কর্মপ্রার্থীদের ধৈর্য্য ধরতে হবে। প্রেম-প্রণয়ে আগ্রহ বাড়বে। নিকটস্থানীয় কারও প্রতি আকর্ষণ বাড়বে। পুরোনো কোনও বন্ধুর ... বিশদ
ইতিমধ্যে ২০ থেকে ২৩ মার্চের ভিতরে কয়েকটি রাজ্য সরকার তাদের রাজ্যের বিভিন্ন অংশে আংশিক কিংবা সম্পূর্ণ লকডাউন ঘোষণা করে দিয়েছিল। সোমবার (২৩ তারিখ) এবং মঙ্গলবার (২৪ তারিখ) উল্লেখযোগ্য কিছু মিলল না—কয়েকটি ভয়ানক সংখ্যা ছাড়া—কিছু টেস্টের রেজাল্ট পজিটিভ এবং ধীর গতিতে মৃতের সংখ্যা বৃদ্ধি।
সম্ভবত, ইতালি, স্পেন, এবং ইরানে যা ঘটে চলেছে তাতে অশনিসঙ্কেত লক্ষ করেই প্রধানমন্ত্রী ২৪ তারিখ ফের টেলিভিশনের সামনে এলেন এবং দেশজুড়ে লকডাউন ঘোষণা করে দিলেন, সেইদিন মধ্যরাত্রি থেকে যা বলবৎ হল। বাংলা হিসেবে লকডাউন বলবৎ হল ২৪ মার্চ রাত্রি কাঁটায় কাঁটায় ১২টা (বা ২৫ মার্চ ০০.০০ ঘটিকা) থেকে। আপনি এই নিবন্ধ যখন পড়ছেন তখন লকডাউনের ষষ্ঠ দিন চলছে। দেশজুড়ে এই লকডাউনের ব্যাপারে শুধু দেশবাসীই অপ্রস্তুত ছিলেন না, এমনকী অপ্রস্তুত ছিল কেন্দ্রীয় সরকারও। প্রধানমন্ত্রী ১৯ মার্চ যে ইকনোমিক টাস্ক ফোর্সের কথা ঘোষণা করেছিলেন, সেটা এখনও গঠন করা হয়নি। সাধারণ মানুষের কাছে এর অন্য কী ব্যাখ্যা থাকতে পারে?
অপ্রস্তুত
পরিতাপের সঙ্গে লক্ষ করছি যে, গত ৩০ জানুয়ারি প্রথম টেস্ট রেজাল্ট পজিটিভ জানার পর থেকে প্রস্তুত না-হওয়াটাই মোদি সরকারের বৈশিষ্ট্য দাঁড়িয়ে গিয়েছে। এই প্রসঙ্গে নীচের বিষয়গুলি বিবেচনা করা যায়:
(১) সবচেয়ে বড় ব্যর্থতা হল পর্যাপ্ত সংখ্যায় টেস্ট করার ব্যবস্থা করতে না পারাটা। মহামারী এবং চিকিৎসা বিশেষজ্ঞরা আরও বেশি টেস্ট বা পরীক্ষা করার ব্যবস্থা গড়ে তোলার প্রশ্নে সহমত পোষণ করেন। এই ব্যাপারে তাঁরা সরকারের কাছে সওয়ালও করেছেন। পরীক্ষা, আরও পরীক্ষা, পজিটিভ কেস খুঁজে বের করা, তাদের আইসোলেশনে রাখা এবং চিকিৎসা করা—এটাই এই সময়ের দাবি। সরকার, মনে হয়, এই জায়গায় ব্যর্থ হয়েছে। এই নিবন্ধ যখন লিখছি তখনকার হিসেবমতো, দৈনিক সর্বাধিক মাত্র ১২ হাজার পরীক্ষা হচ্ছে। তার ভিত্তিতে সংক্রামিত মানুষের যে সংখ্যাটি জানা যাচ্ছে, তা নিয়ে সংশয় রয়ে যাচ্ছে। ইন্ডিয়ান কাউন্সিল অফ মেডিকেল রিসার্চের (আইসিএমআর) অবস্থান বদলের ঘটনা বিলম্ব এবং সংশয় বাড়িয়ে দিচ্ছে। আজও এটি স্পষ্ট হল না কোনওভাবে।
