কর্মপ্রার্থীদের ধৈর্য্য ধরতে হবে। প্রেম-প্রণয়ে আগ্রহ বাড়বে। নিকটস্থানীয় কারও প্রতি আকর্ষণ বাড়বে। পুরোনো কোনও বন্ধুর ... বিশদ
কিন্তু কেন এমন হল? কার দোষ? মানুষের কোন ভুলে আজ তার এই পরিণতি? মানুষ নিজেই তো এক শক্তিধর প্রাণী। বুদ্ধিবলে এবং বাহুবলে। অন্তত নিজেকে সে তাই ভাবে। এই গ্রহের অন্য প্রাণীদের সে পরোয়া করে না। প্রকৃতিকে কোনও মূল্যই দেয় না মানুষ। সে মনে করে তার হাতেই সবকিছু। এই পৃথিবীর নিয়ন্ত্রক সে। একটা বোতাম টিপে কোটি কোটি মানুষকে মেরে ফেলার ক্ষমতা তার আছে। সব কিছু নিমেষে ধ্বংস করে দেবার বলে সে বলীয়ান। কিন্তু মানুষ করোনা ভাইরাসকে মারতে পারছে না। অসহায়ের মতো প্রতিদিন আমরা তিল তিল করে তার কাছে আত্মসমর্পণ করছি। ৩৮ হাজার মানুষকে সে নির্মমভাবে শেষ করে দিয়েছে। আক্রান্ত প্রায় আট লক্ষ মানুষ। আরও অসংখ্য মানুষের ভবিষ্যৎ তার হাতে। তার আগ্রাসী আক্রমণের সামনে আমরা টুকরো টুকরো হয়ে যাচ্ছি। বসন্তের বাতাস জুড়ে ছড়াচ্ছে মৃত্যুর গন্ধ। মৃত্যুর এক অদৃশ্য সারিতে কি আমরা সবাই দাঁড়িয়ে আছি? এমন বসন্ত আমরা তো চাইনি! না চাইলেও এটাই বাস্তব। এটাই আজ সত্য।
একটু ভেবে দেখলেই বোঝা যাবে, এই ‘বসন্ত’ আমরাই তৈরি করেছি। অহঙ্কারী মানুষ, স্বার্থোন্মত্ত মানুষ, শক্তি মদমত্ত মানুষ। সে মনে করে এই পৃথিবী তার একার। এই পৃথিবী সে নিজেই সাজাতে পারে, আবার ধ্বংসও করতে পারে। প্রকৃতি আবার কী? ফুঃ! মানুষ গাছ কাটছে নির্বিচারে! নদীর পথ ঘুরিয়ে দিচ্ছে, পাহাড় ভাঙছে নিজের স্বার্থে, ছিন্ন-বিচ্ছিন্ন করে দিচ্ছে জীব বৈচিত্র্যের প্রাকৃতিক শৃঙ্খল। আমাদের সভ্যতা যত এগিয়েছে, ততই পিছনে ফেলে এসেছি আমরা ব্যভিচারের উচ্ছ্বিষ্ট চিহ্ন।
তারই মূল্য বুঝি আজ আমরা চুকিয়ে চলেছি। প্রকৃতি কি আজ তবে জেগে উঠল প্রতিশোধের বাসনায়? আমরা জানি না কাল কী হবে। কিন্তু আমরা যদি মনে করি, আর কিছুদিনের মধ্যেই করোনা দুর্বল হয়ে যাবে, সে পৃথিবী থেকে পাততাড়ি গুটিয়ে চলে যাবে, তবে আমরা আবার মূর্খামি করব। এক মূর্খামির মূল্য আমরা দিচ্ছি, কিন্তু তার মূল্য চোকানোর পালা শেষ হয়নি। এ প্রসঙ্গে বিখ্যাত একজন মানুষ ডক্টর অ্যান্থনি ফাচির কথা বলব। সংক্রমণ রোগের তিনি একজন বিশ্ববিখ্যাত মার্কিন চিকিৎসক। আমেরিকা যখন দেখল করোনা তার হাতের বাইরে চলে যাচ্ছে, তখন ট্রাম্প তড়িঘড়ি ৭৯ বছর বয়সের এই ডাক্তারকে ডেকে এনে বললেন, ‘আমাদের দেশকে রক্ষা করুন’।
আমরা জানি, প্রথম যখন আমেরিকায় করোনা ভাইরাসের সংক্রমণ দেখা যায়, তখন মার্কিন প্রেসিডেন্ট এটাকে তেমন গুরুত্বই দেননি। বলেছিলেন, ওসব লকডাউনের দরকার নেই। রাজার সেই ভুলের মাশুল আজ গুনতে হচ্ছে। দেখতে দেখতে মৃত্যুসংখ্যা সেখানে তিন হাজার ছাড়িয়েছে। আক্রান্তের সংখ্যা দেড় লক্ষের বেশি। কোথায় গিয়ে থামবে করোনার এই অশ্বমেধের ঘোড়া? একমাত্র শক্তি আছে লকডাউনের। বিচ্ছিন্নতাই আজ মানবজাতির প্রকৃত ভবিষ্যৎ।
