কর্মপ্রার্থীদের ধৈর্য্য ধরতে হবে। প্রেম-প্রণয়ে আগ্রহ বাড়বে। নিকটস্থানীয় কারও প্রতি আকর্ষণ বাড়বে। পুরোনো কোনও বন্ধুর ... বিশদ
বাঙালি ভাবনায় ভানু কখনও একা আসেন না। ভানু বন্দ্যোপাধ্যায়ের নাম উচ্চারিত হলে অবধারিতভাবে এসে পড়েন জহর রায়। হলিউডে যেমন লরেল-হার্ডি, টলিউডে যেন ঠিক তেমনই ভানু-জহর। বাবা সতু রায় ছিলেন গুণী মানুষ। একটু-আধটু অভিনয়ও করতেন। ফলে অভিনয়ের রেফারেন্সটা জহর রায়ের ছিলই। সতু রায়ের লেখালেখির হাতটাও বেশ ভালো ছিল। প্রথমদিকে জহর রায়ের বেশ কিছু কমেডি-সংলাপ ও কৌতুক-নকশা ছিল তাঁর বাবারই লেখা।
বরিশালে জন্ম হলেও জহরের লেখাপড়া পাটনাতে। সতু রায়ের ছিল বদলির চাকরি। সেই সূত্রে জহর রায়ের ছোট থেকে কলেজ জীবনের বেশ খানিকটা সময়ই পাটনায় কেটেছে। সেখানে বি এন কলেজ থেকে জহর আই এ পাশ করেন ১৯৩৮ সালে। কী কী না কাজ তখন করতে হয়েছে তাঁকে। মেডিক্যাল রিপ্রেজেন্টেটিভের কাজ করেছেন, ১৯৩৮ থেকে ১৯৪২ পর্যন্ত চাকরি করেছেন ইস্ট ইন্ডিয়া ফার্মাসিউটিক্যালসে। বিশ্ববরেণ্য পরিচালক মৃণাল সেনের মতোই তাঁরও ওষুধের কোম্পানিতে সেলসম্যান হওয়াটাই স্বাভাবিক ছিল। পাটনা বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রেসে প্রুফ রিডারের কাজ করেছেন ২০ টাকা মাইনেতে। এমনকী, কিছুদিন পাটনায় দর্জির দোকান খুলে হাতেকলমে জামাকাপড় কাটিং-সেলাইও করেছেন।
তবে যাই করুন, পাটনায় থাকতে থাকতেই যে কারণে তিনি জনপ্রিয় হয়ে উঠেছিলেন, তাতেই বোঝা যায় তাঁর ভিতর ভবিষ্যতের ‘জহর রায়’ হয়ে ওঠার যাবতীয় রসদ মজুত ছিল। পারিবারিক সংস্কৃতি অনুযায়ী শুরু থেকেই বইপত্র পড়া ও অন্যান্য নানা বিষয়ে জানার অভ্যাস তৈরি হয়ে গিয়েছিল। তখন থেকেই তাঁর আদর্শ ছিলেন চার্লি চ্যাপলিন। লোকজনকে হাসানোর ইচ্ছে ও প্রতিভা দুই-ই ছিল জহর রায়ের। পাটনায় বিভিন্ন অনুষ্ঠানে চ্যাপলিনকে নকল করে, কথা-বার্তায়, নানা অঙ্গভঙ্গিতে আনন্দ দিতেন দর্শকদের। এমন করে নকল করতেন যেন তিনি নিজেই চার্লি চ্যাপলিন। নিজেকে বলতেন চ্যাপলিনের একলব্য শিষ্য। ধীরে ধীরে নাম হতে শুরু করল। নানা জায়গা থেকে ডাক আসতে লাগল। সেই সময় পাটনায় লোকমুখে তাঁর নামই হয়ে গেল ‘চার্লি’। পাটনায় একবার একটি অনুষ্ঠানে অংশ নিতে গিয়েছিলেন সে সময়ের আর এক প্রতিভাবান কৌতুকাভিনেতা অজিত চট্টোপাধ্যায়। ওই অনুষ্ঠানেই জহর রায়ের ‘চার্লি’ প্রদর্শন দেখে মুগ্ধ হন তিনি। তখনই পরিচয় হয় দুজনের। কলকাতায় জহর আসার পর অজিত চাটুজ্যের সঙ্গে ঘনিষ্ঠতা জমে ওঠে। অজিতবাবু পরে অনেক সাহায্য করেছেন জহর রায়ের উত্থানের ক্ষেত্রে।