(২) এমনকী টেস্ট রেজাল্ট ৭২৪-এ পৌঁছেছে, রোজই নতুন নতুন জায়গা থেকে সংক্রমণের দুঃসংবাদ পাওয়া যাচ্ছে। তার পরেও দেখছি, আইসিএমআর এবং স্বাস্থ্যমন্ত্রক এমন আচরণ করছে যে ভারত এখনও স্টেজ-২-তেই রয়ে গিয়েছে এবং ‘কমিউনিটি টান্সমিশন’-এর কোনও প্রমাণ নেই। সরকারের এই দাবি নিয়ে কিন্তু কিছু মহামারী বিশেষজ্ঞের সন্দেহ রয়েছে।
(৩) ভারতের প্রয়োজন ৭ লক্ষ পিপিই স্যুট, ৬০ লক্ষ এন-২৫ মাস্ক এবং ১ কোটি থ্রি-প্লাই মাস্ক। এই প্রয়োজনের কতটা এখনই মেটানো যাবে এবং বাকিটা কত দিনে পূরণ হবে তার- আঁচ পাওয়া যাচ্ছে না।
(৪) রপ্তানি বন্ধ করার দাবি থাকা সত্ত্বেও ভেন্টিলেটর, শ্বাসের সরঞ্জাম (রেসপিরেটরি ডিভাইস) এবং স্যানিটাজার রপ্তানিতে নিষেধাজ্ঞা জারি হল মাত্র গত ২৪ মার্চ।
(৫) পণ্য সরবরাহ শৃঙ্খল (সাপ্লাই চেন) ব্যাহত হয়ে রয়েছে। পণ্য সরবরাহ বন্ধ থাকায় অনেক মুদি দোকান এবং পরিষেবা কেন্দ্র বন্ধ রাখা হয়। অনেকগুলি ঘটনায় দোকান কর্মচারীদেরকে দোকানে যেতে দেওয়া হয়নি।
(৬) এমনও হৃদয়বিদারক ছবি দেখা গিয়েছে যে ছোট্ট ছেলেটি বলছে, তাদের ঘরে কোনও খাবার ছিল না বলে সে কিছুই খেতে পায়নি এবং পরিযায়ী শ্রমিকরা তাদের রাজস্থান, উত্তরপ্রদেশ অথবা বিহারের বাড়িতে ফিরবেন বলে রাজপথ ধরে হেঁটে চলেছেন! এতে করে এটাই পরিষ্কার হয় যে সরকারগুলিই এইসব নিরপরাধ মানুষকে তাদের ভাগ্যের হাতে ছেড়ে দিয়েছে।
(৭) পুলিস—রাজ্য সরকারগুলিরই নিয়ন্ত্রণে, তা নিয়ে কোনও সংশয় নেই। কিছু স্থানে তারা পণ্যের ডেলিভারি এজেন্টদের অথবা ক্রেতাদের বাধা দিল। এমন কিছু ভিডিয়ো ভাইরাল হল, যাতে দেখা গেল—লকডাউন লঙ্ঘনের ব্যাপারে অভিযুক্তদের পুলিস লাঠিপেটা করছে এবং এমন কিছু অস্বাভাবিক শাস্তি দিচ্ছে, যা পুলিস আইনত করতে পারে না। বলা বাহুল্য, তার ফলে এলাকায় এলাকায় প্রবল আতঙ্কের সৃষ্টি হল।
যে পরিকল্পনা মনে দাগ কাটল না
সবচেয়ে মর্মান্তিক ব্যর্থতা ছিল সুরাহা ঘোষণার ক্ষেত্রে—সার্বিক লকডাউনের সঙ্গেই যা করার দরকার ছিল—গরিব ও দুর্বলদের জীবনযাত্রার সুরক্ষার জন্য—ভাগচাষি, খেতমজুর, দিনমজুর, স্বনিযুক্ত ব্যক্তি, অতি ক্ষুদ্র ছোট ও মাঝারি (এমএসএমই) শিল্প-ব্যবসার মালিক, কাজ খোয়ানো শিল্প শ্রমিক, বঞ্চিত ও পথবাসী মানুষজন প্রভৃতির জন্যে। আরও এক শ্রেণীর মানুষ অসহায় হয়ে পড়লেন—তাঁদের মধ্যে আছেন সেই নিয়োগকর্তারা যাঁরা শ্রমিক-কর্মচারীদের বেতন দেন, কর প্রদান করেন এবং সেই সমস্ত ঋণগ্রহীতারা যাঁদের মাসিক কিস্তি (এএমআই) গুনতে হয়।
