কর্মপ্রার্থীদের ধৈর্য্য ধরতে হবে। প্রেম-প্রণয়ে আগ্রহ বাড়বে। নিকটস্থানীয় কারও প্রতি আকর্ষণ বাড়বে। পুরোনো কোনও বন্ধুর ... বিশদ
বেথুন সাহেব তো চলে গেলেন। বিদ্যাসাগরের চোখের জল আর শুখোয় না। কিছু আর ভালো লাগে না তাঁর। মনে মনে ঠিক করলেন— তবে আর কোন মায়ায় পড়ে থাকব বেথুন বিদ্যালয়ের সেক্রেটারির পদ আঁকড়ে ধরে। নিজেই সে কথা লিখে গিয়েছেন— ‘যে মহাত্মার অবিচলিত অধ্যবসায়ে এই বিদ্যালয় প্রতিষ্ঠিত, যিনি উহার প্রাণ, তিনিই যখন জন্মের মতো চলিয়া গেলেন, তখন আর এ বিদ্যালয়ের সঙ্গে সম্পর্ক রাখিতে প্রবৃত্তি হয় না।’ তবুও এই বিদ্যালয় নিয়েই তো সব বন্ধন। কাজ করে যান, কিন্তু কায়া নেই, শুধু ছায়া নিয়ে কর্তব্যসাধন।
এদিকে সংস্কৃত কলেজের কত কাজ বাকি। যখন পড়াশোনা করতেন, তখন কোথায় এই প্রতিষ্ঠানের গলতি, কোথায় এর সংশোধন করতে হবে, রং-রিফু করে এর উন্নতি ঘটানো সম্ভব তা ভাবতেন। তাই নজরে এল বিশেষ করে এর ইংরেজি বিভাগের খুঁড়িয়ে চলা। অমনি একটা রিপোর্ট লিখে পাঠিয়ে দিলেন শিক্ষা সংসদে। কতজন নতুন শিক্ষকের প্রয়োজন, পুরনো শিক্ষকদের দিয়ে কাজ চলছে না, তাঁদের বদলি আনতে হবে। মাইনে বাড়াতে হবে, নইলে ভালো শিক্ষক কী করে পাওয়া যাবে। অন্তত সত্তর থেকে নব্বই টাকা দিতেই হবে। এছাড়া পরিকাঠামোর উন্নতির জন্যে যা করণীয় সেগুলোও করতে হবে। ছাত্র আকর্ষণ করতে হবে। পাঠক্রমের অন্তর্ভুক্ত বইগুলো বদলে দিয়ে যেগুলোর কার্যকারিতার সঙ্গে সাহিত্যমূল্যও আছে— সেগুলো বেছে আনতে হবে। অশ্লীলতা বর্জন করতে হবে— নইলে ছাত্র-শিক্ষক উভয়েই বিড়ম্বনার শামিল হন। এ জন্যে বই ছাপতে হবে, না হলে লেখকদের দিয়ে পুঁথি নকল করাতে হবে। বাংলা ও বাঙালির উন্নতিই তাঁর একমাত্র ধ্যানজ্ঞান। এজন্যই সমাজ-সংস্কারের সঙ্গে সঙ্গে শিক্ষা-সংস্কারেও মন দিতে হবে। একটা ‘বেতাল পঞ্চবিংশতি’ বা একটা ‘চরিতমালা’, ‘সীতার বনবাস’ দিয়ে কাজ হবে না। আরও আরও বই লেখাতে হবে, লিখতে হবে। এ জন্য প্রয়োজনে অন্য ভাষার বই অনুবাদ করতে হবে। আপাতত হিন্দি, সংস্কৃত আর ইংরেজি থেকে অনুবাদের কাজ করতে হবে, তার সঙ্গে চাই প্রাথমিক জ্ঞানের জন্যে রিডার জাতীয় বই। তার প্রস্তুতি চলতে লাগল— আমরা পরে পরে দেখব সে সব।
আর একটা কাজ করতে হবে— অত জাতপাতের বিচার করলে তো শিক্ষার প্রসার হবে না। সংসারে কি শুধু ব্রাহ্মণ-কায়েস্থরাই পড়াশোনা করবে! অথচ সংস্কৃত কলেজ যাঁরা স্থাপন করেছেন তাঁরা ওই পুরনো ধারাটাই বজায় রাখার পক্ষপাতী। শূদ্রের ছেলে সংস্কৃত পড়ে পণ্ডিত হবে! তারাই উপাধি পেয়ে বামুন কায়েতদের পড়াবে। সমাজে পাতক হবে না। আস্তাকুঁড়ের এঁটো পাতার স্বগগে যাবার আশা। হায় কী কলি এ কী হবে গরুড় হবেন মশা গো!
