ব্যবসায় অগ্রগতি ও শুভত্ব বৃদ্ধি। ব্যয়ের চাপ থাকায় সঞ্চয়ে বাধা থাকবে। গলা ও বাতের সমস্যায় ... বিশদ
তিনি শিশুদের মোটেই ছোট বলে ভাবতেন না। তিনি বাচ্চাদের গুরুত্ব দিতেন। একথা বোঝা যায় তাঁর লেখা বই— ‘লেটারস ফ্রম এ ফাদার টু হিজ ডটার’ পড়লেই। আমরা জানি, জওহরলাল নেহরুর মেয়ের নাম ইন্দিরা গান্ধী। যিনি ছিলেন ভারতের তৃতীয় প্রধানমন্ত্রী। ইন্দিরা গান্ধীই একমাত্র মহিলা যিনি ভারতের প্রধানমন্ত্রী হয়েছিলেন। অনেকেই মনে করেন, পণ্ডিত নেহরুর শিক্ষাদানের ধরনই ছিল একেবারে আলাদা। এই কারণেই ইন্দিরা গান্ধী এত বড় মানুষ হতে পেরেছিলেন। ১৯২৮ সাল। দেশের স্বাধীনতা আন্দোলনে জড়িয়ে পড়েন জওহরলাল নেহরু। ফলে ব্রিটিশ পুলিসের হাতে গ্রেপ্তার হতে হয় তাঁকে। এলাহাবাদ জেলে তাঁকে বন্দি করে রাখা হয়।ইন্দিরার বয়স তখন ১০ বছর। ছোট্ট মেয়েটি তখন ছিল এলাহাবাদ থেকে অনেক দূরে, উত্তরখণ্ডের দেরাদুন জেলার শৈলশহর মুসৌরিতে।বাবার মনে পড়ত মেয়ের কথা। মেয়ের মনে পড়ত বাবার কথা। মেয়ে যাতে নিঃসঙ্গ বোধ না করে, তাই ইন্দিরাকে চিঠি লিখতে শুরু করেন নেহরুজি। অনেকগুলি চিঠির মধ্যে আলাদা করে ৩০টি চিঠি নিয়ে ১৯২৯ সালে প্রকাশিত হয়েছিল সেই বই।সেই চিঠি কিংবা সেই বইয়ে শুধু স্নেহকথা লেখা ছিল না। বরং প্রতিটি চিঠি ছিল এক একটা জাদুকাঠি! প্রতিটি চিঠিতে লেখা ছিল এই পৃথিবীকে চিনে নেওয়ার কৌশল। জাতি-ধর্ম নির্বিশেষে মানুষের সঙ্গে মিশে যাওয়ার উপায়। মানুষের মতো একখানি মানুষ এবং যোগ্য নেতা হওয়ার পাঠ। কেমন ছিল সেই চিঠি? দেখা যাক— প্রথম চিঠিখানির শুরুতেই ছোট্ট ইন্দিরাকে তিনি জানাচ্ছেন, আমাদের এই পৃথিবী মানে একখানি দেশ নয়। একাধিক দেশ নিয়ে গড়ে উঠেছে পৃথিবী। সেই সব দেশেও রয়েছে আলাদা জাতি, আলাদা সংস্কৃতি। একইসঙ্গে তিনি কথায় কথায় জানাচ্ছেন, পাথর, পাহাড়, উপত্যকা, নদী, সমুদ্র আগ্নেয়গিরির কথা। তিনি বলছেন, একদিনে কিন্তু এই বিপুল প্রাণীজগৎ গড়ে ওঠেনি। বরং ধীরে ধীরে পৃথিবীতে হয়েছে প্রাণের বিকাশ। আসলে তিনি বোঝাতে চাইছেন— পৃথিবীতে এত বিচিত্র ধরনের জীব থাকলেও আসলে শুরু কোনও এক জায়গা থেকেই! একটি চিঠিতে তিনি মেয়েকে এও বলছেন— ‘এই মস্ত পৃথিবীটা যেন একটা দেশ। আর তার সব জাতের মানুষই আমাদের ভাইবোন।’ অর্থাৎ ওই এক কথাতেই তিনি ছোট্ট ইন্দিরাকে গোটা পৃথিবীর সঙ্গে জুড়ে দিলেন। তিনি বলছেন, পৃথিবীর ইতিহাস জানতে হবে। জানতে হবে কীভাবে হয় পরিবর্তন। তিনি মেয়েকে জানাচ্ছেন নানা জীবাশ্মর কথা! ক্রমশ তাঁর চিঠিগুলি হয়ে পড়ছে আরও মজাদার। দ্বিতীয় চিঠির একটা জায়গায় তিনি ‘চিন্তা’ বা ‘ভাবনা’র জোরের কথা বলছেন। তিনি জানাচ্ছেন, হাতি কত বলবান আর আকারে কত বড়! হাতির তুলনায় মানুষ আকারে ছোট! অথচ এই মানুষই হাতির পিঠে চড়ে ঘুরে-বেড়ায়। অর্থাৎ তিনি বোঝাতে চাইছেন, নিজের বুদ্ধি এবং মস্তিষ্কের উপর ভরসা রাখতে। আসলে বড় বড় সমস্যার সামাধানও ভাবনাচিন্তা করে বের করে ফেলা যায়।