কর্মপ্রার্থীদের ধৈর্য্য ধরতে হবে। প্রেম-প্রণয়ে আগ্রহ বাড়বে। নিকটস্থানীয় কারও প্রতি আকর্ষণ বাড়বে। পুরোনো কোনও বন্ধুর ... বিশদ
সভাপতি মলয় ঘোষের কথায় ডানদিকে ঘাড় ঘোরালেন শ্যামাপদবাবু। ওর দশ-বারোটা চেয়ার পরেই হলুদ জামা পরা মাঝবয়সি একজন লোক বসে আছে। ক্ষয়াটে চেহারা। অবিন্যস্ত পোশাকআশাক। গালভর্তি কাঁচাপাকা দাড়ি। সুজনপুরের ভূমিপুত্রটিকে দেখে মনে বিশেষ ভক্তি জাগল না শ্যামাপদবাবুর। হবে হয়তো কোনও হেঁজিপেঁজি! অনেক সময় ক্লাবগুলি যা করে, ডুবন্তকে বাঁচিয়েছে কিংবা আগুনের কবল থেকে কাউকে উদ্ধার করেছে, এমন লোককেও আবেগের বশে সংবর্ধনা জানায়। এই লোকটিও হয়তো সেই গোত্রেরই! তবে মনে যা-ই চলুক না কেন মুখে কিছু বললেন না শ্যামাপদবাবু। আলতো হেসে ঘাড়টা আবার সোজা করলেন।
মঞ্চ সাজানোর শেষ মুহূর্তের প্রস্তুতি চলছে। দু’চার মিনিটের মধ্যেই উদ্বোধনী সঙ্গীত শুরু হবে। নির্ধারিত সময়ের একটু আগেই অনুষ্ঠান-কক্ষে এসে হাজির হয়েছেন শ্যামাপদবাবু। বিখ্যাত শিশুসাহিত্যিক শ্যামাপদ মুখার্জি। তাঁকে সাদরে অভ্যর্থনা জানিয়েছেন কর্মকর্তারা। ক্লাব সভাপতি নিজে এসে তাঁকে বসিয়ে দিয়েছেন এই চেয়ারটায়। এই মুহূর্তে অনেকের সপ্রশংস দৃষ্টি তার দিকে। ইতিমধ্যে দু’জন কিশোরী এসে অটোগ্রাফ নিয়ে গিয়েছে। আরও কয়েকজন নেবে কি না ভেবে উসখুস করছে। সবকিছু নিয়ে বেশ ফুরফুরে মেজাজেই আছেন তিনি। শুধু একটাই খচখচানি ওই হলুদ জামাকে নিয়ে। হেঁজিপেঁজি না হয়ে লোকটা যদি ছুপা রুস্তম হয় তাহলেই সমস্যা। তখন হয়তো পাবলিকের মনোযোগের বেশিরভাগটাই ওই লোকটার দিকে ঢলে পড়বে।
উদ্বোধনী সঙ্গীতের পর মঞ্চে উঠে অবশ্য সে ভুল ভাঙল শ্যামাপদবাবুর। সুজনপুরের জামাই তাঁর পাশের চেয়ারটায় আসীন হয়েই নিচু গলায় বলে উঠল, ‘আমি জানি আপনি খুব মানীগুণী মানুষ সার। আপনার পাশে বসার যোগ্যতা আমার নাই। কিন্তু কী করব, এদের জোরাজুরিতে বসতে হল! এরা বলল আমি নাকি মস্ত এক কাজ করেছি। তাই আমাকে...’
কথা থামিয়ে লজ্জায় নুয়ে পড়ল জামাই। খানিকবাদে থুতনি তুলে মিয়ানো গলায় বলল, ‘হল ভর্তি লোক... লজ্জায় মাটিতে মিশে যেতে ইচ্ছে হচ্ছে সার। আমার মতো নগণ্য একটা লোককে...!’
‘অযোগ্য’, ‘নগণ্য’ এসব শব্দ বেশ স্বস্তিদায়ক। কিন্তু ‘মস্ত একটা কাজ করেছি’ কথাটায় ভুরুতে ভাঁজ পড়ল শ্যামাপদবাবুর। তিনি চান মঞ্চে একেবারে একেশ্বর হয়ে থাকতে। দর্শকদের ফোকাসের পুরোটাই তাঁর দিকে থাকবে। কিন্তু মস্ত কাজ করা জামাই সেটা ভেস্তে দিলেই হ্যাপা!
