বিদ্যার্থীদের বেশি শ্রম দিয়ে পঠন-পাঠন করা দরকার। কোনও সংস্থায় যুক্ত হলে বিদ্যায় বিস্তৃতি ঘটবে। কর্মপ্রার্থীরা ... বিশদ
কৈশোর ও যৌবনের সন্ধিক্ষণে আমি মরুতীর্থ হিংলাজের লেখক অবধূতের ঘনিষ্ঠ সান্নিধ্যে ছিলাম। তাই স্বাভাবিকভাবেই হিংলাজ দর্শনের সুপ্ত বাসনা আমার মনের মধ্যে ছিল। করাচির নাগনাথ আখড়া থেকে লাসাবেলার মরুপ্রান্তর পার হয়ে হিংলাজ যাত্রা আমার সাধ্যাতীত। তাই অন্যভাবে হিংলাজ দর্শন অপ্রত্যাশিতভাবে হয়েই গেল আমার।
কাথিয়াবাড়ের অন্তর্গত পার্বত্য পলিটানা বা পালিতানার সিদ্ধাচলই হল গিরিতীর্থ হিংলাজ। সমুদ্রতল থেকে এর উচ্চতা ২ হাজার ৮৭৭ ফুট। এই সিদ্ধাচলে আছে এক হাজারটি মন্দির। বর্তমানে মন্দিরের সংখ্যা আরও বেড়েছে।
গুজরাত পরিক্রমায় আমি আমেদাবাদ থেকে ভাবনগরের ট্রেনে চেপে শিহর জংশনে এসেছিলাম। সেখান থেকে দু’বগির একটি ট্রেনে পালিতানা। দারুণ সুন্দর পরিবেশ সেখানকার। থাকার জন্য হোটেল, ধর্মশালা কোনও কিছুরই অভাব নেই। জৈনদের বিশ্বাস, এই পুণ্যভূমিতে মন্দির নির্মাণ করলে মহানির্বাণের পথ সুগম হয়।
১৯৮০ সালের কথা। আমি সিদ্ধাচল শিখরে পৌঁছনোর জন্য খুব সকালে রওনা দিয়ে পর্বতারোহণ শুরু করলাম। বেশ কিছুটা উচ্চস্থানে ওঠার পর এক জায়গায় বাঁকের মুখে একটু নির্জন ও প্রশস্ত স্থান দেখে বসে পড়লাম। পাশেই পাহাড়ের গায়ে পাথরে খোদাই করা একটি মন্দিরে রক্তবস্ত্র পরিহিতা এক দেবীমূর্তি রয়েছে দেখলাম। দেবীর সামনে ধূপ জ্বলছে। কিছু ফুল ছড়ানো আছে। গুজরাতি ভাষায় লেখাও আছে কী যেন।
এমন সময় বিশাল বপু এক কাথিয়াবাড়ি যাত্রী লাঠিতে ভর করে সেখানে এসে বসলে তাঁকে জিজ্ঞেস করলাম, ‘এখানে ইনি কোন দেবী?’
উনি হাঁফাতে হাঁফাতে বললেন, ‘হিংলাজ কি হাদো।’
একটু পরেই একজন পূজারিণী এলেন। তাঁকে জিজ্ঞেস করতেই তিনি বললেন, ‘হ্যাঁ। মরুতীর্থের হিংলাজ এখানে গিরিতীর্থে অধিষ্ঠিতা। আমার অন্তর যেন কেঁপে উঠল। হিংলাজে তো সতীর ব্রহ্মরন্ধ্র পড়েছিল। কিন্তু এখানে? পূজারিণীর মুখে যা শুনলাম তা হল এই —
অতি প্রাচীনকালে করাচির এক বনে হিঙ্গল নামে এক রাক্ষস বাস করত। ওই বন পার হয়ে মরুতীর্থে গমনকারী সমস্ত তীর্থযাত্রীকেই বিনাশ করত সে। একবার ওই রাক্ষস এক সাধুকে আক্রমণ করেছিল। সাধু প্রাণভয়ে ভীত হয়ে কাতরকণ্ঠে দেবী অম্বিকার স্তব করতে লাগলেন। সাধুর স্তবে প্রসন্না হয়ে দেবী আবির্ভূতা হলেন এবং ভয়ঙ্করী মূর্তি ধারণ করে বিনাশ করলেন হিঙ্গলকে। মৃত্যুকালে হিঙ্গল দেবীর কাছে বর প্রার্থনা করেছিল, ‘হে মা অম্বিকে! তোমার হাতে মৃত্যুবরণ করে আমি উদ্ধারপ্রাপ্ত হলাম। আমার অন্তিম কামনা এই যে যেখানে কোনও হিংসা নেই সেই স্থানে তুমি আমার নামে অধিষ্ঠিতা হও। দেবী অম্বিকা তখন থেকেই মরুতীর্থে ও অহিংসার পুণ্যভূমি সিদ্ধাচলে হিংলাজ নামে অধিষ্ঠিতা আছেন।
এরপর আর একবার হিংলাজ মাতার দর্শন পেলাম ২০১২ সালে ভুজ থেকে নারায়ণ সরোবরে যাওয়ার পথে মাতা নো মঢ়-এ। এখানে আশাপুরা মাতার মন্দির আছে। সেই মন্দির দর্শন করতে গিয়ে হিংলাজ দর্শন হয়ে গেল। স্থানটি কচ্ছের রন অঞ্চলের মরুময় প্রান্তরে। সুন্দর তোরণ বিশিষ্ট রম্য মন্দির। সিদ্ধাচলের সেই মন্দিরের চেয়ে অনেক বেশি আকর্ষণীয়।
ভাবাবেগে আপ্লুত হয়েই আমি মন্দিরে প্রবেশ করলাম। এখানকার যিনি পূজারী তাঁর হাতে যৎসামান্য প্রণামী দিয়ে জিজ্ঞেস করলাম, ‘পণ্ডিতজি, লাসাবেলার মরুভূমির মা কচ্ছের এই মরুভূমিতে এলেন কী করে?’
