কর্মপ্রার্থীদের ধৈর্য্য ধরতে হবে। প্রেম-প্রণয়ে আগ্রহ বাড়বে। নিকটস্থানীয় কারও প্রতি আকর্ষণ বাড়বে। পুরোনো কোনও বন্ধুর ... বিশদ
আমাদের সকলের যুদ্ধ যার বিরুদ্ধে, সে কিন্তু দৃশ্যমান নয়। অন্তত খালি চোখে তাকে দেখা যায় না। তাকে দেখতে হয় যন্ত্রের সাহায্যে। আপাতনিরীহ, না-জড়, না-জীব গোত্রের এই আণুবীক্ষণিক বস্তুটিকে তখন যন্ত্রের কারসাজি বলে অগ্রাহ্য করার হিম্মত এই গ্রহের কারও হয় না। বস্তুটিকে হাতার মধ্যে পেয়েও তার নামকরণ করতে বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা (হু) ৪৩ দিন সময় নিয়েছিল। চীনের উহানে মানবদেহে নতুন করোনা সংক্রমণ পাওয়া গেল ২৯ ডিসেম্বর, ২০১৯। হু ১১ ফেব্রুয়ারি, ২০২০ তারিখে তার নাম দিল কোভিড-১৯। প্রথম দিকে চীনও রোগটিকে পাত্তা দেয়নি। বাকি বিশ্বও অগ্রাহ্য করেছিল সমস্যাটি বিচ্ছিন্নভাবে চীনের ভেবে। পরিণামে কোভিড-১৯ থাইল্যান্ড দক্ষিণ কোরিয়া জাপান সিঙ্গাপুর হয়ে ইরান ইউরোপ আমেরিকা ভারত বাংলাদেশ পাকিস্তান প্রভৃতি দুনিয়ার সিংহভাগ দেশে অনুপ্রবেশ করল। গুপ্তচরবৃত্তিও এত স্মার্ট এবং নিখুঁত হয় না।
আমরা হাত-পা ছড়িয়ে কাঁদতে বসার অবস্থায় দেখছি, মাত্র তিন মাসের ভিতরে সারা পৃথিবীর ২০০টি দেশে ছড়িয়ে পড়েছে কোভিড-১৯। সংক্রামিত মানুষের সংখ্যা প্রতি মুহূর্তে বাড়ছে। ২৯ মার্চ ২০২০ তারিখে একদিনে (২৪ ঘণ্টায়) যোগ হয়েছে নতুন ১ লক্ষ করোনা রোগী! মহামারীর ইতিহাসের সমস্ত হিসেব গুলিয়ে গেল সেদিন। আক্রান্ত নর-নারীর সংখ্যা মাত্র কয়েক ঘণ্টার ভিতরে ৬ লক্ষাধিক থেকে ৭ লক্ষাধিক হয়ে গেল! যেখানে সংক্রামিত মানুষের সংখ্যা প্রথম ১ লক্ষ হতে সময় নিয়েছিল ৬৭ দিন (১৬০৮ ঘণ্টা)। কয়েকটি বিক্ষিপ্ত সংখ্যার দিকে নজর রাখা যাক: আক্রান্ত... ২৫ মার্চ ২ হাজার ১৫ জন, ২৫ ফেব্রুয়ারি ৮০ হাজার ৮২৮ জন, ২৫ মার্চ ৪ লক্ষ ৭১ হাজার ৩৫ জন।
অনুমান করা যায়, আজ ২ এপ্রিল সংখ্যাটি ৯ লক্ষ ছাপিয়ে অনেকটাই এগিয়ে গিয়েছে সর্বনাশের দিকে। বিশ্বজুড়ে মৃতের সংখ্যা বৃদ্ধির গ্রাফেও সাদৃশ্য লক্ষণীয়। আমরা অনুরূপভাবে চোখ রাখি আরও কয়েকটি বিক্ষিপ্ত পরিসংখ্যানে: মৃত... ২২ জানুয়ারি ১৭ জন, ২৩ জানুয়ারি ২৫ জন, ২৪ জানুয়ারি ৪১ জন, ২৫ জানুয়ারি ৫৬ জন, ৩১ জানুয়ারি ২৫৯ জন। সংখ্যাটি ২৯ ফেব্রুয়ারি ২ হাজার ৯৭৭-এ পৌঁছে যায়। মৃতের সংখ্যা ১২ মার্চ ৫ হাজারের দোরগোড়ায় পৌঁছায়। ১০ হাজার পেরিয়ে যায় ১৯ মার্চ। ৩০ হাজার পেরিয়ে যায় পরের ৯ দিনে। মার্চের শেষদিনে ৪২ হাজার টপকে তীব্র গতিতে ছুটছে!
