কর্মপ্রার্থীদের ধৈর্য্য ধরতে হবে। প্রেম-প্রণয়ে আগ্রহ বাড়বে। নিকটস্থানীয় কারও প্রতি আকর্ষণ বাড়বে। পুরোনো কোনও বন্ধুর ... বিশদ
লকডাউনের প্রথম ছ’টা দিন... করোনা ভাইরাস এক অন্য ভারতের চিত্র প্রকাশ্যে এনে দিল। বলা ভালো, দেশটাকে দু’ভাগে ভাগ করে দিয়েছে এই সঙ্কট। একটা ভারত... যার বাড়ি-ঘর আছে, যে নিজেকে বাড়িতে বন্ধ রেখে এই মহামারীর বিরুদ্ধে লড়াই চালাতে। দ্বিতীয় ভারত... যার না আছে নির্দিষ্ট মাথা গোঁজার ঠাঁই, না পেট ভরার উপায়। তাঁদের জন্য এই সরকারি ‘বন্ধে’র নির্দেশ মাথায় আকাশ ভেঙে পড়ার মতো। কেরল, মহারাষ্ট্র, দিল্লি... কত পরিযায়ী শ্রমিক যে এই রাজ্যগুলিতে কাজ করতে যান, তার হিসেব মেলা ভার।
বিশেষত দিল্লি। রাজধানীর টুকরো টুকরো কিছু ছবি এই ছ’দিনে সামনে এসেছে। কখনও আনন্দ বিহারের মতো এলাকায় ফুট ওভারব্রিজের উপর দাঁড়িয়ে দু’পাশে রাস্তার দিকে তাকালে শুধু নজরে এসেছে কাতারে কাতারে মানুষ। যারা সবাই পরিযায়ী শ্রমিক... বাড়ি ফিরতে মরিয়া। কেউ যাবেন উত্তরপ্রদেশ, কেউ মধ্যপ্রদেশে। দিল্লি সরকার ২০০টি বাসের ব্যবস্থা করেছিল। উত্তরপ্রদেশ সরকার তাদের এলাকা থেকে হাজারটি। তাও যথেষ্ট হয়নি। হাজারে হাজারে মানুষ, যাদের কাছে সোশ্যাল ডিসট্যান্সিং বা সামাজিক দূরত্ব বজায় রাখাটা বিলাসিতা। মাথায় ছাদ নেই, পেটে খাবার নেই। আছে শুধু বিশ্বাস... গ্রামের বাড়িতে একবার পৌঁছে গেলে না খেয়ে অন্তত মরতে হবে না। আর যাঁরা বাসে চড়তে পারছেন? সবচেয়ে বেশি সংখ্যক পরিযায়ী শ্রমিক ফিরছেন উত্তরপ্রদেশে। বাস থেকে নামা মাত্র তাঁদের বসানো হচ্ছে জাতীয় সড়কের উপর। তারপর স্প্রে করা হচ্ছে জীবাণুনাশক। জলকামানের মতো...।
সুযোগ বুঝে চূড়ান্ত হারে বেড়েছে ‘পাচার’ও। অত্যাবশ্যকীয় পণ্যের গাড়িতে লুকিয়ে এক রাজ্য থেকে অন্য রাজ্যে নিয়ে যাওয়া হচ্ছে মানুষ। বাড়ি ফিরতে মরিয়া তাঁরা। তাই সর্বস্ব দিতেও রাজি। কলকাতা থেকে ভাইজাগ যাওয়ার জন্য মাথা পিছু আড়াই হাজার টাকার দর উঠছে বলে অভিযোগ। লোকে তা দিচ্ছেনও।
আবার যমুনার ধারে গেলে দেখা যাবে আশ্রয়হীন মানুষের লাইন... আইটিও ব্রিজ থেকে সেলিমগড় ফোর্ট। অনেকেই কাজ করতেন হোটেলে। কেউ মোগলাই খানা এক্সপার্ট, কেউ চাইনিজ। থাকতেন হোটেলে। খেতেন সেখানেই। হোটেল বন্ধ, থাকা খাওয়ার পাঠও চুকেছে... ‘মোদিজি বলছেন বাইরে বেরলে করোনায় মরে যাব। তাহলে যাব কোথায়? এই রাস্তার উপর বসে থাকলে দিনে একবার অন্তত খেতে পাওয়া যায়... চলে গেলে তাও জুটবে না। করোনা পরে... না খেতে পেয়ে আগে মরব।’
