আশীর্বাদ অনন্ত
তপনকুমার দাস
‘মা তুমি?’ দরজা খুলেই সামনে দাঁড়ানো পরমাকে দেখে চমকে ওঠে অভিজাত। প্রায় দেড় বছর পরে বাড়ির দরজায় দাঁড়ানো মাকে দেখলে অবাক না হয়ে উপায় কী?
‘একটু দেখতে এলাম। শ্বশুরের ভিটে, নিজের পাড়াটা—’
‘এসো, ভিতরে এসো।’ মায়ের হাত থেকে চামড়ার শান্তিনিকেতনি ব্যাগটা প্রায় কেড়ে নেয়— ‘দাও, ব্যাগটা দাও।’
‘ব্যাগ আর কী! একটা জলের বোতল আর ছাতা।’
‘একটা ফোন তো করতে পারতে। পরশুদিন অতক্ষণ কথা হল, একবারও তো বললে না।’
‘বললে কি আর চমক দেওয়ার মজা থাকত! তাছাড়া সকালবেলা হঠাৎ ঠিক করলাম—’ চৌকাঠ পার হয়ে সিঁড়ির ধাপে পা রাখেন পরমা।
‘তোমার হাঁটুর ব্যথাটা কী বেড়েছে?’
‘তেমন কিছু নয়। ওই অমাবস্যা-পূর্ণিমাতে...’
‘বসো, বসো। এতগুলো সিঁড়ি ভাঙলে। একটু জিরিয়ে নাও’— বারান্দার সোফার উপর থেকে সকালের ছড়ানো-ছেটানো খবরের কাগজ গুছিয়ে দেয় অভিজাত। জিজ্ঞাসা করে— ‘চা খাবে তো?’
‘না বাবা। চা খেয়েই বেরিয়েছি। আমাদের ওখানে সকালে ঠিক সাড়ে ছ’টায় চা দিয়ে দেয়। সাড়ে সাতটায় ব্রেকফাস্ট’— সোফায় বসতে বসতে শুনিয়ে দেন পরমা। জিজ্ঞাসা করেন— ‘বউমা, দাদুভাই, ওদের তো দেখছি না। টিউশন পড়তে গিয়েছে বুঝি?’
‘ওরা একটু চাকদায় গিয়েছে। রাকার মায়ের শরীরটা ভালো নেই’— মায়ের মুখোমুখি বসে অভিজাত।
‘কী হয়েছে বেয়ানের?’ উদ্বেগ ঝরে পরমার প্রশ্নে।
‘প্রেশার, সুগার— এইসব আর কী!’
‘তুই গেলি না?’ মুখে প্রশ্ন করলেও পরমা জানে অভিজাত শ্বশুরবাড়ির তেমন ন্যাওটা নয়।
‘গেলে কি তোমার সঙ্গে দেখা হতো? এতটা পথ ছুটে এসে তালাবন্ধ বাড়ি দেখে ফিরে যেতে। সেটা কি ভালো হতো?’ এতদিন পরে হঠাৎ মাকে কাছে পেয়ে খুশি চাপতে পারে না অভিজাত। চঞ্চল চনমনে হয়। এক লাফে উঠে দাঁড়ায় সোফা ছেড়ে— ‘টোস্ট খাবে মা? মুচমুচে টোস্ট? মাখন মাখিয়ে। গোলমরিচের গুঁড়ো দিয়ে?’