পণ্ডিতজি বললেন, ‘তাহলে শুনুন, কচ্ছের এক শাসক মহারাও দ্বিতীয় দেশলজি একবার হিংলাজ যাত্রা করবেন বলে লোকজন সহ এখানে এসেছিলেন। তা এখানকার পীঠাধীশ তখন রাজাবাবা। তিনি মহারাওকে বললেন, ‘মহারাজ, বর্তমান সময়ে রাজ্যের পরিস্থিতি কী তা আপনি জানেন। অতএব এই সময় আপনার বিদেশযাত্রা না করাই ভালো।’
দেশলজি পীঠাধীশের কথা অমান্য করলেন না, ব্যথিত হৃদয়ে যাত্রা স্থগিত করে রয়েই গেলেন। সে রাতে মহারাও স্বপ্নে দর্শন পেলেন দেবীর, হিংলাজ মাতা তাঁকে দর্শন দিয়ে বললেন, ‘আমার অদর্শনে তুমি কাতর হয়েছ তা বুঝতেই পারছি। সে জন্য তোমাকে দর্শন দেব বলে আমি এখানকার পাহাড় চূড়ায় অবস্থান করছি।
তুমি কাল প্রত্যুষে গিরিশিখরে এলেই আমার দর্শন পাবে। তোমারই কারণে ওখানে আমি অধিষ্ঠিতা হব। ওই গিরিচূড়ায় এলে তুমি পাশাপাশি দুটি শিলা দেখতে পাবে। সেই শিলা দুটি আমারই শিলাময় রূপ। ওই শিলা দিয়ে তুমি আমার দুটি মূর্তি নির্মাণ করবে। তার একটি প্রতিষ্ঠা করবে ওই পাহাড়ের মাথায়। অন্যটি এখানে আশাপুরা মন্দিরের কাছে, যে সমস্ত যাত্রী পাহাড়ে উঠতে পারবে না তারা নীচেই আমাকে দর্শন করবে। আমি দু’জায়গাতেই স্বমহিমায় বিরাজ করব।’
স্বপ্ন দর্শন করেই মহারাও ভোরের আলো ফুটে ওঠার সঙ্গে সঙ্গে পাহাড়ের মাথায় উঠে পাশাপাশি দুটি শিলা দর্শন করলেন। তাঁর আদেশে ভাস্কররা সেই পাথর কুঁদে তৈরি করলেন হিংলাজ মাতার মূর্তি। দেবীর নির্দেশ মতো সেই পর্বতের উপরে ও নীচে দুটি রম্য মন্দির নির্মাণ করিয়ে হিংলাজ মাতার মূর্তি প্রতিষ্ঠা করলেন। এখন শত শত যাত্রী যাঁরা লাসাবেলার মরুতীর্থে যেতে পারেন না, তাঁরা কচ্ছের মরুতীর্থেই হিংলাজ মাতাকে দর্শন করেন।
কাহিনী শুনে দেবীপ্রণাম সেরে পাহাড়ওয়ালি হিংলাজ মাতাকে দর্শন করতে চললাম। কচ্ছের মরুপ্রান্তরে এ এক অন্য অভিজ্ঞতা। সঙ্গে গাড়ি ছিল, তাই অসুবিধে হল না। না হলে গিরিশিখরে উঠতে অনেকগুলো সিঁড়ি অতিক্রম করতে হতো। মন্দিরের দ্বার তখন বন্ধ ছিল। তবে লোহার গরাদের ফাঁক দিয়ে দেবীকে দর্শন করলাম। এরপর এখানকার মরুময় প্রান্তরের রুক্ষ রূপ দেখে এগিয়ে চললাম নারায়ণ সরোবরের দিকে। (ক্রমশ)