বিদ্যার্থীদের বেশি শ্রম দিয়ে পঠন-পাঠন করা দরকার। কোনও সংস্থায় যুক্ত হলে বিদ্যায় বিস্তৃতি ঘটবে। কর্মপ্রার্থীরা ... বিশদ
এই ভূপর্যটক মানুষটি একবার জোড়া বিপদে পড়লেন। তাঁর কনিষ্ঠ পুত্র সন্তোষময় সেইসময় পড়াশোনা করতেন দেওঘরের এক নামী স্কুলে। একদিন বিকেলে কিশোর সন্তোষময় তার স্কুলের এক বেলগাছে চড়ে বসল। কিন্তু সেখানে সে বেশিক্ষণ বসে থাকার সুযোগ পায়নি। খেয়েছিল পেল্লাই এক ধাক্কা। সোজা গাছ থেকে নেমে এল ভূমিতে। শোনা যায়, ওই বেলগাছে বসবাস করতেন এক ব্রহ্মদৈত্য। কিশোর সন্তোষময়ের বেয়াদপি তিনি একদম বরদাস্ত করতে পারেননি। শুধু ধাক্কা মেরেই ক্ষান্ত হলেন না, তিনি সেই কিশোরের শরীরের প্রবেশ করলেন। আর ঠিক সেইসময় পুরীর রাধানিবাসে ঘটল এক অলৌকিক কাণ্ড। গিরীন্দ্রনাথের কন্যা কমলা মানুষের ভূত-ভবিষ্যৎ বলতে শুরু করলেন। মানুষজন অবাক হয়ে বলতে লাগলেন, অবশ্যই কমলার ওপর কোনও দৈবশক্তি ভর করেছে। গিরীন্দ্রনাথের তখন উভয়সঙ্কট। ছোটাছুটির শেষ নেই। মেয়েকে নিয়ে তিনি বহু চিকিৎসক ও কবিরাজের কাছে গেলেন, করালেন ঝাড়ফুঁক, পরালেন অসংখ্য কবচ ও মাদুলি— কিন্তু এসব করে কোনও লাভ হল না।
এইসময় একদল ভক্ত-প্রাণ মানুষ গিরীন্দ্রনাথকে বললেন, শুনেছি রাম-নামে ভূত পালায়। আমরা আগামী একাদশীর দিন একটা নাম সংকীর্তনের আয়োজন করব। আপনি একবার কষ্ট করে আপনার কন্যাকে নিয়ে আসবেন!
গিরীন্দ্র রাজি হলেন, বললেন, কখন আসতে হবে বলুন?
তাঁরা বললেন, সন্ধের মুখে।
নির্দিষ্ট দিনে কন্যাকে নিয়ে তিনি সেই সংকীর্তনের আসরে এলেন। শুরু হল প্রবল নামসংকীর্তন। কমলা খুব শান্ত মনে সেই সংকীর্তন শুনছিলেন। হঠাৎ তিনিও যোগ দিলেন সেই সংকীর্তনে। আয়োজকরা কমলার মুখে রামনাম শুনে বেজায় মুষড়ে পড়লেন। তাঁরা বুঝলেন— এই ওষুধে কোনও কাজ হবে না। বিষন্ন গিরীন্দ্র এরপর মেয়েকে নিয়ে ফিরে এলেন তাঁর কলকাতার কালীঘাটের বাড়িতে।
কমলার কথা তখন কলকাতার অনেকেই জানেন। সুদূর বম্বেতেও এই খবর কোনওভাবে পৌঁছে গিয়েছিল। সেখান থেকে কমলাকে দেখতে এলেন বিখ্যাত পরলোকতত্ত্ববিদ ভি ডি ঋষি, সঙ্গে ছিলেন তাঁর স্ত্রী। তিনি সব কিছু পর্যবেক্ষণ করে গিরীন্দ্রনাথকে বললেন, আমি আপনার কন্যার অলৌকিক খবরটি আমার ‘স্পিরিচুয়্যাল বুলেটিন’-এ প্রকাশ করতে চাই। আপনার কী কোনও আপত্তি আছে?