‘না রে। পাউরুটিতে আজকাল অম্বল হয়। আমার ব্যাগটা দে তো, একটু জল খাই।’
‘কখনকার বাসি জল, খেতে হবে না’, এক ছুটে রান্নাঘরে ঢুকে যায় অভিজাত। তাড়াতাড়ি জলের বোতল এনে তুলে দেয় মায়ের হাতে— নাও।’
বেশি নয়, মাত্র দু’ঢোক জল গলায় ঢালেন পরমা। তারপর দু’চোখ ভরে পান করা শুরু করেন বৈঠকখানাটা। সব ঠিক আছে। যেমন ছিল, ঠিক তেমনই। শুধু ছবিটা নেই। সেই ছবিটা— মরুভূমির মাঝে কঙ্কালের মতো ডানা মেলে দাঁড়িয়ে থাকা ক্যাকটাসের ছবিটা। পরমার কলেজ জীবনে আঁকা ছবি। পুরস্কারও পেয়েছিলেন ছবিটার জন্য। বিয়ের পর অভিজাতের বাবা স্বরূপরতন বাঁধিয়ে, নিজের হাতে ছবিটাকে ঝুলিয়ে দিয়েছিলেন দেওয়ালে।
‘কী দেখছ মা?’
‘না, কিছু না’— ভাবনা ভাঙা দীর্ঘশ্বাস নিজের অজান্তে বেরিয়ে আসে পরমার বুকের খাঁচা ছেড়ে। কত সাধের, কত যত্নের, কত আদরের, কত কষ্ট পরিশ্রমের ঘর সংসারটাই যখন নেই তখন কবেকার পুরনো সামান্য একটা ছবির খোঁজ করে কী হবে। আসলে মায়া। মানুষ তো সহজে মায়ার গণ্ডি ছেড়ে বাইরে আসতে পারে না।
‘ঝুল ঝাড়তে গিয়ে গত রবিবার ছবিটা পড়ে গিয়েছিল দড়ি ছিঁড়ে। সোমবার দোকানে দিয়ে এসেছি। কাল ডেলিভারি দেবে’— মায়ের মনের সূক্ষ্ম অনুভূতিটা বুঝতে দেরি হয় না অভিজাতের।
‘সীমা এখনও রান্না করছে? কখন আসে?’ ছবির প্রসঙ্গ থেকে মন তুলে নেন পরমা।
‘তুমি চলে যাওয়ার মাসেই সীমামাসি কাজ ছেড়ে দিয়েছে। এখন রান্না করে পুষ্পদি। আজ ওরা বাড়ি থাকবে না, তাই ছুটি নিয়েছে।’
‘তুই খাবি কী?’ উদ্বিগ্ন হন পরমা।
‘সকালে টোস্ট, দুপুরে হোম সার্ভিস। তুমি কী খাবে বলো মা’, ধপ করে মায়ের পায়ের গোড়ায় মেঝেতে বসে পড়ে অভিজাত।
পরমার মুখে কোনও উত্তর শোনার আগেই জিজ্ঞাসা করে, ‘ভেজ ফ্রায়েডরাইস, সঙ্গে পনির বাটার মশলা আর এঁচোড়ের কোপ্তা বলে দেব?’
