কর্মপ্রার্থীদের ধৈর্য্য ধরতে হবে। প্রেম-প্রণয়ে আগ্রহ বাড়বে। নিকটস্থানীয় কারও প্রতি আকর্ষণ বাড়বে। পুরোনো কোনও বন্ধুর ... বিশদ
বেথুন সাহেব তো বিদ্যাসাগর ও তাঁর অনুরাগীদের চোখের জলে ভাসিয়ে বিদায় নিলেন। তাঁর জায়গায় সভাপতি হয়ে এলেন সে সময়ের হোম ডিপার্টমেন্টের সেক্রেটারি সিসিল বিডন সাহেব। বিদ্যাসাগর মশায় আগের মতোই যেমন অবৈতনিক অ্যাসিস্ট্যান্ট সেক্রেটারি ছিলেন— সেই পদেই রইলেন। দু’জনের চেষ্টায় মেয়েদের এই স্কুলের উন্নতি হতে লাগল। এমনকী যাঁরা বিরোধী ছিলেন, তাঁদেরও ডেকে একটা কমিটি করে দিয়ে এমন করে বোঝানো হল যে, তাঁরা অনেকটাই পক্ষে এলেন— বাড়ির মেয়েদের স্কুলে পাঠাতে লাগলেন।
অন্যদিকে সংস্কৃত কলেজের উন্নতির জন্য, সংস্কৃত শিক্ষার প্রসারের জন্যেও নানা বইপত্তর লেখার উদ্যোগ নিলেন বিদ্যাসাগর। যেমন চেম্বার্সের লেখা ইংরেজি ‘মর্যাল ক্লাসবুক’ বইটির ‘নীতিবোধ’ নাম দিয়ে বেশখানিকটা অনুবাদ করলেন। তবে সবটা তিনি করে উঠতে পারলেন না বলে বন্ধু রাজকৃষ্ণ বন্দ্যোপাধ্যায়কে বাকিটা শেষ করার দায়িত্ব দিলেন। বই প্রকাশ হলে তার বিজ্ঞাপনে তিনি লিখলেন ‘এ স্থলে ইহাও উল্লেখ করা আবশ্যক যে, তিনিই প্রথমে এই পুস্তক লিখিতে আরম্ভ করেন। ...কিন্তু তাঁহার অবকাশ না থাকাতে তিনি আমার প্রতি এই পুস্তক প্রস্তুত করিবার ভারার্পণ করেন।’
এমনই একে একে ‘সীতার বনবাস’, ‘শকুন্তলা’, ‘উপক্রমণিকা’ প্রভৃতি বই শিক্ষা বিস্তারের কথা ভেবে লিখতে শুরু করলেন বিদ্যাসাগর। এর মধ্যে একটা কাণ্ড ঘটে গেল। অবসর পেলেই তিনি বীরসিংহাতে চলে আসেন। যাওয়ার পথে মাঝে মাঝে শিয়াখালায় রাত কাটিয়ে পরের দিন বাড়ির উদ্দেশে রওনা হন। যে কটা দিন বীরসিংহায় থাকেন গরিব মানুষদের কী আনন্দ! বিদ্যাসাগর কাপড়ের কোঁচার খুঁটে পয়সা-টাকা বেঁধে যার যতটুকু প্রয়োজন বুঝতেন— সবাইকে দান করতেন। এটা তাঁর একটা অভ্যাসে পরিণত হয়ে গিয়েছিল। এতে চারপাশের মানুষজন, এমনকী চোর-ডাকাতদেরও মনে একটা ধারণা হয়ে গিয়েছিল যে, লোকটা খুব ধনী হয়ে উঠেছেন এবং একদল ডাকাত এই ‘ধনী’ (যে ধনে হইয়া ধনী মণিরে মানে না মণি— বিদ্যাসাগর তো সেই অর্থে ধনী অবশ্যই) মানুষটার বাড়িতে রে রে করে চড়াও হল। তাদের ভীষণ নিনাদে অন্যেরা তো দূরের কথা, বিদ্যাসাগর পর্যন্ত প্রাণভয়ে খিড়কি পথে পালিয়ে গেলেন। কিছু কাঁচা টাকা পেল তারা বটে, কিন্তু ভাঙাচোরা কিছু বাসনপত্তর, পরনের কাপড় ছাড়া তাদের কপালে বেশি কিছু জোটেনি।
