কর্মপ্রার্থীদের ধৈর্য্য ধরতে হবে। প্রেম-প্রণয়ে আগ্রহ বাড়বে। নিকটস্থানীয় কারও প্রতি আকর্ষণ বাড়বে। পুরোনো কোনও বন্ধুর ... বিশদ
ঋত্বিক ঘটকের ‘সুবর্ণরেখা’র মুখুজ্জেবাবুর মতোই জহর রায়ের আর এক কালজয়ী চরিত্র হাল্লা রাজ্যের ষড়যন্ত্রকারী মন্ত্রীমশাই। ধারে, ভারে, পপুলারিটিতে নিঃসন্দেহে কয়েক যোজন এগিয়ে। পরিচালক বলাই বাহুল্য, সত্যজিৎ রায়। কী সাংঘাতিক সে চরিত্র। ওঁর কাণ্ডকারখানা দেখে আমরা দর্শকরা যেমন হেসেছি বহুবার, কিন্তু সে তো আসলে ভয়ঙ্কর কুচক্রী একজন মানুষ। একমাত্র পূর্ণ ক্ষমতা ছাড়া তাঁর জগতের আর কোনও কিচ্ছুর দিকে লক্ষ্য নেই। অন্যদিকে ভাবুন,‘গুপী গাইন বাঘা বাইন’ ছোটদেরও কীরকম অসম্ভব প্রিয় একটা ছবি। জহর অভিনয়টাই এমন করলেন যে, মন্ত্রীমশাই একাধারে ভিলেন হলেও চোখে লাগার মতো ঘৃণ্য প্রতিপন্ন হলেন না। আবার পরতে পরতে যে হাসির উপাদান নেই, কার সাধ্য সে কথা বলে? বাচ্চাদের কাছে এই চরিত্র যেমন প্রিয়, তেমনই আবার বড়দের কাছেও একেবারেই ‘শিশুদের জন্য’ ঠেকে না। এরকম ব্যালান্স কি সকলে এত সহজে করতে পারেন!
রাজস্থানে আউটডোর শ্যুটিং চলছিল সত্যজিৎ রায়ের এই ‘গুগাবাবা’ ছবিরই। কলকাতায় অন্য শ্যুটিং পর্ব সেরে যোধপুর নেমে সেখান থেকে ট্যাক্সিতে করে রাত দশটায় জহর রায়ের জয়সলমির পৌঁছনোর কথা। ১১টা বাজে, ১২টা বাজে অথচ দেখা নেই জহরের। সকলকে উৎকণ্ঠায় রেখে শেষপর্যন্ত যখন পৌঁছলেন জহর রায়, ঘড়ির কাঁটা তখন প্রায় আড়াইটে ছুঁয়েছে। জানা গেল, যোধপুর থেকে যে গাড়িতে আসছিলেন তিনি, সেটি উল্টে গিয়েছিল মাঝপথে আর তাতেই বিপত্তি। নাকে ব্যান্ডেজ নিয়ে সত্যজিৎকে সেই ঘটনার বিবরণ দিতে বসলেন জহর। বললেন, ‘আরে মশাই— চাঁদনি রাত, ষাট মাইল স্পিডে দিব্যি গাড়ি চলছে। পিচ ঢালা সোজা রাস্তা, অন্য গাড়ির চলাচলও তেমন নেই। সর্দারজি ড্রাইভার বাঁ হাত নিজের কাঁধের পিছনে রেখে ডান হাতে আপেল ধরে তাতে কামড় বসাচ্ছেন। আর স্টিয়ারিংয়ে রেখেছেন নিজের ভুঁড়ি। সেই ভুঁড়ি একটু এদিক ওদিক করছেন, অমনি গাড়িও এদিক ওদিক ঘুরছে। কথা নেই বার্তা নেই এমন সময় রাস্তার মাঝে হুশ করে একটা খরগোশ এসে পড়ল। তাকে বাঁচাতে গিয়ে গাড়ি গেল উল্টে। আমার হুঁশ ছিল, দেখলাম আমি গড়াচ্ছি, আর আমার পাশ দিয়ে গড়াচ্ছে দুটো হোলডঅল। খটকা লাগল। সঙ্গে তো একটা হোলডঅল, দুটো এল কোত্থেকে? বুঝলাম ওটি হলেন আমাদের সর্দারজি।’
দুর্ঘটনার এমন বর্ণনা দেওয়া বোধহয় একমাত্র জহর রায়ের পক্ষেই সম্ভব। এ রকম রসবোধ ছিল বলেই সকলকে হাসিতে মজিয়ে রাখতে পারতেন জহর রায়। যাইহোক, দুর্ঘটনায় নাকে সামান্য চোট পাওয়া ছাড়া সে যাত্রায় আর বড় কিছু ঘটেনি। পরদিন থেকেই আবার সোৎসাহে শ্যুটিংয়ে নেমে পড়েন জহর রায়।
