কর্মপ্রার্থীদের ধৈর্য্য ধরতে হবে। প্রেম-প্রণয়ে আগ্রহ বাড়বে। নিকটস্থানীয় কারও প্রতি আকর্ষণ বাড়বে। পুরোনো কোনও বন্ধুর ... বিশদ
এর ফলটা ফলল ভালো। ওই একটা জুতোর টক্করেই বাংলা সাহিত্যে এক নতুন যুগের জন্ম হল।
ফোর্ট উইলিয়াম কলেজের ছাত্রদের জন্য যেসব বইপত্তর সেখানকার অধ্যাপক মশায়রা লিখলেন তাতে শিক্ষার্থীদের চোদ্দোপুরুষ উদ্ধার হচ্ছে দেখে ওই কলেজের অধ্যক্ষ মার্শেল সাহেব সরাসরি বিদ্যাসাগর মশায়কে বললেন, ‘তুমি খানকতক ভালো ভালো বাংলা বই লিখে ফেলো তো! কিছু যদি না পার, তুমি তো হিন্দি ভালো জানো। হিন্দি ‘বৈতাল পচ্চিসি’ বলে যে গপ্পের বইখানা আছে— সেটাকে বাংলায় অনুবাদ করে দাও তো। ওই গল্প কলেজের সাহেব ছাত্রগুলো গিলে খাবে। আর একটা অনুবাদও তোমাকে করতে হবে— সিরাজ-উদ-দৌলার সিংহাসনে বসার সময় থেকে ইংরেজদের বাংলায় কায়েম হয়ে বসা নিয়ে মার্শম্যান সাহেব যে বই লিখেছেন ইংরেজিতে— তুমি জমিয়ে এর বাংলা অনুবাদ করে দাও তো।’ বিদ্যাসাগর মশায় খুশি। ১৮৪৭-এ বের হয়ে গেল ‘বেতাল পঞ্চবিংশতি’। কতবার যে সেটাকে ছাপতে হল— তার হিসেব রাখে কে? বাংলা গদ্য সাহিত্য পেল কমা, পূর্ণচ্ছেদের ব্যবহার। পেল লাবণ্য, পেল ছন্দোময়তা। তিনি যে বিদ্যাসাগর— তাঁর সাগরে এমন লালায়িত ঢেউ খেলবে না তো কার লেখায় খেলবে? মার্শম্যানের ‘বাঙ্গালার ইতিহাস’ও খুব চলল। এমন লোককে কষ্ট পেতে হয়। তাঁর ন’ ভাই হরচন্দ্র মাত্র বারো বছর বয়সে চলে গেল— কী বুদ্ধিমান ভাইটি ছিল তাঁর! সে বেঁচে থাকলে দেশের উপকার হতো ভাবতেন বিদ্যাসাগর। নিজেদের পরিবারের, গ্রামের উপকার নয়— বিদ্যাসাগর ভাবতেন দেশের উপকারের কথা! দেশের কথা ভেবেই তো বেতাল পঞ্চবিংশতি ছাপিয়ে প্রায় দুশো কপি বই তিনি আত্মীয়, বন্ধু-বান্ধবদের বিনামূল্যে বিতরণ করেছিলেন। আহা! তিনি যে নুনের সাগর নয়, তিনি যে রামকৃষ্ণের ক্ষীরের সাগর।
ঠিক এইরকম একটা সময়ে সংস্কৃত কলেজের সেক্রেটারি রসময় দত্ত মশায় বিদ্যাসাগর মশায়কে জিজ্ঞেস করলেন যে তিনি নাকি কলেজের সহকারী সম্পাদকের পদে ইস্তফা দিয়েছেন। এটা না করলে কি চলত না? স্বয়ং শিক্ষাসমাজের সেক্রেটারি ময়েট সাহেবও বিদ্যাসাগর মশায়কে অনুনয়-বিনয় করে পদত্যাগপত্র ফিরিয়ে নিতে বললেন। কিন্তু এঁড়ে বাছুরের একবগ্গা গোঁ, তিনি ঘাড় বেঁকাতেই জানেন না। এই নিয়ে কলকাতার বাঙালি সমাজে খুব একটা হইচই পড়ে গেল। আত্মীয়বর্গ খুব অপ্রসন্ন হলেন। কোনও এক আত্মীয় (শোনা যায় কথাটা বলেছিলেন সেক্রেটারি রসময় দত্তই) নাকি বিদ্যাসাগরের কানে যায় এমনভাবে বলেছিলেন— ‘বিদ্যাসাগর চাকরি ছেড়ে দিলে, এরপর খাবেটা কী?’ শুনে বিদ্যাসাগর বলেছিলেন, ‘আলু, পটল বেচব, না পারি তো মুদির দোকান দিয়ে পেট চালাব।’ আবার তাঁর মধ্যের এঁড়ে বাছুরটা জেগে উঠেছিল।