ঠাকুরদাস সেই রাতেই ঘাটাল থানায় চুরির খবর দিলেন। পরের দিন সকালে থানাদার এলেন সদলে। এসেই বড় ‘গোল’ বাধালেন। অর্থাৎ কিছু না দিলে তো তদন্ত করা যাবে না। ঠাকুরদাস— সেই তেজস্বী মানুষটি তাঁকে বললেন, ‘দেখুন, আপনি কুলীন বামুন বলে যেটুকু খাতির করার আমি করেছি, কিন্তু টাকাপয়সার আশা ছাড়ুন।’ একজন সেপাই তাঁর অফিসারকে বললেন, ‘বাবু, এর যে ব্যাটা আছে, তাঁকে মেদিনীপুরের ম্যাজিস্ট্রেট সাহেব পর্যন্ত খাতির করেন। সাহেবরা তাঁর সঙ্গে ওঠাবসা করেন।’ শুনে থানাদার একটু ঘাবড়ালেন বটে, তবে চুরির কিনারা কিছু করলেন না। তবে, একটা অভিজ্ঞতা তাঁর হল বটে। দেখলেন, এই বাড়ির বড় ছেলেটা, বয়স তো হয়েছে, পাড়ার ছেলেদের সঙ্গে মিলে দিন-দুনিয়া, চুরি-ডাকাতি ভুলে চুটিয়ে কপাটি (কাবাডি?) খেলছে! পরের দুঃখে যিনি সদাই কাতর, আপন দুঃখে তিনি সদা প্রফুল্ল। ছোট ভাই ঈশান আর নিজের ছেলে অর্থাৎ একমাত্র নাতিকে খুব আদর করছেন দেখে না হলে নিরামিষাশি বাবা ঠাকুরদাসকে বলতে পারেন, ‘বাবা, আপনি ঈশান আর নারাণের যেমন করে মাথা খাচ্ছেন, তাতে আর নিজেকে লোকের কাছে নিরামিষভোজী বলে পরিচয় দেবেন না।’
বাড়ি থেকে ফিরে এসে সংস্কৃত কলেজের সার্বিক উন্নয়নের কাজে মনোনিবেশ করলেন। লোকে তাঁকে জানেন বিধবা বিবাহ আর বাল্য বিবাহ নিয়েই তিনি সমাজ সংস্কারের কাজে লেগেছিলেন, শিক্ষা সংস্কারও খানিকটা তো সামাজিক কাজ, কিন্তু তিনি জাতিভেদ প্রথারও যে কতখানি বিরোধী ছিলেন— তার কথা আমরা ভাবি না। সংস্কৃত কলেজে তখন কেবল ব্রাহ্মণ এবং বৈদ্যেরা পড়ার সুযোগ পেতেন। এঁদের মধ্যে যাঁরা বৈদ্য শ্রেণীর ছিলেন তাঁরা অন্য সব বিষয় পড়তে পেলেও বেদান্ত ও ধর্মশাস্ত্র পড়তে পেতেন না। যাঁদের শূদ্র বলা হতো তাঁদের ছেলেরা সংস্কৃত কলেজে ভর্তিই হতে পেতেন না। বিদ্যাসাগর বাঁড়ুজ্যে বংশের ছেলে। কিন্তু শিক্ষার ক্ষেত্রে এই জাতি ব্যবস্থা মানতে নারাজ। তিনি শিক্ষা বিভাগে রিপোর্ট করে এই অবাঞ্ছিত বিভেদ তুলে দিয়ে সংস্কৃত কলেজকে সর্বশ্রেণীর মানুষের কাছে খুলে দিতে চাইলেন। অমনি চারপাশ থেকে সমালোচনার ঝড় বইতে লাগল, ‘জাত গেল, জাত গেল’ বলে শোর তুলে!
