বিদ্যার্থীদের বেশি শ্রম দিয়ে পঠন-পাঠন করা দরকার। কোনও সংস্থায় যুক্ত হলে বিদ্যায় বিস্তৃতি ঘটবে। কর্মপ্রার্থীরা ... বিশদ
স্ত্রীর মুত্যুতে একদম অসহায় হয়ে পড়েছিলেন প্যারীচাঁদ মিত্র। নিঃসঙ্গতা তাঁকে গ্রাস করছিল। পরিবার থেকে ক্রমশ তিনি দূরে সরে যাচ্ছিলেন। অবেলায় স্ত্রীকে হারিয়ে তিনি যে বিপন্নবোধ করছিলেন তা তাঁর—‘ON THE SOUL: ITS NATURE AND DEVELOPMENT’ গ্রন্থের ভূমিকায় চোখ বোলালেই স্পষ্ট বোঝা যায়। তিনি লিখছেন— ‘ My love for God became stronger by the afflictions I met with from time to time. In the year 1860 I lost my wife, which convulsed me much, I took to the study of spiritualism which, I confess. I would not have thought of otherwise nor relished its charms. I wrote for instruction to Judge W. Edmonds in May 1861..... ’ তিনি তাঁর গ্রন্থের ভূমিকায় আরও লিখছেন— তাঁর সহৃদয় সেই সুপরামর্শ আমি আমার পরবর্তী গ্রন্থ ‘ Stray Thoughts On Spiritualism’-এ সুন্দর ভাবে লিপিবদ্ধ করেছিলাম। এই সময়েই ডাক্তার বেরিগনি কলকাতায় এসেছিলেন। সালটা ছিল ১৮৬৩ (ফরাসি ডাক্তার বেরিগনিই প্রথম কলকাতায় হোমিওপ্যাথি চিকিৎসা ও পরলোক চর্চা শুরু করেন)। সেইসময় তাঁর বাড়িতে আমরা প্রতি সপ্তাহে চক্রে বসতাম। একটি বৈঠকে আমিই হয়েছিলাম মিডিয়াম। ১৮৬০ সাল থেকেই আমি আধ্যাত্মিক লেখাপড়া ও ধ্যানধারণায় গভীরভাবে ডুবে গিয়েছিলুম। এর প্রভাবে আমার চারটি বছর অতিবাহিত হয়, যার ফলে আমি এই সিদ্ধান্তে এসেছি— যোগ এবং স্পিরিচ্যুয়ালিজম একই লক্ষ্যের অভিমুখী। সেই লক্ষ্যটি হল ধীরে ধীরে ইন্দ্রিয়ের হাত থেকে মুক্তি।
প্যারীচাঁদ মিত্রের জীবনীকার লিখছেন— ‘প্যারীচাঁদ খড়দহের প্রাণকৃষ্ণ বিশ্বাসের কন্যা বামাকালীকে বিবাহ করিয়াছেন।.... পত্নীবিয়োগের পর হইতে তিনি প্রেততত্ত্বের দিকে আকৃষ্ট হইয়া পড়েন।’
স্ত্রী-বিয়োগের পর একদম বিধ্বস্ত প্যারীচাঁদ মিত্রের মানসিক অবসাদের হৃদয়স্পর্শী বর্ণনা দিয়ে গিয়েছেন রাজকৃষ্ণ মিত্র তাঁর ‘শোকবিজয়’ গ্রন্থে। তিনি লিখছেন, ‘মৃত্যুর পর আমাদের আত্মীয় স্বজনের মুক্তাত্মা নিকটে থাকিয়া আপদ হইতে সর্ব্বদা রক্ষা করেন। বাবু প্যারিচাঁদ মিত্রের নাম কে না শুনিয়াছেন! ইনি ইংরাজি ও সংস্কৃত ভাষায় অতিশয় পণ্ডিত। বিগত ৫০ বৎসর মধ্যে এ নগরীতে যত সাধারণ হিতার্থী কার্য্য হইয়াছে, প্যারিবাবুর হাত ছাড়া কোন কর্ম্মই হয় নাই। দেশের ছোট বড় যাবতীয় লোক, এমনকি রাজপুরুষগণ পর্য্যন্ত ইঁহাকে অতিশয় সম্ভ্রম করেন। কয়েক বৎসর হইল, পরিবারের মৃত্যু হওয়ায় প্যারিবাবু শোকে অতিশয় কাতর হইয়া অধ্যাত্ম বিজ্ঞান চর্চ্চা করিতে করিতে ১৮৬৪ সালে নিজে মিডিয়ম হইয়া উঠিলেন। এখন উঁহার স্ত্রী সর্ব্বদা নিকটে থাকিয়া নিয়মিত পতিসেবা করেন ও আপদ-বিপদ হইতে রক্ষা করিয়া থাকেন। প্যারিবাবু মনে করিলেই তাঁহাকে দেখিতে পান, আর এখন তিনি ‘ধরি মাছ না ছুঁই পানি’ রূপে সংসারে লিপ্ত থাকিয়া আত্মার মুক্তকাল অপেক্ষায় দিবানিশি ঈশ্বর আরাধনায় নিযুক্ত থাকিয়া দিন যাপন করিতেছেন।’