আলু-পটল বিক্রি করাটা বিদ্যাসাগর করতে পারতেন না, এমন নয়। কিন্তু তিনি একটা এমন কাণ্ড করে বসলেন যাতে বাংলা সাহিত্য সত্যিই উপকৃত হল। বন্ধু মদনমোহন তর্কালঙ্কারের (কী সাংঘাতিক এই পণ্ডিতমশায়টি যে, বেথুন স্কুল স্থাপিত হলে সংস্কৃতের এই পণ্ডিতমশায়টা প্রথমেই এই স্কুলে ভর্তি করে দিলেন তাঁর দুই কন্যা ভুবনমালা আর কুন্দমালাকে) সঙ্গে একদিন পরামর্শ করে ঠিক করলেন তিনি একটি ছাপাখানা বসাবেন এর জন্য একটা প্রেস-মেশিন কিনতে হবে। হাতে টাকা নেই, তাই হাত পাতলেন নীলমাধব মুখুজ্যে মশায়ের কাছে। টাকা এনে বন্ধু মদনমোহনের হাতে দিলেন। তিনি মুদ্রণযন্ত্র কিনতে গেলেন। নীলমাধবকে কথা দিয়েছিলেন যত শিগগির পারেন— টাকা শোধ করে দেবেন। সাত-পাঁচ ভেবে তাই একদিন মার্শেল সাহেবকে বললেন, ‘একটা ছাপাখানা বসিয়েছি, তুমি যদি তোমাদের কাজকর্ম ছাপাবার জন্যে আমাকে কিছু কিছু দাও তো আমি করি।’
সাহেব শুনেই এক পায়ে খাড়া। বললেন, ‘তুমি এক কাজ কর— তুমি হয়তো জানো, ফোর্ট উইলিয়াম কলেজের ছাত্রদের জন্য ভারতচন্দ্রের অন্নদামঙ্গল কাব্যটি পাঠ্য আছে। যে বইটা ছাপা হয়েছে, তা জঘন্য কাগজে ছাপানো, অক্ষরগুলো আরও জঘন্য। তুমি যদি কৃষ্ণনগরের রাজবাড়িতে যে অন্নদামঙ্গল খানি আছে, সেটি নিয়ে শুদ্ধ করে যতদূর সম্ভব জলদি করে ছাপিয়ে দাও— তাহলে আমি একশোখানা বই নেব এবং এর জন্যে তোমাকে ছশো টাকা দেব। বাকি যা থাকবে, বিক্রি করে তুমিই টাকা নিও। তাতে তোমার ধার শোধ হয়ে নিজেরও কিছু হবে মনে হয়।’ সেই পরামর্শ মেনে বই আনিয়ে ছাপিয়ে সাহেবের দেওয়া ছশো টাকা পেয়ে নীলমাধববাবুর ধার শোধ করলেন। এরপর ওই ছাপাখানা তাঁর লক্ষ্মীর ভাঁড় হয়ে উঠল।
দিন যেতে যেতে ১২৫৬ বাংলা সনের ৩০ কার্তিক রাতে দীনময়ীদেবীর গর্ভ থেকে একটি পুত্রসন্তানের জন্ম হল। ঠাকুরদাস বধূমাতাকে ‘নারায়ণে’র ওষুধ খাইয়েছিলেন, তাই নাতির নামকরণ হল নারায়ণ। ঈশ্বরচন্দ্র পিতা হলেন। এর ক’দিন পরেই হরচন্দ্রের পরের ভাই কলেরায় মারা গেলেন। ঈশ্বরকেও দুঃখ পেতে হয়! সুখ-দুঃখ দুটি ভাই, সুখের লাগিয়া যে করে পীরিতি দুঃখ যায় তাঁহার ঠাঁই। চক্রবৎ পরিবর্তন্তে জগৎ সুখানি-দুঃখানি চ।।
(ক্রমশ)