কিছু পরামর্শ পেশ করা হয়েছিল, কিন্তু সরকার তা নিয়ে দ্বিধাগ্রস্ত ছিল ২৬ মার্চ পর্যন্ত। অর্থমন্ত্রী ফিনান্সিয়াল অ্যাকশন প্ল্যান (এফএপি বা ফ্যাপ) ঘোষণা করলেন—যা ভীরু এবং আধখেঁচড়া ব্যবস্থা। এটা নিশ্চিতরূপেই কম্প্রিহেনসিভ বা ব্যাপক নয়। ফ্যাপ সমস্ত শ্রেণীর গরিব মানুষের জন্য পর্যাপ্ত খাদ্যের জোগান দেবে, কিন্তু এই পরিকল্পনা তাদের পকেটে যথেষ্ট টাকা ভরে দেবে না। সবচেয়ে খারাপ এই যে গরিব এবং দুর্বলদের ভিতরেও কিছু শ্রেণী নজরের পুরো বাইরে রয়ে গিয়েছে—ভাগচাষি, ১০০ দিনের কাজের প্রকল্পে যাদের কাজ জোটেনি, পথবাসী মানুষ, বঞ্চিত মানুষ, জনধন যোজনার পুরুষ গ্রাহকরা, কর্মচ্যুত শ্রমিক—এরা অবহেলিত হলেন। কর প্রদানের সময়সীমা বৃদ্ধির আইনসংগত দাবির পাশাপাশি ঋণের কিস্তি (ইএমআই) স্থগিত, জিএসটির হার কমানো প্রভৃতির দাবি মানা হয়নি। তাই ফ্যাপ মানুষের মনে দাগ কাটল না। আমি হুঁশিয়ারভাবেই এই পরিকল্পনাটিকে স্বাগত জানাচ্ছি।
নেতৃত্বের প্রয়োজন
যদিও অর্থমন্ত্রী দাবি করছেন যে ফিনান্সিয়াল অ্যাকশন প্ল্যান (করোনা পরিস্থতি মোকাবিলায় কেন্দ্রের যে আর্থিক প্যাকেজ) বাবদ সরকারের ব্যয় হবে ১ লক্ষ ৭০ হাজার কোটি টাকা। আমার হিসেবে, যে অতিরিক্ত নগদ অর্থ বেনিফিসিয়ারিদের (উপকৃত ব্যক্তিদের) হস্তান্তর করা হবে তার পরিমাণ ৬০ হাজার কোটি টাকা এবং খাদ্যশস্য ও ডাল বাবদ যা খরচা হবে তার পরিমাণ দাঁড়াবে ৪০ হাজার কোটি টাকা। এটি প্রয়োজনীয়, কিন্তু মোটেই পর্যাপ্ত নয়। ফ্যাপ দ্বিতীয় দফায় প্রয়োজন হবে পরবর্তী কয়েক ঘণ্টায় কিংবা দিন কয়েকের ভিতরেই।
বেশিরভাগ মানুষের মনে ভুল ধারণা জন্মেছে যে চীন, ইতালি ও স্পেনের মতো ওইরকম ব্যাপক হারে ভারত আক্রান্ত হবে না। আমার ভয় হচ্ছে যে ভারত কোনও ব্যতিক্রম নয়। অন্য প্রতিটি দেশের মতোই ভারতকে বড়সড় বিপর্যয়ের দুর্ভোগ পোহাতে হবে। তার উপর আমরা আপাতত শুধুমাত্র মানুষের জীবন, স্বাস্থ্য ও জীবন-জীবিকার সুরাহার বিষয়েই ব্যস্ত আছি। এর পর তো আসবে অর্থনীতি, দেশবাসীর চাকরিবাকরি এবং আয়পত্তর সংক্রান্ত আরও গুরুতর প্রশ্নগুলি। পতনমুখী অর্থনীতির আরও পতন ঘটবে এবং তা জড়িয়ে নেবে মানুষের বিপর্যয় ও দুর্ভাগ্যকে। সরকার অবশ্যই তার দ্বিধাগুলি কাটিয়ে উঠবে এবং ব্যতিক্রমীভাবে দৃঢ় ও বলিষ্ঠ নেতৃত্ব দেবে।