বিদ্যার্থীদের বেশি শ্রম দিয়ে পঠন-পাঠন করা দরকার। কোনও সংস্থায় যুক্ত হলে বিদ্যায় বিস্তৃতি ঘটবে। কর্মপ্রার্থীরা ... বিশদ
অপূর্ব চট্টোপাধ্যায়: ঋষি এবং তাঁর স্ত্রী খুব ভালো মিডিয়াম— এই কথাটা শুনে শরৎচন্দ্র হাসতে হাসতে ভাইয়ের কাছে জানতে চাইলেন, তুমি কী করে জানলে তাঁরা খুব ভালো মিডিয়াম?
গিরীন্দ্রনাথ বললেন, আমি এবং আমার বন্ধু রায়সাহেব হরিসাধন মুখোপাধ্যায় তাঁদের সঙ্গে প্ল্যানচেটে বসেছিলাম।
শরৎচন্দ্র তখনও হাসছেন, তিনি হাসি থামিয়ে জানতে চাইলেন তারপর কী হল?
গিরীন্দ্রনাথ বললেন, শরৎদা, আমি একসময় এসব কিছুই বিশ্বাস করতাম না, কিন্তু এখন প্রবল ভাবে করি। সেদিন সন্ধ্যায় মিঃ ঋষি ইংরেজিতে সুন্দর একটি প্রার্থনা করে আমার হাতে একটি পেন্সিল ধরিয়ে বললেন, আপনার পরিচিত কোনও পবিত্র আত্মার কথা চিন্তা করুন। আমি চোখ বুজে আমার আত্মীয় সুভাষচন্দ্রের বাবা জানকীনাথ বসুর কথা ভাবতে শুরু করলাম।
মন দিয়ে ভাইয়ের কথা এতক্ষণ শুনছিলেন শরৎচন্দ্র। তিনি বললেন, সুভাষচন্দ্র তাহলে তোমাদের আত্মীয়?
গিরীন্দ্র বললেন, হ্যাঁ, সুভাষচন্দ্রের মা আমার স্ত্রীর সম্পর্কিত খুড়তুতো বোন । জানকীবাবু আমার ভায়রাভাই হলেও তিনি আমাকে ভাইয়ের মতো স্নেহ করতেন। ওড়িশায় আমরা পাঁচ বছর একসঙ্গে কত আনন্দে কাটিয়েছি।
শরৎচন্দ্র বললেন, তা বেশ! তারপর কী হল?
গিরীন্দ্র বললেন, আমি একমনে জানকীনাথের কথা চিন্তা করতে শুরু করলাম। মিনিট দশেক এইভাবে চিন্তা করার পর আমরা যে টেবিলটার চারপাশে বসেছিলাম সেই টেবিলটার একটা পায়া শূন্যে উঠে ঠক ঠক করে মেঝেতে ক্রমাগত আঘাত করতে শুরু করল। বুঝলাম, কেউ এসেছেন। আমি প্রশ্ন করলাম, কে আপনি? আপনার নাম কী?
উত্তর এল জানকীনাথ বসু।
—এখন আপনি কোন স্তরে আছেন?
—সপ্তম স্তরে।
—কেমন লাগছে? আপনি সুখে আছেন তো?
—খুব সুন্দর স্থান। খুব সুখে আছি।
—আমি কে বলুন তো?
—গিরীন্দ্র।
শরৎচন্দ্রকে গিরীন্দ্রনাথ বললেন, দাদা, প্রথমে আমার বিশ্বাস হচ্ছিল না। তাই আত্মাকে পরীক্ষা করার জন্য জিজ্ঞেস করলাম, কোথায় আপনার সঙ্গে আমার বিশেষ ঘনিষ্ঠতা হয়েছিল?
উত্তর এল, ওড়িশায়।
গিরীন্দ্রনাথ এরপর বললেন, এমন দু-একটা ঘটনা আপনি কী বলতে পারবেন যা আমি আর আপনি ছাড়া এই ঘরের কেউ জানেন না!
তিনি বললেন, একবার আমার অসুখের সময় তুমি তোমার দিদিকে ওড়িশা থেকে কটকে পাঠিয়েছিলে। সঙ্গে ছিল একজন ডাক্তার, কিরণ ও তোমার ছেলে। আর একবার মন্মথবাবুর বাড়ির গীতা ক্লাসে আমি অসুস্থ হয়ে পড়েছিলাম, তুমি আমায় কাঁধে করে বাড়িতে নিয়ে এসেছিলে।
শরৎচন্দ্র মন দিয়ে গিরীনের কথা শুনছিলেন। একসময় তিনি বললেন, ভাই গিরীন, তুমি তোমার ছেলের ব্যাপারটা তাঁর কাছ থেকে জানলে না কেন?
গিরীন্দ্র বললেন, জিজ্ঞেস করেছিলাম তাঁর কাছে, বলেছিলাম,আমার ছেলে সন্তোষময়কে মনে আছে কী?