এই যে অপ্রতিরোধ্য বিষাদ, তার পত্তন চীনের হাতে। দ্রুত চীনকে পিছনে ফেলে আর্তচিৎকার করতে থাকে ইতালি ও স্পেন। অথচ জনস্বাস্থ্য পরিষেবায় অগ্রণী দেশ হিসেবেই পরিচিত ইতালি। বিষণ্ণতা অক্টোপাসের মতোই জড়িয়ে ধরে ইরান ব্রিটেন ফ্রান্স জার্মানি মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র-সহ অনেক স্বঘোষিত মুরুব্বি দেশকেই। আমাদের ভারতেও আক্রান্তের সংখ্যা দেড় হাজারের বেশি, মার্চের শেষদিনে। সেদিন সন্ধ্যা পর্যন্ত মৃতের সংখ্যা বেড়ে ৪৭ হয়ে গিয়েছে। একই সময়ে পশ্চিমবঙ্গে আক্রান্ত ৪৩ জন আর মৃত ৫ জন।
এত এত হতাশারই ভিতরে উঁকি দিয়েছে কিছু নিশ্চিত আশাও: বিশ্বজুড়ে সুস্থ হয়ে উঠেছেন পৌনে ২ লক্ষ নরনারী। ভারতে সুস্থ হয়ে উঠেছেন শ’দেড়েক মানুষ। পশ্চিমবঙ্গে সুস্থতার খবর পাওয়া গিয়েছে ৩ জনের ক্ষেত্রে। শেষোক্ত ক্ষেত্রে হাবড়ার তরুণীর জন্য কোনও প্রশংসাই যথেষ্ট নয়। তিনি স্কটল্যান্ডে পড়াশোনা করেন। রোগলক্ষণ নিয়ে কলকাতা বিমানবন্দরে নেমে তিনি নিজেই সোজা বেলেঘাটা আইডি হাসপাতালে গিয়ে যোগাযোগ করেন এবং তাঁকে সেখানেই ভর্তি করানো হয়। সেখানকার সুন্দর পরিবেশে চিকিৎসায় সুস্থ হয়ে উঠে যারপরনাই অভিভূত তিনি। মঙ্গলবার ওই তরুণী বাড়ি ফিরে গিয়ে বস্তুত রাজ্যবাসীকেই আশ্বস্ত করেছেন, আশার আলো দেখিয়েছেন। অন্যদিকে, দেশে ২০০ করোনা হাসপাতাল নির্মাণের চেষ্টা চলছে। ক্রমান্বয়ে বাড়ছে করোনা পরীক্ষার পরিকাঠামোও। উপযুক্ত মাস্ক, পিপিই, ভেন্টিলেটর-সহ করোনা চিকিৎসার যাবতীয় সরঞ্জামের জোগান দ্রুত বাড়ানোর উপর গুরুত্ব দিয়েছে কেন্দ্র এবং রাজ্যগুলি। এজন্য কেন্দ্র সংশ্লিষ্ট পণ্য বা কাঁচামালের উপর আমদানি শুল্ক, আইজিএসটি, কাস্টমস ডিউটি প্রভৃতি সাময়িকভাবে প্রত্যাহার নেওয়ার কথা ভাবছে। সমাজের বিভিন্ন স্তরের মানুষ সামর্থ্যানুযায়ী আর্থিক সাহায্যের হাতও বাড়িয়ে দিচ্ছেন। সংশ্লিষ্ট মহলের আশা, করোনা পরিস্থিতি থেকে শিক্ষা নিয়ে কেন্দ্র এবং রাজ্যগুলি অদূর ভবিষ্যতে মেডিক্যাল রিসার্চের উপর জোর দেবে এবং বাজেট বরাদ্দ উল্লেখযোগ্য হারে বাড়াবে। এই ধরনের গবেষণাকে ভারতও আর বিলাসিতার তকমা দিয়ে দূরে সরিয়ে রাখতে পারবে না। এই প্রশ্নে চীনের সাফল্য ভারতকে অনুপ্রাণিত করবেই। চীনের যথার্থ প্রতিদ্বন্দ্বী শক্তি হয়ে ওঠার বাসনা পোষণ করলে এর অন্যথা করা চলে না।
