বিদ্যার্থীদের বেশি শ্রম দিয়ে পঠন-পাঠন করা দরকার। কোনও সংস্থায় যুক্ত হলে বিদ্যায় বিস্তৃতি ঘটবে। কর্মপ্রার্থীরা ... বিশদ
এটি গিরীন্দ্রশেখর বসুর একটি প্রবন্ধের সূচনাংশ। প্রবন্ধটির নাম ‘শিশুর মন’। গিরীন্দ্রশেখর ছিলেন বিশিষ্ট মনোবিজ্ঞানী। বিশ্বখ্যাত মনোবিদ ফ্রয়েডের সঙ্গেও তাঁর নিবিড় যোগাযোগ ছিল। পরস্পরের মধ্যে নিয়মিত পত্র-বিনিময় হতো। ফ্রয়েড গিরীন্দ্রশেখরের মনোভাবনার মান্যতা দিয়েছিলেন। শুধু বড়দের নয়, ‘শিশুর মন’-ও জানতেন তিনি। রাজশেখর বসুর ভ্রাতা গিরীন্দ্রশেখর ছোটদের কথা ভেবে একটিই বই লিখেছিলেন। ‘লাল-কালো’ বইটি আমাদের শিশুসাহিত্যের চিরায়ত সম্পদ।
গিরীন্দ্রশেখরের খেদোক্তির বাস্তব সত্যতা রয়েছে। সত্যিই তো শিশুদের, শুধু শিশুই বা বলি কেন, সামগ্রিকভাবে ছোটদের মনের অন্দরমহলের খবরাখবর ঠিকঠাক রাখি না আমরা। ছোটদের বুঝি না। বোঝার চেষ্টাও করি না। নিজের শৈশব-বাল্যর সঙ্গে মেলানোর চেষ্টা করে ব্যর্থ হই। ব্যর্থ হওয়াই তো স্বাভাবিক! সময় দ্রুত বদলে যাচ্ছে এই এলোমেলো, বিভ্রান্ত সময় মনের গভীরে গোপনে ছাপ ফেলছে। ছোটদের দিগ্ভ্রান্ত-বিভ্রান্ত করছে। সময়ের শিকার আমাদের সন্তানসন্ততিরাও হচ্ছে। সে সব নিয়ে আমরা সেভাবে ভাবিত নই, বরং তাদের ভুলভাল পথে চালিত করছি। বানাতে চাইছি নিজেদের ইচ্ছাপূরণের যন্ত্র। নিজে যা পারিনি, তার বাস্তবায়ন ঘটাবে সন্তান। গর্বে আমার বুক ফুলে উঠবে। আত্মীয়স্বজনকে জানাব হোয়াটসঅ্যাপে, সর্বসাধারণকে ফেসবুকে। যা-তা বাবা নই, যা-তা মা নই,—তা প্রমাণ করার জন্য আমরা এখন কম-বেশি মরিয়া।
সব সন্তান তো এভাবে ইচ্ছাপূরণের যন্ত্র হয়ে উঠতে পারে না। অসাফল্য প্রবল মনোযন্ত্রণার কারণ হয়ে ওঠে। তাদের কাছে অসহ্য হয়ে ওঠে বাবা-মা’র মানসিক উৎপীড়ন। বুক-ফোলানোর সুযোগ থেকে বঞ্চিত হলে প্রায়শই তারা কাণ্ডজ্ঞানশূন্য হয়ে পড়েন। ব্যর্থতা সাময়িক, অদূরেই রয়েছে সাফল্যের হাতছানি। এসব বলে উজ্জীবিত না করে আমরা আমাদের সন্তান-সন্ততিদের হতাশার অন্ধকারে নিমজ্জিত করি।
আমরা আমাদের সন্তানদের উপর বুঝে, না বুঝে কী ভয়ঙ্কর চাপই না সৃষ্টি করি! আমার আদরের ‘বাছা’ আমারই মতন রক্ত-মাংসের মানুষ, রোবট নয়। সঙ্গত কারণেই বুদ্ধাঙ্কে, ধারণ-ক্ষমতায় তারতম্য থাকতে পারে, ফলে আরেকজনের দৃষ্টান্ত দেখিয়ে তাকে ভর্ৎসনার কোনও মানে হয় না।
এই চাপাচাপিতে প্রিয় সন্তানের প্রাণ যে ওষ্ঠাগত, তা আমাদের বোধগম্য হয় না! এখন আর ইঞ্জিনিয়ারিংয়ে ঢল নেই। বেসরকারি কলেজ অনেক হয়েছে। দোয়াত আছে কালি নাইয়ের মতো কলেজ আছে ছাত্র নেই। ছেলেমেয়েকে এখন আর অনেকেই ইঞ্জিনিয়ার বানাতে চান না, অনেকেরই লক্ষ্য ডাক্তারি। যেন-তেন-প্রকারেণ ডাক্তার বানাতেই হবে। সরকারিতে না হল তো কুছ পরোয়া নেই, বেসরকারি কলেজ তো আছে। রাজ্যে না হলে বহিঃরাজ্যে, বহিঃরাষ্ট্রে যেতেও দ্বিধা নেই, এমনকী নেপাল-বাংলাদেশেও। হয়তো সেখানে ‘ডাক্তার’ বানাবার ‘কল’ আছে, সেই কলে অর্থ জোরে কৌশলে আমরা ডাক্তার বানিয়ে আনছি। ডাক্তার হলেই দেদার অর্থ ‘বাছা’র স্বর্গসুখ না হলেও সর্বসুখ তো বটেই। বাবা-মা’র এমনতরো ইচ্ছে পূরণ করতে গিয়ে সন্তানসন্ততিদের কী অবস্থা হচ্ছে—সে খবর আর কে রাখে!