যেই ভাবা অমনি কাজে নেমে পড়লেন। ফতোয়া জারি করলেন কর্তৃপক্ষের অনুমতি নিয়ে— এবার থেকে সংস্কৃত কলেজে পাঠ্য সব বিভাগেই ব্রাহ্মণ ছাড়া অন্য জাতির সন্তানরাও পড়তে পারবেন, এ জন্য দরখাস্ত আহ্বান করা হচ্ছে। অমনি গরম তেলে জলের ছিটে পড়ল। সমাজ একেবারে ভেস্তে যাবে! বিদ্যাসাগর জানেন— ওরা দু’-চার দিনের জন্যে তড়পাবে, তারপরে যেই শূদ্র মানুষের চাপ পড়তে লাগবে— তখন সব তাঁরই ইচ্ছেমতো হবে। বিদ্যাসাগরই বিদ্যালয় প্রাঙ্গণে শিক্ষার সূর্যতোরণটি খুলে দিয়ে অস্পৃশ্যতা দূরীকরণের স্বর্ণদ্বারটি খুলে দিলেন। ব্রাহ্মসমাজে পৈতে খুলে ফেলার কাজটা শুরু হয়েছিল বটে। বিদ্যাসাগর সেই যে জাতপাতকে ঢেউয়ের ধাক্কায় সরিয়ে দেওয়ার জন্য সাগরে যে ঢেউ তুললেন, তাতেই সমাজের টলমলানি দেখা দিলে আর সমগ্র বাঙালি জাতি নির্বিশেষে ‘তুমি ঊষার সোনার বিন্দু’ বলে তাঁর চরণে প্রণত হল। চিত্তের স্বাধীনতার বিধান না হলে কি রাষ্ট্রের স্বাধীনতা আসতে পারে। এই মানুষটাই গ্রামের চাষিভুষোর কাছে শিক্ষার সুযোগ পৌঁছে দেওয়ার জন্য নৈশ বিদ্যালয় স্থাপন করেছেন, বয়স্ক শিক্ষা কেন্দ্র করেছেন। আর সরকার গ্রামে গ্রামে বিদ্যালয় স্থাপন করার মাধ্যমে শিক্ষাকে সর্বজন সুখায় মন্ত্রের উচ্চারণ করার আগে ১৮৫৩ খ্রিস্টাব্দে নিজের জন্মস্থান বীরসিংহা গ্রামে একটি অবৈতনিক বিদ্যালয় খুলে বসলেন। মনে রাখতে হবে কিন্তু এই বিদ্যাসাগর মশায়ই অবৈতনিক সংস্কৃত কলেজে বেতন ছাড়া বিদ্যার্জন পূর্ণ হবে না— এই আন্দোলন তুলে একক চেষ্টাতেই সংস্কৃত কলেজে পড়তে হলে বেতন দিয়ে পড়তে হবে— এই নিয়ম প্রতিষ্ঠা করেছিলেন।
সেই বিদ্যাসাগর গাঁয়ে বিদ্যালয় খুলে সেখানে মাইনে দিতে হবে না— এই প্রথাই চালু করলেন। মনে রাখতে হবে কলকাতা আর বীরসিংহার মতো বাংলার হাজারো গ্রামে হাজারো তফাত। পড়াশোনা নেই বললেই চলে। তাদেরকে বিদ্যালয়মুখী করতে হবে— তারা তো স্কুল কী জিনিস তা জানেই না। তাছাড়া বিদ্যালয় খুলছেন যিনি তিনি তো শুধু বিদ্যাসাগর নন, করুণার সাগরও। যখন গাঁয়ে আসতেন