গিরীন্দ্রনাথ বললেন, দয়া করে ওই কাজটি করবেন না, এতে আমার গৃহশান্তি নষ্ট হবে।
শরৎচন্দ্র চট্টোপাধ্যায়ও তখন কলকাতায়। লোকমুখে গিরীন্দ্রের বিপদের কথা শুনে তিনিও ছুটে গেলেন ভাইয়ের বাড়িতে।
শরৎদাকে দেখে লাফিয়ে উঠলেন গিরীন্দ্রনাথ সরকার। দাদাকে অভ্যর্থনা করে ঘরে নিয়ে গিয়ে বসালেন।
শরৎচন্দ্র বললেন, হ্যাঁগো,গিরীন এ কী শুনছি! তুমি শুধু বিলেত ফেরত নও, দুনিয়া ফেরত লোক! শেষকালে তুমিও ভূতে মজলে। কবে থেকে এসবে বিশ্বাস হল তোমার?
গিরীন্দ্র করুণ হেসে বললেন, শরৎদা, বেজায় বিপদে পড়েছি আমি। গত পাঁচ বছর ধরে এই কাণ্ড চলছে। কোনও কিছুই করতে বাকি রাখিনি। শুনেছেন তো আমার ছেলের ঘাড়ে ব্রহ্মদৈত্য ভর করেছেন। আমার ছেলেকে তিনি কিছুতেই ছাড়তে চাইছেন না।
শরৎচন্দ্র বললেন, তোমার মেয়ে কমলার খবরটা কী?
গিরীন্দ্র বললেন, ও সব অতীন্দ্রিয় শক্তির খেলা।! কিন্তু, শরৎদা, তুমি জানলে কেমন করে?
কীভাবে তিনি জানতে পেরেছিলেন সে প্রসঙ্গে না গিয়ে শরৎচন্দ্র বললেন, দেখো, গিরীন, আমি যা শুনেছি তা বিশ্বাস করা আমার কাছে সত্যিই অসম্ভব। তাই তোমার মুখে পুরো ঘটনাটা শোনার জন্য আমি ছুটে এসেছি। কমলার এই ব্যাপারটা কী শুধু পুরীর লোকজনরাই জানেন? নাকি কলকাতার লোকেরাও দেখেছেন।
গিরীন্দ্রনাথ বললেন, শরৎদা, কেন শুধু পুরীর লোকেরা দেখবেন? কমলার এই অলৌকিক শক্তির সাক্ষী রয়েছেন পাটনা হাইকোর্টের জজ রায়বাহাদুর অমরনাথ চট্টোপাধ্যায়, পুরীর ডেপুটি ম্যাজিস্ট্রেট মন্মথনাথ বসু, লখনউ বিশ্ববিদ্যালয়ের ভাইস চ্যান্সেলর রায়বাহাদুর জ্ঞানেন্দ্র চক্রবর্তী, রায়সাহেব উপেন্দ্রনাথ দে, সাহিত্যিক কুমুদবন্ধু সেন ও বিশিষ্ট পরলোকতত্ত্ববিদ ভি ডি ঋষি এবং তাঁর স্ত্রী।
শরৎচন্দ্র হাসতে হাসতে বললেন, তাহলে এই খবরটা কাগজে দিচ্ছ না কেন?
গিরীন্দ্র বললেন, শরৎদা, কী হবে সাধারণের কাছে প্রকাশ করে? মিঃ ঋষিও লিখতে চাইছিলেন। আমি তাঁকে মানা করেছি।
শরৎচন্দ্র তাঁর ভাইয়ের কাছে মিঃ ঋষির পরিচয় জানতে চাইলেন।
গিরীন্দ্র বললেন, মিস্টার ভি ডি ঋষি একজন প্রখ্যাত আইনজীবি। ১৯১৯ সালে তাঁর প্রথমা স্ত্রী সুভদ্রা সন্তানপ্রসব করতে গিয়ে মারা যান। স্ত্রীর অকাল মৃত্যুতে তিনি খুব ভেঙে পড়েছিলেন। এইসময় তাঁর হাতে আসে অলিভার লজের লেখা একটি বই। যেখান থেকে তিনি জানতে পারেন মৃত্যুর পরেও আত্মা বর্তমান থাকে। পরবর্তীকালে ঋষি আবার বিয়েও করেন। বর্তমানে তিনি এবং তাঁর স্ত্রী দুজনেই পরলোকতত্ত্ব নিয়ে বেজায় মেতে আছেন। শরৎদা তাঁরা দুজনেই কিন্তু দারুণ ভালো মিডিয়াম।