অভিনয়ের পোকা যাঁর মাথায় গোড়া থেকেই কিলবিল করত, তাঁর পক্ষে কি অন্য কোনও কাজে মন দেওয়া সম্ভব? একদিন সব ছেড়েছুড়ে দিয়ে মাত্র ৫০ টাকা পকেটে নিয়ে কলকাতাগামী একদল বরযাত্রীর গাড়িতে চেপে পাটনা থেকে কলকাতায় চলে আসেন জহর। ভাগ্যের চাকা কখন যে কার কোনদিকে ঘুরে যায়! কলকাতায় এসে যোগাযোগ হল সাহিত্যিক নারায়ণ গঙ্গোপাধ্যায়ের সঙ্গে। নারায়ণবাবু তখন থাকতেন পটলডাঙায়। জহর রায় সেই বাড়িতেই এসে ওঠেন। জহরের চার্লিকে নকল করার অভিনয় নারায়ণবাবু তাঁর পরিচিত লোকজনকে ডেকে ডেকে দেখাতেন। একদিন নাট্যব্যক্তিত্ব রঙ্গশ্রীর সাধন সরকারের সঙ্গে আলাপে নারায়ণ গঙ্গোপাধ্যায় জহরকে বলেন চার্লি চ্যাপলিনের ‘দ্য গ্রেট ডিক্টেটর’ নকল করে দেখাতে। জহর সঙ্গে সঙ্গে এমনভাবে নকল করেন যে, দেখে অবাক হয়ে গিয়েছিলেন সাধনবাবু। গল্পের এখানেই শেষ নয়। পরের দিন আবার সাধনবাবুর সঙ্গে দেখা হতেই তাঁর কাছে একটা আবদার করে বসেন জহর। সেদিনের চার্লি দর্শনের বিনিময়ে শোনাতে হবে মঞ্চের ডায়লগের কিছু অংশ। ‘আলমগীর’ নাটক থেকে কিছুটা শোনাতেই জহর রায় উঠে জড়িয়ে ধরেন নাটকের এই মহীরুহকে। দাবি, রঙ্গশ্রীর সদস্য করতে হবে, অভিনেতা হওয়ার পথ দেখাতে হবে। পরে অবশ্য রঙ্গশ্রীর সভ্য হয়েছিলেন জহরবাবু।
তাঁর প্রতিভার আভাস পেয়ে নারায়ণবাবুই জহরকে নিয়ে যান সে যুগের নামকরা পরিচালক অর্ধেন্দু মুখোপাধ্যায়ের কাছে। তিনি তখন ‘পূর্বরাগ’ নামে একটা ছবি করছেন। পরিচয় করতে গিয়ে জহর দেখেন এ তো তাঁর দেশের কালাচাঁদদা! আসলে অর্ধেন্দুবাবুও বিহারের ভাগলপুরের মানুষ। জহর পাটনায় থাকতে কালাচাঁদদাকে (অর্ধেন্দুবাবুর ডাকনাম) চিনতেন। ফলে পূর্বপরিচিত দুই বিহার প্রবাসী বাঙালির নিজেদের আপন করে নিতে দেরি হল না। অর্ধেন্দুবাবুর ‘পূর্বরাগ’ ছবিতেই জহর রায়ের অভিষেক ঘটল। তখন ১৯৪৭ সাল। এর প্রায় বছর দুই পরে ভানু বন্দ্যোপাধ্যায় চলচ্চিত্রে আসেন, ১৯৪৯-এ। শুধু সিনেমায় অভিনয়ের ক্ষেত্রেই নয়, বয়সের মাপকাঠিতেও ভানুর থেকে জহর এক বছরের সিনিয়র। তাঁর জন্ম ১৯১৯ সালে। তবে তারিখটা ঠিক জানা নেই। ওঁর স্ত্রী কমলাদেবী জহরবাবুর জন্মদিন প্রসঙ্গে এক সাক্ষাৎকারে বলেছেন, ‘তারিখটা বলতে পারব না। কারণ ওঁর জন্মদিন আমরা কখনও পালন করিনি। শুনেছি ১৯১৯ সালের আশ্বিন মাসে ওঁর জন্ম।’
পর্দায় তাঁকে দেখে হাসির ফুলঝুরি ছুটলেও ব্যক্তিগত জীবনে খুবই রাশভারী ছিলেন জহর। কলেজ স্কোয়ারের কাছে কর্পোরেশন অফিস, তার পাশের গলি রাধানাথ মল্লিক লেনের ২১/১ নম্বরের তিনতলা বাড়িটির একতলায় স্ত্রী কমলা রায়, পুত্র সব্যসাচী আর তিন মেয়ে সর্বাণী, ইন্দ্রাণী ও কল্যাণীকে নিয়ে সপরিবারে ভাড়া থাকতেন তিনি। গলি থেকে বেরিয়ে একাত্তর বাই একের পটুয়াটোলা লেনের ‘অমিয় নিবাস’-এর তিনতলায় দুটো ঘর নিয়েছিলেন জহরবাবু। এটাই ছিল তাঁর লাইব্রেরি কাম অফিসঘর। কাজের জন্য না বেরলে সেখানেই সারাদিন থাকতেন। রাতে গলির ভিতরের বাড়িতে শুতে আসতেন। খুবই ঘরোয়া ও সাধারণ জীবনযাপন করেছেন বরাবর। কোনওদিন নিজের গাড়ি ছিল না। ট্যাক্সিই ছিল একমাত্র সম্বল।
(ক্রমশ)
অলংকরণ: সুব্রত মাজী