‘পাগল ছেলে। ওঠ, উঠে বস। আমি কি ওসব খাই নাকি?’ অনেকদিন পরে ছেলের মুখের এমন আন্তরিক প্রস্তাব শুনে পরমার বুকের গভীর প্রদেশটা মুচড়ে ওঠে। চোখের জলে ভেসে যেতে ইচ্ছে করে।
‘তোমাকে দুটো রুটি করে দেব মা? ঘি মাখিয়ে চিনি দিয়ে মুড়িয়ে খাবে? ডান হাতে রান্না করতে করতে বাঁ হাতে ধরে যেমন খেতে ঠিক তেমনি করে খাবে?’ নস্টালজিক হয়ে ওঠে অভিজাত।
‘তুই করবি রুটি? আফ্রিকা না দক্ষিণ আমেরিকার ম্যাপের মতো?’ শব্দ করে হেসে ওঠেন পরমা। অনেকদিন আগে, স্বরূপ তখন সবে মারা গিয়েছেন, জ্বরে শয্যাশায়ী পরমা আর নিজের জন্যে রুটি তৈরি করেছিল অভিজাত। আধমাখা আটা বেলে আফ্রিকা, আমেরিকার ম্যাপের মতো রুটি। সঙ্গে হলুদ আর ফোড়ন ছাড়া আলুর নুনে পোড়া ঝোল। জ্বরের বিস্বাদ মুখে ছেলের আন্তরিকতা মাখানো সেই খাবার পরম তৃপ্তিতে খেয়েছিলেন পরমা।
‘না মা, আফ্রিকা আমেরিকা নয়, এখন আমি পূর্ণিমার চাঁদের মতো গোল রুটি বানাতে শিখে গিয়েছি।’ বেশ গর্বের সঙ্গে জানিয়ে দেয় অভিজাত।
‘তোকে আজকাল রুটি বানাতে হয়?’ অবাক পরমা দুঃখ পান মনে।
‘না ঠিক তা নয়, তোমার বউমা বলে অফিস ফেরত ছ’টা রুটি কিনে আনলেই তো হয়। কিন্তু আমি আনি না। ঘাম টুপটুপে মানুষগুলোর রুটি বানানো দেখলে খেতে ইচ্ছে করে না,’ জানিয়ে দেয় অভিজাত।
‘বউমা? বউমা কী করে? ছ’টা রুটি বানিয়ে নিতে পারে না?’ ছেলের কথা কেড়ে নেন পরমা।
‘ওর সময় কোথায় বলো? সন্ধের পর বাপনকে সামলাতে হয়। হোমওয়ার্ক করিয়ে দিতে হয়। আজকাল যা দুষ্টু হয়েছে...’
‘তুইও দুষ্টু কম ছিলি না। একটা দড়ি তোর কোমরের সঙ্গে আমার কোমরে বেঁধে একা হাতে সংসারের সব কাজ সামলাতাম। মুখে মুখে পড়াতাম বর্ণপরিচয়, ছড়া শেখাতাম,’ বলতে বলতে উঠে দাঁড়ান পরমা। পরিচিত করিডোর বেয়ে ঢুকে যান স্নানঘরে। বাইরে থেকে এসেছেন, হাত-পা না ধুয়ে তো আর রান্নাঘরে ঢোকা যায় না।
মা উঠে যেতেই ব্যস্ত হয়ে পড়ে অভিজাত।
আজই ছুটি নিতে হল পুষ্পকে? হোম ডেলিভারির খাবার মা খাবেন না। যতই নিরামিষ হোক পেঁয়াজ, রসুনের ছোঁয়াছুঁয়ি তো থাকে। এই ছোঁয়াছুঁয়ি নিয়ে রাকার সঙ্গে কম অশান্তি হয়নি। যার যা সংস্কার। রাকাকে বোঝানোর চেষ্টা করত অভিজাত। বোঝাত, সংস্কার এক ধরনের প্রত্যয়। কেউ যদি তার সংস্কারের ভিতর দিয়ে সুখ-শান্তি পায়, পাক না। পাল্টা তর্ক জুড়ত রাকা— সংস্কার নয়, কুসংস্কার। গেঁয়ো বিধবাদের মতো গোঁ তোমার মায়ের। ভাতের হাঁড়ির সঙ্গে মাছের বাটির ছোঁয়া লাগলে হাঁড়িসুদ্ধ ভাত আমিষ হয়ে যায়, জন্মেও শুনিনি। যত সব আদিখ্যেতা। ছেলের বউকে র্যাগিং করার ফন্দি। এই তো আমার বান্ধবী সুনন্দার শাশুড়ি, বিয়েবাড়ির ব্যাচে বসে কচরমচর চিকেন-মাটন চিবোয়। স্ত্রীর কথা শুনে বিরক্ত হতো অভিজাত। বলত, সংস্কার মানুষের ব্যক্তিগত ব্যাপার। কারও সংস্কারকে শ্রদ্ধা করতে না পারো, কোরো না, কিন্তু অশ্রদ্ধা করার অধিকার তোমার নেই। অমনি আগুনে ঘি পড়ত।
নিজের ঘরে চুপটি বসে সব শুনতেন পরমা। প্রথম প্রথম প্রতিবাদ করতেন। তারপর সব হাল ছেড়ে স্থবির হয়ে গিয়েছিলেন। অশান্তি আর লোকলজ্জার ভয়ে। সান্ত্বনা ছিল একমাত্র অভিজাত।
বাথরুমটা পরিষ্কার করাস না কেন রে? ছ্যাঁদলা পড়ে মেঝেটা একেবারে পিছল হয়ে আছে। কে কবে আছাড় খাবে।’ উদ্বিগ্ন পরমার গলা শুনলে কে বলবে প্রায় দেড় বছর এই সংসার থেকে নির্বাসিতা?