তিনি বললেন, তোমার ছোট ছেলে তো, ওর ঘাড়ে এখন ব্রহ্মদৈত্য ভর করে আছে। তবে সে ব্যাপারে বাপু আমার কাছে কিছু জানতে চেওনা।
সবকথা শুনে শরৎচন্দ্র মিঃ ভি ডি ঋষির সঙ্গে আলাপ করার জন্য ব্যস্ত হয়ে পড়লেন। তিনি গিরীন্দ্রনাথের কাছে জানতে চাইলেন, মিঃ ঋষি কী এখনও কলকাতায় আছেন?
গিরীন্দ্র বললেন, ঋষি এখন বেশ কয়েকদিন কলকাতায় থাকবেন, তারপর তিনি ঋষির কলকাতা ও বম্বের ঠিকানাটা শরৎচন্দ্রকে লিখে দিলেন।
তবে সেবার আর শরৎচন্দ্র সময় করে ঋষির সঙ্গে দেখা করতে যেতে পারেননি। মিঃ ঋষির সঙ্গে তাঁর দেখা হয় ১৯৩৭ সালের ৯ মে।
শরৎচন্দ্র তখন খুবই অসুস্থ। তবুও ঋষি কলকতায় এসেছেন শুনে তিনি দেখা করবেন বলে ঠিক করলেন। সেদিন গিরীন্দ্রনাথের বন্ধু শচীন্দ্রনাথ সেনের বাড়িতে ঋষির বক্তৃতা দেওয়ার কথা ছিল। শরৎচন্দ্র সেই বক্তৃতা সভায় উপস্থিত ছিলেন। বক্তৃতা শেষে ঋষির সঙ্গে তাঁর আত্মা নিয়ে দীর্ঘ আলোচনাও হয়েছিল। শরৎচন্দ্র ঠিক করেছিলেন, শরীরটা একটু ভালো হলেই তিনি এই বিষয় নিয়ে পড়াশোনা শুরু করবেন। তবে তাঁর সেই সাধ পূর্ণ হয়নি। তাঁর শরীর ক্রমশ আরও খারাপ হতে শুরু করল। এই অসুস্থতার সময় শয্যাশায়ী শরৎচন্দ্র গিরীন্দ্রনাথকে বলেছিলেন, ‘যৌবনের প্রচণ্ড তেজে এই জগতকে যে চোখে দেখেছি, এখন যাবার সময় ঠিক তার বিপরীত ভাব! ভাই, বিছানা না নিলে এ পৃথিবীটা যে কি তা ঠিক ঠিক বোঝা যায় না।’ এর ঠিক কয়েকদিন পরেই ১৯৩৮ সালের ১৬ জানুয়ারি পার্ক নার্সিং হোমে তিনি মারা যান।
প্রিয় শরৎদার মৃত্যুতে ভীষণ ব্যথা পেয়েছিলেন গিরীন্দ্রনাথ। দাদার মৃত্যুর কয়েকদিন পরেই তিনি প্ল্যানচেটে বসলেন। সঙ্গে ছিলেন রায়সাহেব হরিসাধন মুখোপাধ্যায় ও আরও কয়েকজন। সেদিন সন্ধ্যায় চক্রে বসে তাঁরা গভীরভাবে শরৎচন্দ্রের কথা চিন্তা করতে শুরু করলেন। একসময় তাঁরা বুঝতে পারলেন মিডিয়ামের উপর কোনও আত্মা ভর করেছেন। প্রথমে প্রশ্ন করলেন গিরীন্দ্রনাথ। বললেন, আপনি কে? আপনার নাম কী?
সামনে রাখা সাদা কাগজের ওপর মিডিয়াম লিখলেন, শরৎচন্দ্র চট্টোপাধ্যায়।
— শরৎদা কেমন আছ ওখানে?
—এখানে সুখশান্তি অনির্বচনীয়।
— তুমি জড়দেহ কবে ত্যাগ করেছ?
— ১৬ জানুয়ারি, ১৯৩৮।
— সেদিন কী বার ছিল?
—রবিবার।
এইবার প্রশ্ন করলেন রায়সাহেব হরিসাধন মুখোপাধ্যায়। তিনি বললেন, আপনি তো নিজেকে নাস্তিক বলে জাহির করতেন। এখন কী মনে হয়?
উত্তরে শরৎচন্দ্র মিডিয়ামের মাধ্যমে বললেন, এখন মতের পরিবর্তন হয়েছে। একটা জন্ম বৃথা কাটিয়েছি। এখন বুঝেছি জীবনের উদ্দেশ্য মুক্তিলাভ করা।
রায়সাহেব জানতে চাইলেন, আপনি প্রখ্যাত লেখক। পরলোক সম্বন্ধে একটু বলুন না!
কাগজে লেখা হল এই কয়েকটি কথা— এখানে চৈতন্যসাগরে ডুবে আছি। আকাশ-বাতাস সবই চৈতন্যময়। জড় বলে কোথাও কিছু নেই।
সেই লেখা পড়ে হঠাৎই হাউ হাউ করে কেঁদে উঠলেন শরৎ-ভ্রাতা গিরীন্দ্রনাথ।
(ক্রমশ)