সিকিটা-আনিটা-আধুলিটা-টাকাটা কাপড়ের খুঁটে বেঁধে আনতেন— গরিবের ছেলে দেখলেই তাদের দিয়ে তিনি ফতুর হতে যে বড্ড ভালোবাসতেন। কিন্তু শিক্ষক মশায়দের প্রাপ্য না দিলে বিদ্যাস্থানে দৈন্য দেখা দেবে জানতেন, তাই বরাবরই তাঁদের উপযুক্ত মাইনে দেওয়ার জন্যও তিনি মুক্তহস্ত। তিনি ধারই ধারতেন না কবে সরকার এই গ্রামীণ বিদ্যালয়ের জন্যে অর্থ মঞ্জুর করবে— তার জন্য বসে থেকে। প্রতিমাসে বীরসিংহার বিদ্যালয়ের জন্য তাঁর প্রায় তিনশো টাকা খরচ হতো। ১৮৫১ খ্রিস্টাব্দে তিনশো টাকার দাম একবার হিসেব করে দেখলে এত দিন পরেও আমাদের চক্ষু চড়কগাছ হয়ে যাবে। এই টাকা দিয়ে শিক্ষকদের বেতন, ছাত্রদের জন্য স্লেট-পেন্সিল বই-পত্তরের খরচারও সামাল দিতে হবে। এর ওপর গাঁয়ে মেয়েদের জন্যও স্কুল খুলেছেন। নৈশ বিদ্যালয়েরও একটা খরচ আছে— এইসব সামলে নিজের বইপত্তর কেনা, কাগজ-কলমের খরচের জন্য একটা বরাদ্দ রেখে সংসার চালাবার জন্য কত টাকা যে হাতে রইল ভাবতে গেলেই সেই পুরনো প্রবাদটাই মনে পড়ে যায়— হাতে রইল শুধু পেন্সিল। মোট বেতনের পরিমাণ পাঁচশো, তার প্রায় চারশোয় চলে যেত দান খয়রাতে। এ হিসেব আমরা করছি। কিন্তু গোপন হিসেব আমরা জানি না— এর জন্য তাঁকে প্রয়োজনে টাকা ধারও করতে হতো। ধার করে দান করার উদাহরণ খুঁজতে গেলে মনে হয় প্রথমেই বিদ্যাসাগরের কথা মনে পড়বে। বোধ হয় বড় সাক্ষী হিসেবে কবি মধুসূদন দত্তের নাম মনে আসবে এই সূত্রে।
বিদ্যাসাগরের দেখাদেখি নিশ্চয়ই নয়, সরকারের এডুকেশন কাউন্সিলও ভাবছিল গ্রামে গ্রামে নর্মাল স্কুল স্থাপন করার কথা। এই স্কুলের পড়ুয়াদের একটা বড় ভবিষ্যৎ ছিল— এখান থেকে পাশ করলে স্কুলে চাকরি পাওয়া খুব সহজ হতো। নর্মাল স্কুল খোলার প্রথম সুযোগেই বিদ্যাসাগর মশায় তাঁর সমবয়সি বন্ধু, তত্ত্ববোধিনী পত্রিকার সম্পাদক অক্ষয়কুমার দত্তকে শিক্ষক হিসেবে ঢুকিয়ে দিলেন, শুধু শিক্ষক নয়— একেবারে প্রধান শিক্ষক হিসেবে। এমনি করে চাকরি পান পণ্ডিত রামকমল ভট্টাচার্য মশায়ও।
(ক্রমশ)
অলঙ্করণ: সোমনাথ পাল