‘করব। রাজেশকে খবর দিয়েছি’, মায়ের হাতে গামছা তুলে দেয় অভিজাত।
‘তোর টোস্ট গরম করে দিই’, হাত-পায়ের জল মুছে রান্নাঘরে ঢুকে পড়েন পরমা। ঠিক আগে যেমন ঢুকতেন, নিজের গিন্নি-গিন্নি ভঙ্গিতে।
‘দরকার নেই। গরম করলে শক্ত চামড়া হয়ে যাবে। হাঁটু-কোমরের ব্যথা নিয়ে তোমাকে আর রান্নাঘরে ঢুকতে হবে না। বসো, আমি চা করছি। আগে তো কতবার চা খেতে।’ অভিজাতের মনে পড়ে— এই চা খাওয়া নিয়েও এ সংসারে অশান্তি কম হয়নি।
‘পারঘাটে বসে এখন আর কোনও ব্যথা নিয়ে ভাবি না। তুই যা, বসগে যা’— গ্যাস ওভেন জ্বালিয়ে চা বানানোর প্রস্তুতি শুরু করেন পরমা।
রান্নাঘরের চৌকাঠে গিয়ে দাঁড়ায় অভিজাত। ঠিক যেমন দাঁড়াত অনেক বছর আগে। তারিয়ে দেখত মায়ের রান্না করা। ফোড়নের গন্ধে বুক ভরিয়ে নিত। রাকা যখন রান্না করত তখনও দু’একবার এসে দাঁড়িয়েছে কিন্তু মায়ের রান্নার গন্ধ পায়নি।
ছেলের টোস্ট আর এক কাপ চা ডাইনিং টেবিলে রেখে নিজের চায়ের কাপ নিয়ে বসেন পরমা। ‘দুপুরের খাবারটা আমি করে দেব অভি?’
‘না না, তোমাকে কষ্ট করতে হবে না’— জানতে চায়, ‘তুমি কী খাবে?’
‘আমার জন্য চিন্তা করিস না। নুন-লেবু দিয়ে চিঁড়ে ভিজিয়ে খেয়ে নেব। চিঁড়ে আছে তো ঘরে?’
‘আচ্ছা মা, তোমার ওই রান্নাটা মনে আছে?’
‘কোন রান্না?’
‘সেই যে তুমি বাংলা নাম দিয়েছিলে রান্নাটার। ছানা-সব্জি?’ খুশিতে উছলে ওঠে অভিজাত। মায়ের হাতের রান্না খাওয়ার ইচ্ছে ঝড় তোলে মনের ভিতর। তাছাড়া এত বড় একটা দিনের দুপুরে মায়ের চিঁড়ে খেয়ে থাকাটাও পছন্দ নয়। স্মৃতির পলতে উস্কে দিলে মা হয়তো ছেলের প্রিয় খাবার বানানোর জন্য ব্যস্ত হয়ে পড়বে। সেই ইচ্ছেটা কাজে লাগাতে পারলে মায়ের চিঁড়ে খাওয়ার প্রস্তাবটাও নাকচ করা যাবে। রান্না করতে কী যে ভালোবাসতেন পরমা, অভিজাত ছাড়া আজ আর কেউই সে কথা জানে না। পরমা বলতেন, রান্নাটাও একটা উচ্চাঙ্গের শিল্প।
‘তুই খাবি?’ জানতে চান পরমা।
‘না থাক, তোমার কষ্ট হবে।’
‘সন্তানের জন্য মায়ের কখনও কষ্ট হয় না। সন্তানের আবদার পূরণ করতে পারলে মা বরং খুশিই হয়’— ছেলের আর নিজের খালি প্লেট তুলে রান্নাঘরে চলে যান পরমা। জানতে চান, ‘লক্ষ্মী এখনও কাজ করে?’
