কর্মপ্রার্থীদের ধৈর্য্য ধরতে হবে। প্রেম-প্রণয়ে আগ্রহ বাড়বে। নিকটস্থানীয় কারও প্রতি আকর্ষণ বাড়বে। পুরোনো কোনও বন্ধুর ... বিশদ
এমনও শোনা যাচ্ছে, যেসব ডাক্তার, স্বাস্থ্যকর্মী করোনা রোগীর চিকিৎসা করছেন, কোথাও কোথাও তাঁদের বাড়িতে লোক চড়াও হচ্ছে। তাঁদেরও আলাদা করার দাবি জানাচ্ছেন। এতো অমানবিক কাজ। অমার্জনীয় অপরাধ। অবিলম্বে এই ঝোঁক পরিহার করুন। সভ্য সমাজে এর চেয়ে বড় অন্যায় আর কিছু হতে পারে না। বিশ্বব্যাপী করোনা মহামারী রুখতে সামনে থেকে যাঁরা আজ যুদ্ধ করছেন, তাঁদেরই ব্রাত্য করে দিলে মহাপাপ হবে। এই দুর্দিনে ওঁরাই একমাত্র বন্ধু। ও কাজ ভুলেও করার চেষ্টা করবেন না।
পৃথিবীর নানা প্রান্তে অপেক্ষাকৃত নতুন এই ভাইরাসের গতিপ্রকৃতি নিয়ে নিরন্তর গবেষণা চলছে। কীভাবে মিউটেট করে ভাইরাসটি তার চরিত্র বদলাচ্ছে, আরও ভয়ঙ্কর সংক্রামক আকার নিচ্ছে তারই পর্যবেক্ষণ চলছে দুনিয়াজুড়ে। কিন্তু মাত্র তিনমাস যার বয়স তার সম্পর্কে বেশি তথ্য তো কারও কাছেই নেই। ডাক্তারবাবুরাও বলছেন, কোভিড ১৯ চরিত্র বদল করে যে এতটা সংক্রামক ও দ্রুত ছড়িয়ে পড়ার বিপজ্জনক প্রবণতা নিয়ে আত্মপ্রকাশ করবে তা বিজ্ঞানীরাও প্রথমটায় আঁচ করতে পারেননি। তবে এটি বাতাসে কতক্ষণ ভেসে থাকে তা নিয়ে দ্বিমত আছে। কোনও কোনও বিশেষজ্ঞ আবার বলছেন, গরম যত বাড়বে তত আমাদের দেশে এই রোগের প্রকোপও নাকি কমবে। তবে গাড়ির হাতল, লিফটের গেট, দরজার তালা, মাথার চুল থেকেও অবলীলায় এই ভাইরাস দ্রুতবেগে সংক্রামিত হয়। পরিভাষায় এগুলিকেই বলা হয় ফোমাইটস। বাইরে থেকে এসে তাই প্রথমেই হাত ধোয়া, জামাকাপড় ছেড়ে সাবান মেখে স্নান করা সবচেয়ে জরুরি। আরও জরুরি বাইরে থেকে ফিরেই জামাকাপড় সাবানজলে সামান্য ডেটল মিশিয়ে ধুয়ে ফেলা।
এত সৈন্যসামন্ত, লোকলস্কর, অস্ত্রশস্ত্র, বোমারু বিমান, পরমাণু যুদ্ধের প্রস্তুতি সবই মনে হচ্ছে বৃথা গেল। এ যুদ্ধে ওসবের কোনও ভূমিকাই নেই। আসলে সবাই সবাইকে শত্রু ভাবতে ভাবতে শেষে এই একবিংশ শতাব্দীতে এসে নেপোয় দই মারার মতো সভ্যতাকে উজাড় করে দিয়ে গেল চীনের মাটিতে সৃষ্ট মারাত্মক ছোঁয়াচে করোনা। আরও বিপদের কথা, কেউ কেউ আবার নিজে থেকে আক্রান্ত হওয়ার আশঙ্কায় নিজের ও নিজের পরিবারের উপর ডাক্তারি করছেন। নেট ঘেঁটে প্রেসক্রিপশন ছাড়াই হাইড্রক্সিক্লোরোকুইন, অ্যাজিথ্রোমাইসিন, লোপিনাভির ও রিতোনাভির মতো ওষুধ ব্যবহারের পরিকল্পনা করছেন। কিন্তু চিকিৎসকের পরামর্শ ছাড়া নিজের উপর ডাক্তারি করার পরিণাম ভয়ঙ্কর হতে পারে। কোনও ওষুধের দোকানও যেন চিকিৎসকের সুপারিশ ছাড়া এই সব বিপজ্জনক ওষুধ বিক্রি না করে, তা প্রশাসনকে দেখতে হবে।