ট্রাম্পের কথা শোনার পর খুবই অসহায় দেখাচ্ছিল ডাক্তার ফাচির চোখ দুটো। শুধু বিড় বিড় করে তিনি বলেছিলেন, ‘খুব দেরি হয়ে গিয়েছে। খুব দেরি হয়ে গিয়েছে।’ তিনি অনেক কষ্ট চেপে যে ছবিটা তাঁর অভিজ্ঞতা দিয়ে দেখতে পাচ্ছিলেন, সেটাকে ব্যক্ত করলেন। বললেন, ‘এই ভয়ঙ্কর ভাইরাসে আমেরিকার দেড় থেকে দু’ লক্ষ মানুষের মৃত্যু হতে পারে।’ কথাটা কয়েকদিন আগেই তিনি ট্রাম্পকে জানিয়ে দিয়েছেন। সেদিন হোয়াইট হাউসের রোজ গার্ডেনে বসেছিল জরুরি সভা। সেখানেই ফাচি একথা ট্রাম্পকে জানিয়ে দেন। প্রথমে ট্রাম্প ভেবেছিলেন বিশেষ সতর্কতামূলক ব্যবস্থা আর নেওয়ার দরকার নেই। কিন্তু ফাচি তাঁকে বলেছেন, আমেরিকা এই মুহূর্তে করোনা ভাইরাসের এপিসেন্টার। আরও কড়া পদক্ষেপ নিতে হবে। আর মানুষে মানুষে দূরত্ব বাড়াতেই হবে। দূরত্ব তৈরি করেই এই কীটকে মারতে হবে। শুনে ট্রাম্পের মুখ ফ্যাকাশে হয়ে গিয়েছিল। তিনি কি নিজেকে অপরাধী ভাবছেন? একেবারে গোড়ায় সক্রিয় না হওয়াটাই কি কাল হল? দেরিতে হলেও আমেরিকা বুঝেছে, সামাজিক দূরত্ব বজায় রাখতে না পারলে, দেশটা একেবারে খালি হয়ে যাবে।
পশ্চিমী দেশগুলির এই উন্নাসিক মানসিকতা, এই আমল না দেওয়াটা আমাদের কাছে একটা বিরাট শিক্ষা হতে পারে। বিশ্বের তাবড় ধনী দেশগুলি করোনার কাছে পদানত প্রায়। আমেরিকা, ইতালি, ফ্রান্স, স্পেন। পশ্চিমী দুনিয়া তার অর্থভাণ্ডার উজাড় করেও একে প্রতিহত করতে পারছে না। সুতরাং অর্থ দিয়ে এই মুহূর্তে এই কীটকে মারা যাবে না। এটা প্রমাণিত। একমাত্র লকডাউন দিয়ে আমরা মারব করোনা কীটকে। আমরা ওদের মতো ভুল করিনি। আমরা ঠিক সময়ে ঠিক পদক্ষেপ নিয়ে এর বিরুদ্ধে যুদ্ধে নেমেছি। কেননা, আমরা জানি, এছাড়া আর কোনও উপায় নেই। যদিও আমাদের মতো দরিদ্র, কম শিক্ষিত দেশে এটা খুবই কঠিন। যে দেশে মানুষ একদিন রোজগার না করলে তাকে না খেতে পেয়ে থাকতে হয়, সে দেশে এটা মানা সত্যিই কষ্টকর। তবু আমাদের মানতেই হবে। বুঝতে হবে, মৃত্যুকে এড়াতে গেলে ঘরে থাকতেই হবে। একমাত্র এটাই পথ।
আমাদের রাজ্য সরকারও মানুষকে বুক দিয়ে বাঁচাতে নেমে এসেছে পথে। প্রতিটি মুহূর্তে মানুষের কাছে সরকার পৌঁছে যাচ্ছে। বুঝিয়ে দিচ্ছে সরকার আছে মানুষের পাশেই। রাজ্য সরকারের প্রতিটি পদক্ষেপে ফুটে উঠছে গভীর মমতা। হতেই হবে। এ রাজ্যের মুখ্যমন্ত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় নিজেই যেন মমতার এক প্রতিমূর্তি। বিশেষ করে যে কোনও সময়ে যে কোনও বিপন্ন মানুষের তিনি যেন ছায়াসঙ্গী হয়ে ওঠেন। আজ এই মুহূর্তে