ডাক্তার তৈরির এই খেলা তো কৈশোরের তারুণ্যের দ্বারপ্রান্তে পৌঁছে। সেই শৈশব থেকেই সীমাহীন চাপ সহ্য করতে হয়। এই চাপ, চাপাচাপি একসময় অসহনীয় হয়ে ওঠে। আশপাশে যত মাঠ ছিল, সব কবেই লোপাট হয়ে গেছে। পেল্লায় ফ্ল্যাট উঠেছে। খেলার মাঠ তো নেই-ই, আর খেলার তেমন ফুরসতই বা কোথায়! পেট-ফোলা ব্যাগ নিয়ে স্কুলে যেতে হয়। স্কুলে হাজার কসরত, বইভারে প্রায় কুঁড়ো হয়ে ফিরতে না ফিরতেই ছোটো কোচিং। যত বিষয়, তত মাস্টারমশাই। এ-কোচিং সে-কোচিং করে পড়ারই সময় পায় না, এরপর আবার মেটাতে হয় বাবার বায়নাক্কা, মা’র আবদার। ছবি আঁকায়, আবৃত্তিতে বা গানে হয়ে উঠতে হয় পারঙ্গম। সেখানেও প্রতিযোগিতা, ফার্স্ট হয়ে পদকটদক নিশ্চিত করার জন্য চলে বাড়তি মেহনত। গল্পের বই পড়ার অবকাশই নেই। ফলে ‘চাঁদের পাহাড়’-এর শঙ্করের সঙ্গে আফ্রিকায়, ‘ভোম্বল সর্দার’-এর ভোম্বলের সঙ্গে গ্রাম থেকে গ্রামান্তরে পরিভ্রমণ হয় না। বই-পড়া নেই মানে তার কল্পনাশক্তি তৈরি হচ্ছে না। যন্ত্রের মতো জীবনে অনুভূতি উপলব্ধিও হারাতে বসেছে। কেমন যেন নিস্তরঙ্গ। জীবন থেকে আনন্দ অদৃশ্য, লোপ পেয়েছে বিস্ময়ও। চারপাশে এখন শুধুই ‘অদ্ভুত আঁধার’, গ্রাস করছে বিষণ্ণতা। আগামী দিনে যারা হবে দেশের কর্ণধার, তাদের বিপন্নতা আমাদের এখনও সেভাবে ভাবাচ্ছে না।
উচ্চাকাঙ্ক্ষা বাড়তে বাড়তে এখন আকাশ ছুঁয়েছে। বাড়ানোর পেছনে আর কেউ নয়, আমরা, মানে অভিভাবককুল। উচ্চাশা, স্বপ্ন—এসব ছাড়া জীবন হয় না। জীবনের অগ্রগতি হয় না। যদি তা বাড়াবাড়ি রকমের হয়ে যায়, তবে তো অবসাদ আসবেই। সেই অবসাদ-অন্ধকারে তাজা কিশোর-প্রাণও তলিয়ে যাচ্ছে, এমনকী চিরতরে হারিয়েও যাচ্ছে। কিশোর-কিশোরীদের মধ্যে আত্মহত্যার প্রবণতা এখন ভয়ঙ্কররকম বেড়েছে। খুব সম্প্রতি কলকাতার নামী বেসরকারি স্কুলের এক ছাত্রী যেভাবে আত্মহত্যার পথ বেছে নিয়েছে, তা বড়ই বেদনার। নিজেকে এভাবে শেষ করে সে বোধহয় আমাদের বোঝাতে চেয়েছে, সন্তানের প্রকৃত হিতাকাঙ্ক্ষী হয়েও আমরা তার হিতাহিত বুঝি না। তাই এভাবে ফুল ফোটার আগেই ঝরে পড়ে, মৃত্যু হয় যাবতীয় সম্ভাবনার। ওই মেয়েটি আকস্মিক ওপথে যায়নি। মাঝেমাঝেই পরম প্রিয়জনকে এভাবেই কেউ কেউ চরম শিক্ষা দিয়ে যায়। তবু আমাদের বোধোদয় হয় না। একের পর এক দুর্ভাগ্যজনক ঘটনা ঘটে।
কেরিয়ার গড়া নিয়ে উৎকণ্ঠা যেমন আছে, তেমনই আছে উদ্বেগ। পরীক্ষা-বৈতরিণী পার হলেও মন-পসন্দ চাকরি যে রাজ্যে নিশ্চিত, তা নয়। ডাক্তার হতে পারলে না হয় স্বাধীন ব্যবসায়