যত বাড়ছে চিঠির সংখ্যা, ততই যেন ইন্দিরার সামনে খুলে যাচ্ছে বিরাট এক দুনিয়া। বাবার কাছে জানতে পারছে ছোট্ট মেয়েটি, সৌরজগৎ সম্পর্কে, জানতে পারছে চাঁদের উৎপত্তি সম্পর্কে! জানা যাচ্ছে বিভিন্ন প্রাণীর বিবর্তন! কীভাবে জলের প্রাণীরা স্থলে কিংবা ডাঙায় হেঁটে বেড়ানো প্রাণীরা যাচ্ছে জলে! কীভাবে ধীরে ধীরে মানুষ দলবদ্ধ হতে শিখল। কীভাবেই বা মানুষ শিখল পাথরের অস্ত্র এবং দলবদ্ধ হয়ে কাজ করার পদ্ধতি। তিনি বুঝিয়ে দিলেন, মানুষ একা একা দুর্বল। তবে গোষ্ঠী হিসেবে কাজ করলেই মানুষ শক্তিশালী!এই প্রসঙ্গে ৮ নম্বর চিঠিখানি অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। কারণ এই একবিংশ শতাব্দীতেও দেখতে পাওয়া যায়— মানুষ মানুষকে তার গায়ের রং ও জাতের কথা তুলে ঠাট্টা করছে। নিচু করার চেষ্টা করছে। অথচ নেহরু প্রায় ৯০ বছর আগে মেয়েকে লিখেছেন—‘নব্যপ্রস্তর যুগের মানুষ অনেকটাই উন্নত হয়েছিল। তারা ঘর বাঁধতে শিখেছিল। কৃষি এবং রান্নার উদ্ভাবন করেছিল। করত পশুপালন।...পৃথিবীতে এখন যে সব বিভিন্ন জাতির মানুষ আছে, তাঁদের বেশিরভাগই এই যুগের মানুষের বংশধর।...পৃথিবীতে আজকাল আমরা যত মানুষ দেখছি— তাদের কেউ শ্বেত, কেউ পীত, কেউ বাদামি, কেউ কালো।...এসব জাতির সৃষ্টি হল কেমন করে। তারা যদি একই মানুষের বংশধর তবে আজকের দিনে তাদের মধ্যে এত বিভিন্নতা কেন?’ পণ্ডিত নেহরু কিন্তু এই বিভিন্নতার জন্য বিবর্তনকেই দায়ী করছেন। তিনি মেয়েকে জানাচ্ছেন— ‘নিজেদের পারিপার্শ্বিকের উপযোগী করবার জন্য কেমন কেমন করে যে ক্রমে ক্রমে প্রাণীর আকারের পরিবর্তন ঘটে সেকথা তোমাকে আগেই বলেছি।’ অর্থাৎ তিনি বলছেন, সকল মানুষের উৎপত্তি এক জাতি থেকেই। যেটুকু পরিবর্তন হয়েছে তা পরিবেশের সঙ্গে মানিয়ে নেওয়ার জন্যই। তিনি আসলে ছোট্ট ইন্দিরাকে বোঝাতে চাইছেন, আমরা আসলে বিনা কারণেই নিজেদের মধ্যে ভেদাভেদ করি। আসলে আমাদের সৃষ্টি হয়তো একটি মাত্র জাতি থেকেই। এই প্রসঙ্গে তিনি ভাষাগত মিলের কথাও বলছেন ১০ নম্বর চিঠিতে—‘দেখতে ভাষাগুলো এত ভিন্ন হলেও তাদের মধ্যে কতকগুলি একই রকমের শব্দ...। ইংরেজি শব্দ— ‘Father’ ‘Mother’ হিন্দি ও সংস্কৃতে এদের বলা হয় ‘পিতা’ ‘মাতা’। লাতিনে ‘Pater’ ‘Mater’, গ্রিকে ‘Pater’ ‘meter’, জার্মান ভাষায় ‘Vater’(উচ্চারণ Fater) ‘Mutter’, ফরাসিতে ‘Pere’ ‘Mere’ বলা হয়। অন্যান্য অনেক ভাষাতেও ঠিক এমনি ধারা শব্দই রয়েছে।’ অর্থাৎ তিনি বোঝাতে চাইছেন— মানুষ প্রথম যেদিন থেকে কথা বলতে শিখেছে, পিতা-মাতাকে বুঝাবার জন্য দুটো শব্দও সেদিন থেকেই সৃষ্টি হয়েছে।...এই শব্দ দুটো একই পরিবার আর একই পূর্বপুরুষদের কাছ থেকে চলে এসেছে। একদা তাদের পূর্বপুরুষরা সকলেই ছিল একই পরিবারের। এভাবেই বারবার তিনি শিশুকন্যার মনে মানুষে মানুষে ভেদাভেদ ঘুচিয়ে দিয়েছেন। এই সব কারণেই তাঁর লেখা বইটি সকলেরই একবার পড়া উচিত। কারণ বইটি মনের গঠন তৈরি করে দেয়। জাতিভেদ, ধর্মভেদ, বর্ণভেদ ভুলে যাওয়ার কথা বলে। ফলে একজন সাধারণ মানুষ আর শুধু নিজের দেশের গণ্ডিতে আটকে থাকে না। ক্রমশ হয়ে ওঠে বিশ্বনাগরিক। গোটা পৃথিবীর মানুষ হয়ে ওঠে একে অপরের ভাই-বোন। তাই একে অপরের দুঃখ কষ্ট মোচনে ঝাঁপিয়ে পড়ে। শিশু দিবসে আমরাও তো তাই চাই। সকল শিশুর মুখে যেন ফুটে থাকে হাসি। কোনও শিশু যেন কষ্টে না থাকে। তাই না?