গত একশো বছরের ইতিহাসে মানবজাতির সামনে এমন অভূতপূর্ব সঙ্কট এসেছে বলে অনেক প্রবীণ মানুষেরও মনে পড়ে না। তিন মাস বয়সের এক মারণ ভাইরাসের সঙ্গে সারা পৃথিবীর সবচেয়ে উন্নত নাগরিক সমাজের এক অদৃশ্য লড়াই চলছে। কতশত অস্ত্র, গোলাবারুদ, বোমারু বিমান এই আধুনিক পৃথিবী তৈরি করেছে তার ইয়ত্তা নেই। কিন্তু তার সবই একে অপরকে ধ্বংস করার জন্য। বিদ্বেষ আর শত্রুতাকে চরিতার্থ করার জন্য। ঈর্ষা আর লোভের বশবর্তী হয়ে। কিন্তু নবজাতক এই করোনা ভাইরাস সব হিসেব উল্টে দিয়েছে। ভালোবাসা নয় বন্ধুত্ব নয়, স্রেফ ভয় আর আতঙ্ক আজ সমগ্র মানবসমাজকে একসূত্রে গেঁথে দিয়েছে। ছলচাতুরি, হুমকি পাল্টা হুমকি, অস্ত্রের ঝনঝনানি সব আজ অর্থহীন হয়ে পড়েছে। চীন থেকে আত্মপ্রকাশ করে করোনা ভাইরাস আজ উন্নত ইউরোপ ও আমেরিকাকে পর্যন্ত নাজেহাল করে দিয়েছে। এপিসেন্টার চীন থেকে ইউরোপ পেরিয়ে এখন আমেরিকায় থাবা বসাতে উদ্যত। মার্কিন মুলুকে মৃত্যু বাড়ছে লাফিয়ে। আর সবচেয়ে ক্ষতিগ্রস্ত দেশ ইতালির প্রধানমন্ত্রীর চোখে জল। হতাশ গলায় তিনি বলছেন মহামারীর নিয়ন্ত্রণ আমরা হারিয়ে ফেলেছি। গোটা দেশটাই কার্যত ছারখার হওয়ার মতো অবস্থায়। কার্যত গোটা ইউরোপই প্রায় পথে বসার মতো অবস্থায়। স্পেন, ফ্রান্স, সুইজারল্যান্ডও এই মারণ ভাইরাসের পরাক্রমের কাছে আত্মসমর্পণ করতে বাধ্য হয়েছে।
এই কঠিন পরিস্থিতিতে বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা (হু) এখন লক্ষ্য রাখছে ভারতের উপর। ভারতও এর প্রভাবে বেসামাল। গোটা দেশ ঘরবন্দি। ব্যবসা লাটে। তার উপর আর্থিক বছরের শেষ, মার্চ মাস বলে কথা। বুঝতে অসুবিধা হওয়ার কথা নয় অর্থনৈতিক মন্দা কোন পর্যায়ে গিয়ে পৌঁছেছে। গোটা দেশ লকডাউনের মধ্যে কোনওরকমে দিন গুজরান করছে। সবে মাত্র কয়েকদিন কেটেছে আরও অনেক সময় বাকি। মোট ২১ দিনের লকডাউন। তাই দীর্ঘ সময় ঘরবন্দি থাকতে হবে। নিঃসন্দেহে ধৈর্যের পরীক্ষা। কিন্তু সেই পরীক্ষায় ১৩০ কোটির দেশ সসম্মানে উত্তীর্ণ হতে পারে কি না, সেদিকেই সবার নজর।
এই লড়াইয়ের প্রধান স্থপতি নিঃসন্দেহে ডাক্তারবাবুরা ও সতর্ক জনগণ। দু’তরফের যোগ্য সমঝোতা ও সমন্বয় ছাড়া জয় সম্ভব নয়। সর্বত্র মানুষের এখন একটাই প্রশ্ন, আবার কেউ প্রাণঘাতী মারণ ভাইরাসের শিকার হল না তো? এক অজানা আশঙ্কা ও ভয়ের প্রহর গুনছে সবাই। ভারতের মতো গরিব জনবহুল দেশে এখন জিজ্ঞাসা একটাই, করোনার থার্ড স্টেজে যাওয়া আটকানো যাবে তো?