‘হ্যাঁ মা।’
‘পারে এই বয়সে?’
‘চালিয়ে দেয়। তাছাড়া কাজ না করেও তো উপায় নেই। খাবে কী?’
‘তা ঠিক। কটা টাকা দিয়ে যাব। ওকে দিয়ে দিস—’ মনে পড়ে পরমা যেদিন বাড়ি ছেড়েছিল সেদিন বুক ফাটিয়ে ডুকরে কেঁদেছিল মেয়েটা। শুধু লক্ষ্মী কেন, এই বাড়ির ইট, কাঠ, দরজা, জানলা, আলমারি বাসন-কোসন সবাই কেঁদেছিল। কোমর জড়িয়ে ধরেছিল বাপন— তুমি টাটা যেও না আম্মা। আমি একটুও দুষ্টুমি করব না। ফুঁপিয়ে লুটিয়ে পড়েছিল রাকা— সবাই আমাকেই দোষ দেবে। বলবে ছেলের বউয়ের অত্যাচারে শাশুড়ি বাড়ি ছেড়ে চলে গেল। রাকার মাথায় হাত রেখেছিলেন পরমা— না বউমা। কেউ কিছু বলবে না। আসলে একটা সময় সবাইকেই থামতে হয়। সুযোগ করে দিতে হয় নতুন প্রজন্মকে। অথচ আমরা তা করি না। করতে চাই না। আমৃত্যু ক্ষমতা আঁকড়ে ধরে অশান্তির দাবানলে পুড়তে চাই। সেই আগুন ছেড়ে একটু শান্তির খোঁজ করা, আমার জন্যে চিন্তা করো না। গুছিয়ে নিজের সংসার করো। বাপনকে মানুষ করো।
‘তুমি একটু বসো, আমি যাব যার আসব,’ পরমার স্মৃতির পুকুরে ঢিল ছুঁড়ে দেয় অভিজাত।
‘কোথায় যাবি?’ চোখের জল লুকিয়ে জানতে চান।
‘বাজারে। পনির আনতে।’
‘ঠিক আছে, যা।’ হেসে ফেলেন পরমা। বুঝতে পারেন, নিজের জন্য নয়, দুপুরবেলা মাকে একমুঠো ভাত খাওয়ানোর জন্যেই অভির এত তোড়জোড়। রাকা বাড়ি থাকলেও একই কাণ্ড করত। অনেক অনেক দিন নির্জন ঘরে নিজেকে কেটে ছিঁড়ে বিশ্লেষণ করেছেন পরমা। ছেলে, ছেলের বউ আর নিজেকে বিচার করার চেষ্টা করেছেন একান্ত নিরপেক্ষ হয়ে। কিন্তু না, দোষ-গুণের কোনও উপসংহারে পৌঁছাতে পারেননি। বারবার স্থগিত রাখতে হয়েছে রায়দান এবং শেষ পর্যন্ত নিজেকে সরিয়ে পালিয়ে গিয়েছেন সংসার ছেড়ে। তবে এখন, আর পাঁচজন সঙ্গীর জীবন উপন্যাস শুনে মনে হয় এই হঠকারিতা না করলেই হয়তো ভালো হতো। তাঁর জীবনের পদাবলি তো অনেক সহজ-সরল গদ্যে লেখা ছিল।
সব্জি কেটে হাঁড়িতে ভাত বসিয়ে দেন পরমা।
একটু পনির আনতে এত দেরি হচ্ছে কেন ছেলেটার। মশলার কৌটোগুলো খুলে দেখতে থাকেন। সব ঠিক আছে। তাঁর মতো করেই সংসার গুছিয়ে রেখেছে রাকা। পরমা খুশি হন মনে মনে। দায়িত্ব-কর্তৃত্ব না ছাড়লে পরের প্রজন্মের দায়িত্বজ্ঞান জানতে পারা যায় না। আনন্দ উদ্বেল মনে গুন গুন করেন রবীন্দ্রনাথের গান— ‘আমার বিচার তুমি করো তব আপন করে। দিনের কর্ম আনিনু তোমার বিচার ঘরে।’
‘কতদিন পরে তোমার গান শুনলাম। গলাটা কিন্তু...’