মুখ্যমন্ত্রী যেন মা দুর্গা। দশ হাতে তিনি সামলাচ্ছেন দশদিক। ফেসবুক, সোশ্যাল সাইট ঘিরে দেখতে পাচ্ছি, মানুষ তাঁর প্রতি কতটা শ্রদ্ধাশীল। এই বন্দনা গান সাধারণ মানুষেরই। সেই সারিতে বিরুদ্ধরাও রয়েছেন। যদিও এখন রাজনীতির সময় নয়, তবুও কেউ কেউ রাজনীতি করে যাচ্ছেন। কেননা ভয় পেয়েছেন তাঁরা। করোনার ভয় নয়, সে ভয় রাজনীতির অঙ্কের ভয়। এখন বসে বসে কেউ কেউ ভোটের পাটিগণিত কষছেন। ভাবছেন এই রে, যেভাবে রাজ্যবাসীর মনে মমতা সম্পর্কে নতুন আবেগ তৈরি হচ্ছে, সেটা যদি আগামীদিনে সবটাই তাঁর ভোটবাক্সে যায়? সেইসব ছিদ্রন্বেষী নেতারা থাকবেন। আমরা দেখেছি কোনও কোনও নেতা করোনা রুখতে গোমূত্র পান করিয়ে যেমন কিছু মানুষের ক্ষতি করেছেন, তেমনি নিজেদের অশিক্ষিত মানসিকতা প্রকাশ করে মানুষের হাসির খোরাক হয়েছিলেন। এই বিপন্ন সময়ে তাঁদের কাছে অনুরোধ, এখন মুখে কুলুপ এঁটে ঘরে বসে থাকুন।
এতদিন আমরা তো ধর্মের পিছনে অনেক ছুটলাম, কী হল? ইতিহাস বলছে, ধর্ম বহু ক্ষেত্রে হিংসার পথকেই প্রসারিত করেছে। আজ দেখুন এই দুঃসময়ে দেশের সব ‘জাগ্রত দেবতার’ মন্দির বন্ধ। বন্ধ অন্য ধর্মস্থানগুলি। ভগবান নিদ্রা গিয়েছেন, করোনা সইতে পারেন না। এই পরিপ্রেক্ষিতে একটি কথা মাথায় এল। সেটি হল, এই যে দেশজুড়ে বিভিন্ন মন্দিরে শত শত কোটি টাকার সম্পত্তি, তহবিল— সেগুলি কি মানুষের কাজে লাগানো যায় না? এইসব মন্দিরের সম্পত্তি তো মানুষের দানেই গড়ে উঠেছে। তাই আজ মানুষের দুঃসময়ে ভগবান এগিয়ে এসে সেই সম্পত্তি মানুষের সেবায় দান করুন। কিংবা যেসব ধর্মগুরু বিশাল সম্পত্তির মালিক, তাঁর সম্পত্তি নিয়ে মানুষের সেবায় লাগানো হোক। এসব সম্পত্তি বহুক্ষেত্রেই অন্যায়ভাবে তৈরি হয়েছে। গত কয়েক বছরে গুরুজিদের ইতিহাস ঘাঁটলেই তা বোঝা যাবে।
আমাদের এখন উৎসবের সময় বাসন্তী পুজো, অন্নপূর্ণা পুজো, রামনবমী, নীল পুজো, গাজন। এসবকে আমরা এখন দূরে সরিয়ে রেখে করোনাকে আটকানোর চেষ্টা করছি। এটাই ঠিক কাজ। উৎসব আবার আসবে। আবার আমরা সবাই মেতে উঠব মিলনের উৎসবে। তার আগে কঠিন পরীক্ষা। সেই পরীক্ষায় আমাদের পাশ করতেই হবে। কেন্দ্র ও রাজ্য যেভাবে চেষ্টা করছে, তার সঙ্গে সহযোগিতা করাই এই মুহূর্তে সব থেকে বুদ্ধিমানের কাজ। আমরা যদি সহযোগিতা না করি, তবে সাফল্য কিন্তু আসবে না। সব শ্রম পণ্ড হবে। নিজেদের প্রশ্ন করুন, আমরা কি আর একটা ইতালি, কিংবা আমেরিকা বা ফ্রান্স চাই? যদি না চাই, তবে আমাদের ঘরের জীবনকেই মেনে নিতে হবে।
নাহলে মনুর বা নোয়ার নৌকার গল্পটাই সত্যি হয়ে উঠবে। পৃথিবীর প্রলয়কালে পৃথিবীর বিভিন্ন প্রজাতিকে বাঁচাতে মানুষ নৌকায় ভেসে পড়েছিল অনির্দেশ্য পথে। পুরাণ ও বাইবেলের এই কল্পকাহিনি যেন বাস্তব না হয়ে ওঠে।