খানিক বাদেই সংবর্ধিত ব্যক্তিদের নিয়ে বক্তব্য রাখতে শুরু করলেন সঞ্চালিকা। প্রথমেই শ্যামাপদবাবুর প্রসঙ্গ। ক’দিন আগেই নিজের সংক্ষিপ্ত একটা বায়োডাটা ক্লাব কর্তৃপক্ষের হাতে তুলে দিয়েছেন শ্যামাপদবাবু। সেটিকে মাথায় রেখেই তার বক্তব্য রাখছেন সঞ্চালিকা। সুললিত কণ্ঠে বলে চলেছেন— ‘বাংলা শিশুসাহিত্যের উজ্জ্বল নক্ষত্র শ্যামাপদ মুখার্জিকে আজ আমরা আমাদের মধ্যে পেয়েছি। তার উপস্থিতিতে আমরা ধন্য। হীরে মানিকসদৃশ অসাধারণ সব গল্প, উপন্যাসের স্রষ্টা তিনি...’
নিজের প্রশস্তি শুনতে কার না ভালো লাগে। শ্যামাপদবাবুও ঢুলুঢুলু চোখ করে হাসি হাসি মুখে তা শুনতে থাকলেন। খানিকক্ষণ পর তাঁর গৌরবগাথা শেষ হতেই শুরু হল উত্তম মণ্ডলের গুণকীর্তন। সঞ্চালিকা ‘জামাই’ নামটা উচ্চারণ করতেই হাততালিতে ফেটে পড়ল হলঘর। কেউ একজন ‘জিও গুরু’ বলে চিৎকার করেও উঠল। মৃদু একটা ধাক্কা খেলেন শ্যামাপদবাবু। তাঁর বেলা তো এত হাততালি পড়েনি! উচ্ছ্বাসে এমন আলোড়িত হয়নি হলঘর! তাহলে! একবুক শঙ্কা নিয়ে নড়েচড়ে বসলেন তিনি।
সঞ্চালিকা এগিয়ে চলেছেন, ‘উত্তমদা আমাদের সকলের কাছে জামাই নামেই খ্যাত। দীর্ঘদিনের একটা কুঅভ্যাসকে যেভাবে উনি বর্জন করেছেন, তার জন্য কোনও সাধুবাদই যথেষ্ট নয়। ওঁর সুস্থ স্বাভাবিক জীবনে ফিরে আসাটা ছিল আমাদের সকলের চাওয়া। শেষ পর্যন্ত উনি সেটা পেরেছেন। দীর্ঘ কুড়ি বছরের মদের নেশাকে ওয়ান ফাইন মর্নিং জানিয়ে দিয়েছেন গুড বাই!’
নিস্তব্ধ হলঘর সঞ্চালিকার কথা হাঁ করে গিলছে শ্রোতারা। পাশে বসা জামাই এতক্ষণে আড়ষ্টতা কাটিয়ে সোজা হয়ে বসেছে। প্রশংসায় অনেকটাই যেন চনমনে হয়ে উঠেছে লোকটা। সহসা শ্যামাপদবাবুর মনটা কেমন যেন বিষণ্ণ হয়ে উঠল। কোথায় শিশুসাহিত্য আর কোথায় নেশামুক্তি! অর্বাচীন কর্মকর্তাদের দৌলতে শেষ পর্যন্ত তাঁর ঠাঁই হল কিনা একজন প্রাক্তন মাতালের পাশে! অপমান, এ তাঁর বিরাট অপমান!