এটা একটা ভারত... দ্বিতীয় ভারত। আর প্রথম? যারা বাড়িতে থাকতে পারেন, কিন্তু থাকেন না। তাঁদের কৌতূহল বড্ড বেশি। তাই দিনে একবার বেরতেই হবে... বাজারের নামে, ওষুধের অজুহাতে। ডিগ্রিধারী অশিক্ষিতের এদেশে অভাব নেই। যাঁরা বিদেশ থেকে ফেরেন, গৃহবন্দি থাকার ডাক্তারি পরামর্শ অগ্রাহ্য করে মলে-হলে ঘোরেন, তারপর বেলেঘাটা আইডিতে গিয়ে ভর্তি হন। পিছনে ছেড়ে যান একরাশ আতঙ্ক আর কমিউনিটি ট্রান্সমিশনের আশঙ্কা। এই ধরনের বুদ্ধির জাহাজরা নিয়ম পালনের ধার ধারবেন না, অথচ টিভি দেখে অভুক্ত, বেঘর ভারতের মুণ্ডপাত করবেন। হয়তো ওই পরিযায়ী শ্রমিকদের কেউ কেউ বহন করছেন এই মারণ রোগ, তাঁদের কারও থেকে কাল অন্য কেউ সংক্রামিত হবেন... তাও বিবেচক মনন তাঁদের দায়ী করতে পারবে না। আমরা কী করছি তাঁদের জন্য? সরকার কী করছে? অরবিন্দ কেজরিওয়াল বলছেন, যে যেখানে আছেন থেকে যান। বাড়ি ভাড়া দিল্লি সরকার দেবে। কিন্তু যাদের ভাড়া করার বা পাওয়ার মতো বাড়ি নেই? তাঁরা কী করবেন?
লকডাউন প্ল্যান কিন্তু সত্যি দরকার ছিল। ১৩০ কোটি ভারতীয়র জন্য। কেন্দ্রীয় অর্থমন্ত্রী নির্মলা সীতারামন তাঁর হ্যান্ডসাম ডেপুটি অনুরাগ ঠাকুরকে পাশে বসিয়ে ১ লক্ষ ৭০ হাজার কোটি টাকার প্যাকেজ ঘোষণা করেছেন। কিন্তু সঠিক হাতে সেই টাকাটা কি যাচ্ছে? এটা নিশ্চিত করতে না পারলে প্যাকেজ ঘোষণার মূল্য নেই। ধরা যাক ১০০ দিনের কাজের প্রসঙ্গ। ভাতা বাড়ানো হয়েছে ঠিক কথা, কিন্তু দিশা কি স্থির হয়েছে? কোন কোন ক্ষেত্রে আমরা ১০০ দিনের কাজ প্রকল্প ব্যবহার করব, কী ধরনের সরকারি অ্যাসেট বানানোর চেষ্টা করব এবং সর্বোপরি যাতে সবচেয়ে বেশি সংখ্যক মানুষ এর আওতায় আসেন, তা নিশ্চিত করব। এর কোনওটাই এই মুহূর্তে সিলমোহর দেওয়ার জায়গায় আসেনি। আর লকডাউনের সময়ে কাজটাই বা হবে কী করে? শহরে থাকা খাওয়ার সংস্থান হারিয়ে লাখো মানুষ গ্রামে ফিরে যাওয়ার চেষ্টা করলেন, বা ফিরেও গেলেন। তাতে কিন্তু সমস্যার সমাধান হবে না। কারণ তাঁদের হাতে নগদ নেই। জরুরি পরিস্থিতির সুযোগে কালোবাজারি ইতিমধ্যে বেড়ে গিয়েছে। সাপ্লাই কম, যে যেমন পারছে জিনিসপত্রের দাম হাঁকছে। মানুষ কিনতে বাধ্যও