‘ওমা, তুই? কখন এলি? চুপি চুপি চুরি করে মায়ের হেড়ে গলার বেসুরো গান শুনছিলি বুঝি?’ ছেলেকে দেখে আনন্দে উছলে ওঠেন পরমা। শান্তিভবনে বসন্ত উৎসবের দিন নাচ-গানের অনুষ্ঠান হয়। বুড়ি বুড়ি আশ্রমিকরা নিজেরাই পারফর্ম করে। প্রথম বছর পরমার গান শুনে উমাদি বলেছিলেন, যাঁর গলায় এত সুর, তাঁর জীবনের সুর কাটল কেন?
‘এত সব কী এনেছিস? বাড়িতে কি কুটুম এসেছে?’ অভির হাত থেকে পনির, দই-মিষ্টির ক্যারিব্যাগ নিজের হাতে নেন পরমা।
‘ওষুধগুলো ঠিকমতো খাচ্ছ তো মা?’ প্রসঙ্গ বদলায় অভিজাত।
‘আজ ওষুধ আনতে ভুলে গিয়েছি—’
‘সে কী? নাম মনে আছে?’ উদ্বিগ্ন হয় অভিজাত।
‘একদিন একবেলা ওষুধ না খেলে এমন কিছু মহাভারত অশুদ্ধ হয়ে যাবে না। যা, তাড়াতাড়ি স্নান সেরে আয়। আমার রান্না এক্ষুনি হয়ে যাবে’— মুখে বললেও পরমা মনে মনে ভাবেন, আমার অবর্তমানে আমার শরীর নিয়ে অভি কি এমনই উদ্বিগ্ন হয়? হয়তো হয়, কারণ শান্তিভবনের অফিসে ফোন করলে ওষুধের কথাই তো সবার আগে জানতে চায়।
দুপুরে মা-ছেলে মুখোমুখি বসে খাওয়ার পর ছেলের বিছানাতেই শরীর এলিয়ে দেন পরমা। বিছানায় মায়ের পাশে গুছিয়ে বসে অভিজাত। ইচ্ছে করে মাথাটা মায়ের কোলে রেখে চোখ বন্ধ করে শুয়ে থাকতে। কিন্তু পারে না, মা যে এখন অনেক দূরে সরে গিয়েছে। ছোট্ট অভিও বড় হয়েছে।
‘তুই একটু শুবি না?’ জানতে চান পরমা।
‘না। আমি পাশের ঘরে যাই। তুমি ঘুমিয়ে পড়ো’, মুখে বললেও মাকে ছেড়ে যেতে ইচ্ছে করে না।
‘দাদুভাইয়ের জন্য মনটা খুব হু হু করে—’
‘বাপনও তোমাকে খুব মিস করে’ দীর্ঘশ্বাস ছাড়ে অভিজাত। তারপর সরাসরি জানতে চায়, ‘তুমি কি ফিরে আসতে পার না? আমরা কি এতই খারাপ? রাকা তো তোমার মেয়ের মতো।
‘মানুষ স্বাধীনতার কাঙাল। ওখানে গিয়ে বুঝতে পারলাম ঠিক সময়ে সরে যেতে না পারলে শান্তি পাওয়া যায় না। নিজের জীবনের না পাওয়া দিনগুলো পরের প্রজন্মকে ফিরিয়ে দিতে হয়।’
‘কিন্তু মা...’