সঞ্চালিকার বয়ান মোতাবেক ধীরে ধীরে গোটা মানুষটাকেই জানা হয়ে গেল। জামাই একজন ভ্যানরিকশ চালক। স্ত্রী, পুত্র, কন্যা নিয়ে তার চারজনের সংসার। স্ত্রী সেলাই ফোঁড়াইয়ের কাজ করে। স্কুলে পড়ে ছেলেমেয়ে দুটো। মাসখানেক আগেও নেশার কারণে স্ত্রীর সঙ্গে নিত্য অশান্তি হতো জামাইয়ের। তার দরুন পাড়াপ্রতিবেশীদেরও ওষ্ঠাগত প্রাণ। শেষে সমস্যা সমাধানে এগিয়ে এলেন ক্লাব সভাপতি মলয়বাবু। লাগাতার তিনি বোঝাতে থাকলেন জামাইকে। নেশাড়ু উত্তমের দীর্ঘদিনের একটা ক্ষোভ ছিল শ্বশুরবাড়ির উপরে। নেশা করলেই বউকে বলত, ‘আমার মতো শ্বশুর-শাশুড়ি জিন্দেগিতে যেন কারও না হয়। শালা একবারও জামাইষষ্ঠী করল না! এমন হাড় কিপটে!’ শুনেই খেপে যেত ওর বউ। আর তারপরেই শুরু হতো ওদের গজকচ্ছপের যুদ্ধ! ক্ষোভ মেটাতে মাসতিনেক আগে ক্লাবে উত্তমের জামাইষষ্ঠী ঘটা করে পালন করেছেন মলয়বাবু। পরবর্তীকালে তাকে উদ্বুদ্ধ করতে বলেছেন, মদ ছাড়লে ক্লাবের বার্ষিক অনুষ্ঠানে উত্তমকে সংবর্ধনা দেওয়া হবে! ব্যস, ওতেই ফল ফলল। হুট করে একদিন মদটা ছেড়েই দিল জামাই।
জামাইয়ের কাহিনীতে মশগুল শ্রোতারা। শেষ হতেই হাততালির বন্যা। কাণ্ড দেখে আরও ঝিমিয়ে পড়লেন শ্যামাপদবাবু। জামাইবাবাজি শুধু মাতালই নয়, সঙ্গে ভ্যানরিকশ চালকও। এমন একটা লোককে নিয়ে এত উন্মাদনা! শিশুসাহিত্যিকের এ কী করুণ দশা! কেউ যেন তাকে দেখছেই না। সকলের মুগ্ধ দৃষ্টি জামাইয়ের উপরে! সবাই মিলে হাততালি দিয়ে যেন একজন জাতীয় বীরকে সম্মান জানাচ্ছে!
পরিচিতি পর্বের পর সম্মান জ্ঞাপনের পালা। প্রথমে পুষ্পস্তবক আর শাল দিয়ে শ্যামাপদবাবুকে সম্মানিত করলেন ক্লাব সভাপতি। সঙ্গে মুখ বন্ধ খামে দিলেন নগদ পাঁচ হাজার টাকা। এরপর জামাইকে পুষ্পস্তবক আর টিভি দিয়ে সংবর্ধিত করতে উদ্যোগী হলেন ক্লাব সেক্রেটারি। টিভির কথা কানে যেতেই হাত গুটিয়ে নিল জামাই। সামনে মাইক আছে জেনেও গলা চড়িয়ে বলল, ‘টিভি আমি নেব না। হারগিস না!’
‘কেন কেন, নেবে না কেন?’ সেক্রেটারি অবাক, ‘তোমার গিন্নিকে বলায় সে তো টিভির কথাই বলেছিল!’
সে তো বলবেই। জামাই খুল্লামখুল্লা, ‘বাড়িতে টিভি নেই, তবু পাশের বাড়িতে গিয়ে হররোজ তেনার টিভি দেখা চাই। সিরিয়ালের নেশা গো দাদারা, সিরিয়ালের নেশা! এবার বাড়িতে টিভি ঢুকলে কাজকম্ম সব শিকেয় ওঠাবে। সেলাইফোঁড়াই করে এদ্দিন দু’পয়সা যা আনছিল সব যাবে মায়ের ভোগে! তাছাড়া ছেলেমেয়ে দুটোর কচি মাথাও। তারাও তো পড়াশোনা ফেলে.... না না দাদা, ওসব টিভি-ফিবির চক্করে আমি নাই। দিতে হলে অন্য কিছু আমায় দ্যান। নেহাতই যদি না পারেন তাহলে টিভিটা সাহিত্যিক সারকে দিয়ে আমাকে দ্যান শালখানা। আমার বহুদিনের শখ গায়ে একখানা শাল চাপাব। সার যদি রাজি থাকেন...।’
এ কী উদ্ভট বায়না! সেক্রেটারি মশাইয়ের সঙ্গে সঙ্গে দর্শককুলেরও চোখ কপালে। শ্যামাপদবাবুও হতভম্ব। সংবর্ধনায় পাওয়া উপহার পাল্টাপাল্টি! ভাগ্যিস বলেনি, সঙ্গে খামের এই পাঁচ হাজার টাকাটাও ওর চাই! লোকটা লুকিয়েচুরিয়ে আজও কি নেশা করে এসেছে নাকি? নইলে ছ’-সাত হাজারের টিভির সঙ্গে হাজার তিনেকের শালের বদলাবদলির মানেটা কী! বাড়িতে নামী কোম্পানির এলসিডি টিভি রয়েছে শ্যামাপদবাবুর। সিরিয়ালের সাধনায় সেটা অবশ্য সর্বক্ষণ বউয়ের জিম্মাতেই থাকে। তবু এই বদলাবদলির খেলায় কিছুতেই তাঁর সম্মতি নেই। অভিনব এক প্রসঙ্গ তুলে শ্রোতা-দর্শকদের প্রায় পকেটে পুরে ফেলেছে জামাই। সবাই জামাই জামাই বলে চিল্লাচ্ছে। এরপর ওর প্রস্তাবে রাজি হওয়া মানে শ্যামাপদবাবুরও সেই স্রোতে ভেসে যাওয়া। সেটা তিনি কিছুতেই হতে দিতে পারেন না!