এই জয়সলমিরেই শ্যুট হয়েছিল হাল্লা রাজার সেনার দৃশ্য। হাজার হাজার উট সারি দিয়ে দাঁড়িয়ে। জয়সলমিরের রাজার ভাই কুমার বাহাদুর উট জোগাড় করে দিয়েছিলেন। জয়সলমির শ্যুটিং লোকেশন হিসেবে চূড়ান্ত হওয়ার আগে ঠিক হয়েছিল হাল্লা সেনারা হবে অশ্বারোহী। জয়সলমিরে এসে সত্যজিৎ দেখলেন, এদেশে ঘোড়া নেই, চারিদিকে শুধু উট আর উট।
ফলে বদলাতে হল চিত্রনাট্য, সেইসঙ্গে বদলে গেল সৈন্যদের সাজ-সরঞ্জামও। মুম্বই থেকে আনা উদ্ভট রঙের পোশাক শুরুতে গায়েই ওঠাতে চাইছিলেন না উটের সওয়ারিরা। ওই পোশাক দেখে কেউ হাসে, তো কেউ ছুঁড়ে ফেলে দেয়। অনেক কাঠখড় পুড়িয়ে, বুঝিয়ে-সুঝিয়ে গায়ে ওঠানো হল সৈন্যদের পোশাক। নানা অ্যাঙ্গেলে বসানো হল একাধিক ক্যামেরা। সারে চার মিনিটের গানের দৃশ্যের জন্য চল্লিশটার মতো শট নিতে হল। সে যুগের বাংলা ছবির জন্য এলাহি কাণ্ড বৈকি!
‘গুপী গাইন বাঘা বাইন’-এ সন্তোষ দত্ত শান্তিপ্রিয় হাল্লারাজা। সাদা কাগজ কেটে কেটে পাখি তৈরি করছেন। সেইসময় হৃষ্টপুষ্ট বপু নিয়ে হাঁসফাঁস করতে করতে হাল্লার মন্ত্রীমশাই ওরফে জহর রায় বলে চলেন, ‘হেঁ হেঁ শুধু বসে বসে খেলা করলে লোকেরা যে ছ্যা ছ্যা করবে, সেটা কি ভালো হবে? আজ বাদে কাল যুদ্ধু হবে!’
জহর রায়ের কথার পৃষ্ঠে সন্তোষ দত্তর নাবালক প্রশ্ন, ‘কে যুদ্ধ করবে?’ তখন ছেলেভুলনো কণ্ঠস্বরে জহর বলে ওঠেন,‘এই দেখো! আবার খোকা খোকা কথা বলে...।’
আমরা হাসিতে মেতে উঠি। সত্যজিৎ কী আর সাধে বলতেন, ‘জহর রায় অভিনয়ে না এলে গুগাবাবাই কোনওদিন হতো না।’
জহর রায় এমনই মানুষ। দু-তিন সিনের সামান্য সুযোগেই আলো কেড়ে নিতে জানতেন তিনি। আবার অন্যদের সঙ্গে হাসি-ঠাট্টা করে তাঁদের ঝামেলায় ফেলতে পারলেই যেন তিনি স্বর্গসুখ অনুভব করতেন।
পঞ্চাশের দশকে জহর রায়ের কমিক স্কেচের দারুণ খ্যাতি। ‘ন্যাপাসুর বধ’ তখন স্টেজে বিপুল হিট। দিনে তিনটে চারটে করে শো, সবই হাউসফুল। সেইসময় এক পুরস্কার বিতরণী অনুষ্ঠানে ‘ন্যাপাসুর বধ’ পালায় জহরের একক অভিনয় দেখে হাসিতে ফেটে পড়েছিলেন সত্যজিৎ রায়। তিনি এমনভাবে হেসে উঠেছিলেন যে, ওই মুহূর্তে তোলা এক ফোটোগ্রাফারের ক্যামেরায় সেই দুর্লভ মুহূর্তের ছবি ধরা পড়েছিল। সহাস্য সত্যজিৎ রায়ের আলজিভটাও সেই ছবিতে স্পষ্ট দেখা যাচ্ছিল। ওই ফোটো অমিয় নিবাসে রেখে পরিচিতদের ডেকে ডেকে দেখাতেন জহর রায়। লোকজনদের আমন্ত্রণ জানাতেন এই বলে যে, তাঁরা যদি জহরের বাড়িতে আসেন তাহলে তাঁরা দেখতে পাবেন, তাঁর বাড়িতে সত্যজিৎ রায়ের আলজিভ কীরকম সযত্নে রাখা আছে!
(ক্রমশ)
অলঙ্করণ: চন্দন পাল