচন্দ্রকে ‘স্বাধীনতার সিংহ’ নামে যথার্থই অভিহিত করেছিলেন!
১৯৩২ সালের ২০ মে প্রয়াণ হয় এই মহান বিপ্লবীর।