পসার জমানো যাবে! মানুষের অসুখবিসুখের তো আর শেষ নেই! তাই মরীচিকার পেছনেই ছেলেমেয়েরা ধাবমান। দৌড়তে গিয়ে হোঁচট খেয়ে পড়ছে, রক্তাক্ত হচ্ছে।
আমাদের দেশে বড় মানুষের, কৃতী মানুষের অভাব নেই। তাঁরা কেউই এমন চাপের মুখোমুখি দাঁড়াননি। তাঁদের বেড়ে ওঠা, জীবনের লক্ষ্য কখনওই এমন একমুখী ছিল না। তাঁরা আনন্দের সঙ্গে বেড়ে উঠেছিলেন। ছড়িয়ে পড়েছিলেন জীবনের নানা ক্ষেত্রে, সৃজনে মননে। জীবনে প্রতিষ্ঠিত হওয়া, বড় হওয়া নানাভাবেই হতে পারে। গেয়ে, লিখে, এঁকে, এমনকী খেলেও। সুপ্ত থাকা প্রতিভার স্ফুরণ ঘটলে এখন অবশ্য অভিভাবককুল হা-রে-রে-রে করে ওঠেন। উৎসাহ নয়, প্রায়শই জোটে ভর্ৎসনা। ‘কী সর্বনাশ, গোল্লায় গেল’—এই বলে সোৎসাহে মড়াকান্নাও জুড়ে দেন কেউ কেউ।
আগের দিনে পরিবারের একজন উৎসাহিত না করলে অন্য পাঁচজন করত। পরিবারগুলো ছিল বড়সড়, একান্নবর্তী। মিলমিশের অভাব ছিল না। স্নেহ-ভালোবাসা সহমর্মিতা ছিল অফুরান।
একান্নবর্তী পরিবারে কবেই ভাঙন ধরেছে। স্নেহময় ঠাকুরদার, স্নেহময়ী ঠাকুরমার এখন দুর্গতির শেষ নেই। একচিলতে ফ্ল্যাট বাড়িতে সম্পর্কের টানাপোড়েনে খিটিরমিটিরে ছোট শিশুটি বালকত্ব পেরিয়ে কোনওরকমে কৈশোরে পৌঁছয়। পৌঁছনোর সেই পথটি প্রায়শই মসৃণ থাকে না। ফলে অনেক অভিজ্ঞতাই তার কাছে সুখকর হয়ে ওঠে না। এসব বেড়ে ওঠার দিনগুলোকে ধ্বস্ত করে।
ডাক্তারিটাক্তারি না হলে নিদেনপক্ষে এখন সায়েন্স পড়তেই হবে। সায়েন্স না পড়লে জীবন ষোলোআনাই মাটি, মূর্খবৎ এমন ভাবনা এখন অনেককেই পেয়ে বসেছে। আর্টস পড়ে পড়ানোর চাকরি তো হাতের পাঁচ, ডব্লুবিসিএস দিয়ে এ-ক্যাটাগরিতে সফল হয়ে সম্মানজনক চাকরি তো হাতের মুঠোয়। সায়েন্সে ভালোমেয়েদের গিজগিজে ভিড়। আর্টসে ভিড়ভাট্টা তেমন প্রকট নয়, ফলে ‘ভালো’রা গেলে সাফল্য প্রায় অনিবার্য হয়ে ওঠে। এসব নিয়ে বাবা-মা’রা ভাবুন। নতুন করে ভাবুন। ভাবনায় কত ভ্রান্তি আছে, তা নিজেরাই আবিষ্কার করুন।
সব থেকে ভালো হয়, যদি আপনার ‘বাছা’কে নিজের মতো বেড়ে উঠতে দেন। আনন্দে বেড়ে উঠুক। আলো চিনিয়ে দিন, অন্ধকার চিনিয়ে দিন। লক্ষ রাখুন, ঠিকঠাক এগচ্ছে কি না! সামনে পিছনে কত ফাঁদ, চোরাবালি। আপনিই ঈশ্বর, ওকে
রক্ষা করুন। ছোটদের ‘বড়’ করতে হলে আগে শুধরাতে হবে নিজেকে। দয়া করে ওর উপর
মাতব্বরি করবেন না, হ্যাঁ আমরা মাতব্বরিই করি। পারলে সারাক্ষণই বড়ত্ব ফলাই। নিজেকে শুধরানোর সময় এসেছে।