‘সব কিন্তুর উত্তর আমি পেয়ে গিয়েছি বাবা। দূরে না গেলে প্রিয়জনের প্রতি টানের গভীরতা বোঝা যায় না। বউমা, দাদুভাইয়ের সঙ্গে দেখা হল না’— খাট ছেড়ে মেঝেয় পা রাখেন পরমা।
‘ওরা তো কালই চলে আসবে। রাতটুকু থেকে যাও,’ মনটা ভারী হয় অভিজাতের।
‘দুর্বলতাকে কখনও প্রশ্রয় দিতে নেই বাবা’—
‘এটা রাখো। তোমার যে মডেলটা ছিল, সেই মডেল। ব্যবহার করতে কোনও অসুবিধা হবে না,’ পনির আনতে গিয়ে মায়ের জন্য কেনা মোবাইল ফোনের প্যাকেটটা পরমার হাতে গুঁজে দেয় অভিজাত।
‘মোবাইল ফোন? না রে, আমি ইচ্ছে করেই ব্যবহার করি না। কারণ এটাও একটা মায়া। একটা পিছুটান। একটা জাল। যে জাল ছিঁড়তে চেষ্টা করছি, সেই জালে আর নিজেকে জড়াতে চাই না,’ মোবাইল ফোনের প্যাকেটটা খাটের উপর রেখে দেন পরমা।
‘তুমি বড্ড জেদি মা’, পরমার প্রত্যাখ্যানে কষ্ট দেয়।
‘জেদ নয়, মুক্তির চেষ্টা’, নিজের ভঙ্গিতে হাসেন।
বাথরুমে চলে যান তৈরি হওয়ার জন্যে।
উদাস অভিজাতের বুকের ভিতরটা শূন্য হয়ে ওঠে। এমন সংসার তো সে চায়নি।
‘এই উইলটা একবার দেখে রাখিস’, তৈরি হয়ে এসে বাদামি কাগজের খামটা বিছানার উপর রাখেন।
‘উইল?’ অবাক হয় অভিজাত।
‘হ্যাঁ। জীবনকে কি বিশ্বাস করতে আছে বাবা? কথায় বলে না, ঘুম ভাঙলে সকাল, না ভাঙলে পরকাল। তাই ভাবলাম’...
‘কিন্তু?’
‘বাড়িটা দাদুভাইয়ের’, ছেলেকে থামিয়ে মাথার কাঁচাপাকা চুলে চিরুনি ঠেলে দেন পরমা, ‘হৃদয়পুরের জমিটা বউমার নামে লিখে দিয়েছি। ফিক্সড ডিপোজিটের টাকাগুলো তুলে একটা স্কুল করে দিস। আমার সোনাদানা সব আলমারিতেই আছে। বউমাকে ব্যবহার করতে বলিস।’
‘কিন্তু মা—’
‘তোকে যা দিয়েছি, তা উইলে লেখা নেই—’
বলতে বলতে মনে মনে হেসে ফেলেন পরমা। সব মায়েরাই তো সন্তানদের জন্য আজীবন অনন্ত আশীর্বাদ দান করে যান। যা স্থাবর অস্থাবর সম্পত্তির পরিমাপে ওজন করা যায় না।
‘আমার কিচ্ছু চাই না, কিচ্ছু না...’ চোখের জল সামলাতে ছুটে পালায় অভিজাত।
15th March, 2020