শেষ পর্যন্ত অবশ্য বিড়ম্বনায় পড়তে হল না শ্যামাপদবাবুকে। মুখে হাসি টেনে সেক্রেটারি বললেন, ‘স্যারের শাল স্যারেরই থাক। তেমন হলে টিভিটা ফেরত দিয়ে তার বদলে যতগুলি শাল হয় কিনে দেব তোমাকে। তবে সেটা আজ হবে না, কাল চেষ্টা করব।’
শুনে ঘাড় নেড়ে সম্মতি জানাল জামাই। এরপর যুদ্ধ জয় করেছে এমন একটা ভাব করে শ্যামাপদবাবুর কানের কাছে মুখ এনে বলল, ‘নেশা যে কী বাজে জিনিস তা আমি জানি সার। ছেলেমেয়ে দুটো আমার পড়াশোনায় ভালো। এখন ওদের ভিত গড়ার সময়। এ সময় বাড়িতে টিভি ঢোকালে সর্বনাশ হয়ে যাবে সার!’ দু’দিন কা যোগী। ক’টা হাততালি পেতে না পেতেই লম্বা-চওড়া বাত ঝাড়তে শুরু করে দিয়েছে! চোরা বিরক্তি শ্যামাপদবাবুকে বোবা বানিয়ে দিল। তিনি আনমনা হয়ে অন্যদিকে মুখ ঘোরালেন।
একটু পরেই সঞ্চালিকার সুরেলা সংবর্ধিত গলায় সংবিৎ ফিরে এল শ্যামাপদবাবুর। দর্শক-শ্রোতাদের দাবিতে আবার নতুন অসম্মানের মুখোমুখি তিনি। সংবর্ধিত ব্যক্তিদের ভাষণ দানের ক্ষেত্রে তাকে টপকে জামাইকে আগে সুযোগ দেওয়া হয়েছে! মরমে মরে যেতে ইচ্ছে হল শ্যামাপদবাবুর। চোয়াল শক্ত করে ভাবলেন, ভবিষ্যতে সংবর্ধনার কোনও ব্যাপার থাকলে আগাম খোঁজ নিয়ে তবে যাবেন। একা হলে আছেন, কিন্তু সঙ্গে দোসর জুটলে নৈব নৈব চ!
টেবিলে ঢাকা দেওয়া জলভর্তি কাচের গ্লাস। মাউথ পিসটা হাতে নেওয়ার আগে সেখান থেকে কয়েক ঢোঁক জল খেয়ে নিল জামাই। টেনশনে ঘামছে লোকটা। বেশ কিছুক্ষণ দম নেওয়ার পর কাঁপা কাঁপা গলায় বলে উঠল, ‘মদ ছাড়ার কারণে আমি সংবর্ধনা পাচ্ছি ভালো কথা। কিন্তু আপনারা হয়তো জানেন না, এটা সম্ভব হয়েছে আমাদের এই শ্যামাপদ সারের জন্য!’