এর ভিতরেই তাল কেটে গিয়েছে একাধিক ঘটনায়।
হু ৩০ জানুয়ারি এই বিপদটি নিয়ে পাবলিক হেলথ ইমার্জেন্সি অব ইন্টারন্যাশনাল কনসার্ন (পিএইচইআইসি) ঘোষণা করে। তাতেই থেমে থাকেনি বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা। নোভেল করোনা ভাইরাস সংক্রমণ প্রবাহকে ১১ মার্চ সারা বিশ্বব্যাপী মহামারী (প্যানডেমিক) বলেও ঘোষণা করে দেয় তারা। কিন্তু তারপরেও ১১ দিন যাবৎ চালু ছিল ভারতের আন্তর্জাতিক বিমান পরিষেবা-সহ নানাভাবে এ-দেশ সে-দেশ যাতায়াত ব্যবস্থা। সংশ্লিষ্ট মহলের অনুমান, ওই ক’দিনে ইউরোপ, আমেরিকা ও পশ্চিম এশিয়ার বিভিন্ন দেশ থেকে ১৫ লক্ষাধিক মানুষ ভারতে ফিরেছেন! কিন্তু তাঁদের কতটা কী স্বাস্থ্যপরীক্ষা এদেশে হয়েছিল, তা নিয়ে সংশয় সন্দেহ এবং আতঙ্ক দুই-ই সচেতন দেশবাসীর রয়েছে।
ওইসঙ্গে যোগ হয়েছে দিল্লির দু’টি ঘটনা।
২৪ মার্চ মধ্যরাত থেকে দেশজুড়ে লকডাউন বলবৎ করা হয়েছে। তারই তিনদিন পর ২৮ মার্চ দিল্লির আনন্দবিহার বাস টার্মিনাস এবং গাজিয়াবাদে কয়েক হাজার পরিযায়ী শ্রমিক জড়ো হন উত্তরপ্রদেশ ও বিহারের বাড়িতে ফিরবেন বলে। এই ছবি দেখে সারা দেশ স্তম্ভিত হয়ে পড়ে।
এর দু’দিন পর ৩১ মার্চ ফাঁস হয় দিল্লিরই নিজামুদ্দিন বস্তি এলাকায় মুসলিমদের একটি ধর্মীয় সমাবেশে দু’হাজারের বেশি (বেসরকারি মতে, সংখ্যাটি ৭-৮ হাজার!) মানুষ জমায়েতের একটু পুরনো খবর। করোনার কারণে দিল্লির যে কোনও স্থানে ২০০ জনের বেশি মানুষের জমায়েত নিষিদ্ধ করে সরকার। তার পরেও সেখানে টানা তিনদিনের ওই সমাবেশ অনুষ্ঠিত হয়েছিল ১৩-১৫ মার্চ। পশ্চিমবঙ্গ-সহ ভারতের বিভিন্ন রাজ্য, এমনকী আন্দামান থেকেও তাঁরা গিয়েছিলেন। আর ট্যুরিস্ট ভিসা নিয়ে ২৮১ জন এসেছিলেন ইন্দোনেশিয়া বাংলাদেশ মায়ানমার মালয়েশিয়া ফিলিপিন্স ব্রিটেন আফগানিস্তান আলজিরিয়া কিরঘিস্তান শ্রীলঙ্কা নেপাল প্রভৃতি ১৬টি দেশ থেকে। সমাবেশ শেষ হওয়ামাত্র কিছু মানুষ নিজ নিজ দেশে, রাজ্যে বা এলাকায় ফিরে গিয়েছিলেন। আর লকডাউন ঘোষণার পরেও দিল্লির ওই মহল্লায় কয়েকশো ধর্মপ্রচারককে থাকতে দেখা যায়। একটি খবরে সবার বুক কেঁপে ওঠে যে, ওই সমাবেশ থেকে বাড়ি ফিরে কিংবা ফেরার পথে জানা দশেক মানুষ মারা গিয়েছেন। তাঁদের মৃত্যুর কারণ কোভিড-১৯! মৃতদের মধ্যে ৬ জন তেলেঙ্গানার, একজন করে কাশ্মীর, কর্ণাটক, তামিলনাড়ুর। একজন আবার ফিলিপিন্সের বাসিন্দা। ওই সমাবেশ ফেরত ৪ শতাধিক মানুষের মধ্যে করোনা উপসর্গ দেখা দিয়েছে। তাঁরা ক্যাজুয়ালি দেশের নানা প্রান্তে ছড়িয়ে গিয়েছেন। ৩১ মার্চ দিল্লির স্বাস্থ্যমন্ত্রী সত্যেন্দ্র জৈন জানান, দিল্লিতে ২৪ জনের দেহে কোভিড-১৯ সংক্রমণের প্রমাণ মিলেছে। নিজামুদ্দিনে যোগ দিয়েছিলেন বাংলারও ৭৩ জন। ৩১ মার্চ পর্যন্ত ১৪ জনকে শনাক্ত করে হোম কোয়ারেন্টাইনে পাঠিয়েছে রাজ্য সরকার। তবে বাংলার বাকিদের হদিশ এখনও মেলেনি। কলকাতা হয়ে আন্দামানেও ফিরে গিয়েছেন ১০ জন।
করোনা নিয়ে আমাদের ভরসা ছিল যে, রোগটার সঙ্গে বিদেশের কোনও-না-কোনও যোগ রয়েছে। গোষ্ঠী সংক্রমণের ভয়টা আমরা এতদিন পাইনি। এবার একটু একটু করে পেয়ে বসছে স্থানীয় স্তরেও রোগ ছড়াবার আশঙ্কাটি। দিল্লির ঘটনা দু’টি নিয়ে দায় এড়ানোর প্রতিযোগিতায় নেমেছে বিজেপি এবং আম আদমি পার্টি। তার ভিতরে সুরাহার কোনও দিশা নেই। ভারত আর ক’দিন স্টেজ-২ দখলে রেখে করোনামুক্ত হওয়ার লড়াইটা চালাতে পারবে, সেই ব্যাপারে বিরাট প্রশ্নচিহ্ন উঠে পড়েছে। আমরা কি বড্ড বেশি আত্মবিশ্বাসী হয়ে পড়ছি? ব্যাপারটি হঠকারিতার নামান্তর হয়ে উঠবে না তো? সামনে চীন ইতালি স্পেন ইরান ব্রিটেন আমেরিকার মতো বিভীষিকা রূপ একগুচ্ছ ঘটমান বর্তমানকে রেখেও আমরা এতটা বেপরোয়া হতে পারছি! ঈশ্বর কি আমাদের ক্ষমার যোগ্য মনে করবেন আর? চীন বা আমেরিকার মতো রূপকথার পাখির জান নিয়ে কি জন্মেছে ভারত রাষ্ট্র? আমরা যেন কোনওভাবেই ভুলে না যাই যে, ছিয়াত্তর (১৭৬৯ খ্রিস্টাব্দ বা ১১৭৬ বঙ্গাব্দ) আর পঞ্চাশের মন্বন্তরের (১৯৪৩ খ্রিস্টাব্দ বা ১৩৫০ বঙ্গাব্দ) ধাক্কা এখনও কাটিয়ে উঠিনি আমরা। কোথাও যেন দাগা দিয়ে চলেছে সেই ধূসর স্মৃতি।