প্যারীচাঁদ মিত্র সেইসময় কলিকাতার বেঙ্গল লাইব্রেরির (বর্তমানে জাতীয় গ্রন্থাগার) সম্পাদক ছিলেন। স্ত্রীর মৃত্যুর পর তিনি পরলোক চর্চা নিয়ে অতিশয় মেতে উঠলেন। লাইব্রেরির সংগ্রহশালায় থাকা পরলোকতত্ত্ব সম্বন্ধীয় বিভিন্ন পুস্তক ও প্রবন্ধাদি পাঠ করতে শুরু করলেন। আর তারই ফলস্বরূপ তিনি অল্পদিনের মধ্যে প্রেতচক্র ও প্রেতলোক সম্পর্কে বিশেষজ্ঞ হয়ে উঠেছিলেন। লাইব্রেরির কর্ম ও অন্যান্য কাজ সেরে ঘরে ফিরেই তিনি বসে পড়তেন প্রেতচক্রে। এই কাজে তাঁকে সাহায্য করতেন তাঁর পরিবারের অন্যান্য সদস্যরা। আর প্যারীচাঁদ মিত্র হতেন মিডিয়াম। এইসময় থেকে প্যারীচাঁদ লন্ডনের ‘স্পিরিচুয়ালিস্ট’, বস্টনের প্রেততত্ত্ববিষয়ক ‘ব্যানার অফ লাইট’ এবং বোম্বের ‘থিওজফিস্ট’ পত্রিকায় নিয়মিত প্রবন্ধ লিখতে শুরু করেন।
ঊনবিংশ শতকের ছয়ের দশককে বৈপ্লবিক দশক হিসেবে অনায়াসে চিহ্নিত করা যায়। নতুন চিন্তা, নতুন ভাবধারার সঙ্গে আমরা তখন পরিচিত হচ্ছি। আর এরই পাশাপাশি বাংলা মেতে উঠেছিল পরলোকচর্চা নিয়ে এবং এর প্রধান উদ্যেক্তা ছিলেন প্যারীচাঁদ মিত্র ওরফে টেকচাঁদ ঠাকুর। তাঁরই নেতৃত্বে ১৮৮০ সালে কলকাতায় ইউনাইটেড অ্যাসোসিয়েশন অব স্পিরিচুয়্যালিস্ট নামে একটি সমিতি গঠিত হয়েছিল। এই সমিতির সভাপতি ছিলেন জে জি মিউগেন্স, সহ সভাপতি ও সম্পাদক রূপে মনোনীত হন যথাক্রমে প্যারীচাঁদ মিত্র ও নরেন্দ্রনাথ সেন।
তাঁদেরই আমন্ত্রণে ১৮৮২ খ্রিস্টাব্দের ১৯ মার্চ নিউ ইয়র্ক থিওজফিক্যাল সোসাইটির সভাপতি কর্নেল অলকট ও প্রেততত্ত্ববিশেষজ্ঞা মাদাম ব্ল্যাভাৎস্কি কলকাতায় এসেছিলেন। প্রাসঙ্গিক না হলেও একথা জানানোর অবশ্যই প্রয়োজন আছে— এই অলকট এবং ব্ল্যাভাৎস্কি তাঁদের ‘অলৌকিক’ আসন বেশিদিন ধরে রাখতে পারেননি। তাঁরা যে প্রতারণা করে মানুষ ঠকাতেন, তা এর কিছুদিন বাদেই জনসমক্ষে প্রকাশিত হয়ে পড়ে। অচিরেই তাঁরা গুপ্ত স্থানে আত্মগোপন করতে বাধ্য হন। তবে এখন সেকথা থাক। তবে সেই বছরেরই এপ্রিল মাসে থিওজফিক্যাল সোসাইটির যে বঙ্গীয় শাখার প্রতিষ্ঠা হয়েছিল তারও সভাপতি ছিলেন প্যারীচাঁদ মিত্র।
প্যারীচাঁদ এবং তাঁদের ইউনাইটেড অ্যাসোসিয়েশন অফ স্পিরিচুয়্যালিস্টের অন্যান্য সভ্যরা নিয়মিত প্রেতচক্রে বসে বিভিন্ন আত্মাকে তাঁদের আসরে আহ্বান করে ডেকে এনে তাঁদের জীবনকাহিনী শুনতেন। কখনও কখনও তাঁদের সঙ্গে নানা প্রসঙ্গে আলাপ আলোচনাও করতেন। (ক্রমশ)