শুনেই বিষম খেলেন শ্যামাপদবাবু। চোখ তাঁর ছানাবড়া হওয়ার জোগাড়। চেয়ারে বসে-বসেই আঙুল নেড়ে ভুরু নাচিয়ে বিস্ময় প্রকাশ করলেন।
জামাই অবশ্য থামল না। বলল, ‘আমার ক্লাস এইটের ছেলে সারের খুব ভক্ত। স্কুল লাইবেরি থেকে সারের বই এনে পড়ে। তা সেইরকম একটা বইয়ের মধ্যে প্লাস্টিক দৈত্য বলে একটা গল্প ছিল। সেই গল্পটা পড়ে আমার ছেলের মাথায় যেন ভূত চাপল! মাস দেড়েক আগের ঘটনা, পাড়ার এক বন্ধুকে সঙ্গে নিয়ে কাকভোরে একদিন বেরিয়ে পড়ল পাড়াকে প্লাস্টিক শূন্য করতে! আমি তখন নেশাড়ু মানুষ। কাকভোরেও পুরোপুরি ঘোর কাটেনি নেশার। ছেলে পড়াশুনো শিকেয় তুলে বাইরে বেরিয়েছে শুনে মটকা গরম হয়ে গেল আমার। ভ্যানওয়ালার ছেলের কীসের এত দেশোদ্ধার! চুলের মুঠি ধরে মারতে মারতে নিয়ে এলাম বাড়িতে। এমন মেরেছিলাম যে মারের চোটে জ্বর এসে গেল ছেলেটার। শেষে অনেক ভোগান্তির পর জ্বর ছাড়ল। বিশ্বাস করুন, তারপরই নড়ে উঠল আমার টনক। ভাবলাম, তেরো-চোদ্দো বছরের একটা ছেলের এত চিন্তা! সামান্য একটা গল্প পড়েই...! আর আমি, এতখানি বয়স হল তবু কোনও হুঁশ নেই! নেশায় পথে-ঘাটে যখন তখন গড়াগড়ি খাচ্ছি! সেই দিনই ঠিক করলাম, আর নয়! চিরতরে ত্যাগ দেব মদকে। তাই বলছি, সত্যি কথাটা হল মদ ছেড়েছি আমি ছেলের কারণে। আরও ছোট করে বললে, সারের ওই গল্পের কারণে!’
বাক্রুদ্ধ শ্যামাপদবাবু। এতক্ষণ মনে হচ্ছিল দর্শক-শ্রোতারা তাঁর থেকে বেশি গুরুত্ব দিচ্ছে জামাইকে। তুচ্ছ একজন মানুষের কাছে ক্রমশ তিনি হেরে যাচ্ছেন। কিন্তু অন্তিমে যে তাঁরই জয় হল! জামাই নিজেই তাঁকে জিতিয়ে দিল সর্বসমক্ষে! হাততালিতে ফেটে পড়ছে হলঘর। সকলের মুগ্ধ দৃষ্টি এখন তাঁর উপরে।
জামাই তার বক্তব্য শেষ করে সজল চোখে চেয়ারে আসীন হতেই সঞ্চালিকার আহ্বানে এরপর বলতে উঠলেন শ্যামাপদবাবু। খানিক আগেই মনে মনে ঘুঁটি সাজাচ্ছিলেন তিনি। ভাবছিলেন বক্তব্য রাখতে উঠে খুব সুচতুরভাবে নিজের ক্ষোভ ব্যক্ত করবেন। ঝড় তুলবেন অনুষ্ঠান কক্ষে। কিন্তু উত্তম মণ্ডলের বক্তব্য শোনার পর সে পথ থেকে সরে এলেন। বললেন, ‘উত্তমবাবুর কথায় আমি আপ্লুত। ওঁর উত্তরণের লড়াইকে আমি সম্মান জানাই। গল্প, উপন্যাস লিখতে গেলে মনঃসংযোগের দরকার হয়। নিত্যদিন সেই কাজটা করতে হয় আমাকে। কিন্তু মন লাগানোর কাজটা যেমন কঠিন, তার চেয়েও বেশি কঠিন ভালোলাগার কোনও জিনিস থেকে মন তুলে নেওয়া! উত্তমবাবু সেই কঠিন কাজটাই করে দেখিয়েছেন। ওঁকে কুর্নিশ জানাতে আমার এই সদ্য পাওয়া শালখানা আমি ওকে উপহার দিতে চাই! আপনারা প্লিজ সবাই মিলে হাততালি দিয়ে আমাকে সমর্থন করুন।’
শ্যামাপদবাবুর কথায় কর্মকর্তারা হতচকিত। বিব্রত জামাই হাত নেড়ে ‘না না’ করছে। কিন্তু দর্শক-শ্রোতাদের তাতে থোড়াই কেয়ার! উচ্ছ্বাসে ফেটে পড়ল তারা। পরক্ষণেই শত শত হাততালিতে মুখরিত হয়ে উঠল হলঘর।
অলংকরণ : সুব্রত মাজী