অমনি বিদ্যাসাগর মশায় মোক্ষম অস্ত্রটি ছুঁড়ে দিলেন। বললেন, তাহলে বামুনের পো-রা কী করে সাহেবদের সংস্কৃত শেখান? ফর্সা রং আর টাকাপয়সা ভালো দেয় বলে? সাহেবরা কি নৈকষ্য-কুলীন? এছাড়া সংস্কৃত কলেজে ব্রাহ্মণ-বৈদ্য শিক্ষার্থীদের কোনও বেতন দিতে হতো না। বিদ্যাসাগর বললেন, বিনা ‘মূল্যে’ বিদ্যা বিতরণ করা যাবে না, তাঁদের মাইনে দিতে হবে। সেটাই চালু করে ছাড়লেন। এঁড়ে বাছুর গোঁ ছাড়ে না!
এই গোঁ দেখা দিয়েছিল তখনও, যখন মনে মনে ঠিক করেছিলেন তারানাথ তর্কবাচস্পতিকে একটা চাকরি করে দেবেনই। এ সময়ে সংস্কৃত কলেজে ব্যাকরণের একটি পদ শূন্য হলে বিদ্যাসাগর মশায়কে ৮০ টাকা বেতনের চাকরিটাকে গ্রহণ করার জন্য মার্শেল সাহেব অনুরোধ করলে, নিজের চেয়েও বাচস্পতি মশায়কে ওই পদে উপযুক্ত মনে করে মার্শেল সাহেবকে লিখলেন, ‘আপনার অনুগ্রহ থাকলেই আমি খুশি, আমি চাকরি চাই না।’ তারপরে বাচস্পতির চাকরির জন্যে লেগে পড়লেন এবং সার্থক হলেন।
তাঁর দয়া সর্বব্যাপিনী। একবার তাঁর এক পড়শির বালক-ভৃত্যের কলেরা হলে তিনি তাকে ধরে টেনে নিয়ে বাড়ির বাইরে ফেলে রাখেন। বিদ্যাসাগর মশায় খবর পেয়ে তাকে ধরে এনে নিজের বিছানায় শুইয়ে দিয়ে তার জামাকাপড় বদলে নিজের কাপড় পরিয়ে তিন দিন ধরে দিনরাত সেবা করে রোগমুক্ত করেন। উদাহরণ দিতে গেলে রাত কাবার হয়ে যাবে। তাঁর দয়া দেশি-বিদেশি, হাড়ি-বামুন বিচার করত না। তাই ইয়ং গর্ডন নামে এক সাহেবকে পাবলিক ইনস্টিটিউশন (আগের এডুকেশন কাউন্সিল)-এর ডিরেক্টর পদে নিয়োগ করা হলে হেলিডে সাহেবকে তিনি বলেন যে, এ লোকটা অপদার্থ, না জানে পড়াতে, না জানে কোনও কাজ। একে দিয়ে এত বড় দায়িত্বের পদ সামলানো খুব মুশকিল। হেলিডে শুনে বিদ্যাসাগরকে বললেন, তুমিই ওকে শিখিয়ে-পড়িয়ে গড়ে নাও। তো সাহেব বলে তাকে অবহেলা না করে গর্ডনকে গাইড করে গড়ে তুললেন তিনি।
এবার নজর দিলেন বীরসিংহায় শিক্ষা বিস্তারের কাজে। ঠাকুরদাসের বড় ইচ্ছে গ্রামে একটা ভালো টোল খুলে পড়ানোর ব্যবস্থা করুক তাঁর বড় ব্যাটা। এখন তাঁর মোটা মাইনে, জমি কেনা হল। বাড়ির বনেদ পত্তনের দিনে মজুর আসেনি দেখে নিজেই কোদাল দিয়ে মাটি কাটতে লাগলেন। বাড়ি তৈরি হল। মাস্টারমশায় নিযুক্ত হলেন। নিজের বাল্যশিক্ষক কালীকান্ত চট্টোপাধ্যায়কে ভোলেননি, তাঁকে সেই টোলের শিক্ষক নিযুক্ত করে দিলেন। এরপরে আশপাশের গ্রামগুলোতে কত যে বিদ্যালয় স্থাপন করলেন! এবারে কিন্তু ছাত্ররা পড়তে লাগল বিনা বেতনেই। (ক্রমশ)