হচ্ছে। একটা শ্রেণীর পক্ষে এরপরও চালিয়ে নিয়ে যাওয়া সম্ভব। কিন্তু ওই কপর্দকশূন্য মানুষগুলো উপায় না দেখে চড়া সুদে টাকা ধার করবে, আর তারপর সারা জীবনেও শোধ করতে পারবে কি না সন্দেহ। কৃষিক্ষেত্রে উৎপাদন কমবে। অর্থাৎ সরবরাহ ব্যাহত হবে। এই সবটাই একে অপরের সঙ্গে জড়িত। এটাও কিন্তু সরকারের কাছে একটা বিরাট চ্যালেঞ্জ।
অর্থাৎ চ্যালেঞ্জ দুটো... করোনা সংক্রমণের চেনটা ভাঙা এবং দুই, অর্থনীতি ধসে যাওয়ার আগে ঠেকনা দেওয়া। কথায় বলে, আপনি বাঁচলে বাপের নাম। অর্থনীতি ডুবে গেলেও এই মুহূর্তে কিছু করার নেই। বাঁচতে হবে... সংক্রমণ প্রায় ১২০০, মৃত্যু ৩০-এর কোঠা ছুঁয়েছে। হয়তো এটাই ঠিক পরিসংখ্যান। আবার নাও হতে পারে। কারণ, কিটের অভাবে পরীক্ষা কম হওয়া, মানুষের লুকিয়ে রাখার প্রবণতা এই পরিসংখ্যানে প্রভাব ফেলার সম্ভাবনা উড়িয়ে দেওয়া যায় না। কোনটা ঠিক, তা সময় বলবে। খুব বেশি নয়... আগামী সপ্তাহেই পরিষ্কার হয়ে যাবে যে ভারত ইতালি বা মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র হতে চায় কি না। লকডাউন সফল করার জন্য চাই মানসিকতা, সচেতনতা। যা আম ভারতবাসীর মধ্যে খুব একটা দেখা যাচ্ছে না। তাহলে উপায় কী?
শোনা যাচ্ছে, কেন্দ্রীয় সরকার নাকি ইতিমধ্যেই সেনাবাহিনীকে তৈরি হওয়ার নির্দেশ দিয়েছে। দেশের বিভিন্ন প্রান্তে শুরু হয়ে গিয়েছে সেনার মুভমেন্ট। এই তথ্য একটাই প্রশ্ন সামনে নিয়ে আসে... তাহলে কি দেশে ফের জরুরি অবস্থা জারি হতে চলেছে? তার মানে কার্ফু, সেনা টহলদারি, বাস্তবিকই বাড়ি থেকে বেরনো সম্পূর্ণ বন্ধ। আমাদের দেশের ‘শিক্ষিত’ ‘অচেতন’ নাগরিকদের জন্য এটাই হয়তো শেষ অস্ত্র। নিজের ভালো না বুঝলে বেতের সাহায্য নিতেই হবে। না হলে দেশ বাঁচবে না। পরিস্থিতি হয়তো সেদিকেই যাচ্ছে। এর মধ্যে রাত ৮টায় প্রধানমন্ত্রী যদি আবার জাতির উদ্দেশে ভাষণ দিতে বসেন, তাহলে সিট বেল্ট কষে বেঁধে নেওয়াই ভালো। কারণ ১৩০ কোটির দেশে ২১ দিনের লকডাউন সমাধান করতে পারবে না। সেটা অল্প-বিস্তর সবাই এখন আন্দাজ করতে পারছেন। হয় কার্ফু, না হলে দীর্ঘমেয়াদী গৃহবন্দিত্ব। কেন্দ্রীয় সরকার অবশ্য লকডাউনের সময়সীমা বাড়ানোর সম্ভাবনা উড়িয়ে দিয়েছেন। তাও আতঙ্ক যায়নি। যাচ্ছে না।
কারণ, বেশ কিছু রাজ্যে অত্যাবশ্যকীয় পরিষেবার জন্য পাস কিন্তু ৩০ জুন পর্যন্ত ইস্যু করা হয়েছে!