বিদ্যার্থীদের বেশি শ্রম দিয়ে পঠন-পাঠন করা দরকার। কোনও সংস্থায় যুক্ত হলে বিদ্যায় বিস্তৃতি ঘটবে। কর্মপ্রার্থীরা ... বিশদ
এই মুহূর্তে বঙ্গ রাজনীতিতে বহুল চর্চিত শব্দটি হল ‘বেনোজল’। লোকসভা নির্বাচনে পশ্চিমবঙ্গে গেরুয়া শিবিরের আশাতীত সাফল্যের পর রাজনীতির কারবারিরা বিজেপির বাজার ধরার চেষ্টায় মরিয়া। তার মধ্যে খুচরো কারবারি যেমন আছে, তেমনই আছে পাইকারি কারবারিও। প্রতিদিন রাজ্যের কোনও না কোনও প্রান্তে তৃণমূল, সিপিএম এবং কংগ্রেস ছেড়ে বিজেপিতে যোগদানের ঘটনা ঘটেই চলেছে। নেতাদের ওজন অনুযায়ী দিল্লি, কলকাতা ও জেলায় যোগদানের জন্য ম্যারাপ বাঁধা হচ্ছে। তবে দিল্লির ক্রেজটা একটু বেশি।
তবে লাভপুরের তৃণমূল মনিরুল ইসলামের যোগদানের পর বিজেপিতে ক্ষোভ-বিক্ষোভ তৈরি হওয়ায় বিষয়টা একটু ঘেঁটে গিয়েছে। যাঁরা বাঁচার জন্য পড়ি কি মরি করে ঝাঁপ দেওয়ার জন্য তৈরি হয়ে গিয়েছিলেন, তাঁরা আপাতত ব্রেক কষেছেন। কারণ এক গোষ্ঠীর হাত ধরে বিজেপিতে যোগ দিলে অন্য গোষ্ঠীর শীর্ষ নেতৃত্ব ‘ভেটো’ দিয়ে দিচ্ছে। ফলে একবুক স্বপ্ন নিয়ে নতুন দলে যোগ দেওয়ার পর কেউ চাপে পড়ে পদত্যাগ করছেন, কেউ আবার যোগদানের পর নতুন দলে গুরুত্ব না পেয়ে কারও কারও ‘ঘরওয়াপসি’ও হচ্ছে। তাই অনেকেই আরও একটু দেখে নিতে চাইছেন। নিদেনপক্ষে আগামী পুরসভা ভোট পর্যন্ত। কারণ এখনও কী হয়, কী হয় একটা ভাব তাঁদের মনের মধ্যে গুর গুর করছে। তাঁরা ভাবছেন, শেষ মুহূর্তে হাওয়া যদি কোনও কারণে ঘুরে যায় তাহলে ‘জাতও যাবে, পেটও ভরবে না।’
তবে, এসব হওয়ার কারণে যোগদান পর্বে ছেদ পড়েছে এমনটা ভাবার কোনও কারণ নেই। বেনোজলের স্রোত অব্যাহত। কারণ মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় কাটমানি ফিরিয়ে দেওয়ার যে নির্দেশ দিয়েছেন তাতে তৃণমূলের বহু চুনোপুঁটি থেকে রাঘব বোয়ালের প্রাণ ওষ্ঠাগত হওয়ার জোগাড়। বিজেপি ও সিপিএমের প্রাক্তনীদের উস্কানিতে চলছে বিক্ষোভ কর্মসূচি। আর সেই জনরোষ থেকে বাঁচতে কাটমানিতে উদরপূর্তি করা নেতাদের একটা বড় অংশ নিরাপদ আশ্রয় হিসেবে গেরুয়া শিবিরকেই বেছে নিতে চাইছে। কারণ তারা ভাবছে, এই মুহূর্তে গেরুয়া পাঞ্জাবি আর গেরুয়া টিপ সব চেয়ে বড় রক্ষাকবচ। আর গেরুয়া শিবির এখন গঙ্গাজলের চেয়েও পবিত্র। একবার গায়ে মেখে নিতে পারলেই ওঁ শান্তি।
প্রশ্ন উঠেছে, দক্ষিণ দিনাজপুরের তৃণমূল নেতাদের বিজেপিতে যোগদানকে ঘিরে। তৃণমূলের প্রাক্তন জেলা সভাপতি বিপ্লব মিত্র জেলা পরিষদের সভাধিপতি সহ ১০ জন সদস্যকে নিয়ে বিজেপিতে যোগ দিয়েছেন। ফলে জেলা পরিষদ এখন বিজেপির। তৃণমূলের স্টাইলে নির্বাচনে না জিতেও জেলা পরিষদ দখলের দৌলতে গেরুয়া শিবিরের শ্রীবৃদ্ধি অবশ্যই হয়েছে। কিন্তু গৌরব বৃদ্ধি হয়নি। দক্ষিণ দিনাজপুরের তৃণমূলের নেতারা বিজেপিকে এরাজ্যে প্রথম জেলা পরিষদ দখলের সম্মান এনে দিয়েছেন ঠিকই। কিন্তু প্রশ্ন উঠছে, কাটমানি ফেরতের কী হবে?
যোগদানের আগে কাটমানি ইস্যুতে দক্ষিণ দিনাজপুরে জেলা পরিষদের সদস্যদের বাড়ির সামনে যে বিক্ষোভ শুরু হয়েছিল তা থেমে গেল কেন? তাহলে যোগদানের আগে যে বিক্ষোভ শুরু হয়েছিল, সেটা কি ভুল ছিল? নাকি বিজেপির গঙ্গাজলে সবই পবিত্র হয়ে গেল? বহু জায়গায় পঞ্চায়েত প্রধান সহ তৃণমূলের অধিকাংশ সদস্য বিজেপিতে চলে যাচ্ছেন। সেখানেও কি ‘গঙ্গাজল’ কাজ করছে?
একটা কথা মনে রাখা দরকার, বেনোজলের সঙ্গে মাছ যেমন আসে, তেমনি আসে সাপখোপ, বোয়াল। বোয়াল পুকুরে ঢুকে গেলে রুই, কাতলারাও রেহাই পায় না। বোয়ালের দাঁত ভীষণ ধারালো, খিদেও প্রচুর। তাই বেনোজলের পুকুর ভর্তিতে যাঁরা আহ্লাদিত হচ্ছেন, তাঁদের একবার বোয়ালদের বিপদটাও ভাবা দরকার।
বেনোজল পুকুরে ঢুকে যাওয়ায় স্বচ্ছ জলও ঘোলা হয়ে যাচ্ছে। বিষয়টা আদিরা মেনে নিতে পারছেন না। ২০১১ সালের পর তৃণমূলে এমনটাই ঘটেছিল। রাজ্যে পরিবর্তনের পর সিপিএম সহ বামেদের স্রোত আছড়ে পড়েছিল। দলকে বড় করার আশায় তৃণমূলের নেতারা শুধু দরজা খুলেই দেননি, অতিথি জ্ঞানে আপ্যায়নও করেছিলেন। লাভপুরে মনিরুল ইসলাম সহ প্রায় গোট ফরওয়ার্ড ব্লকটাই তৃণমূলে ঢুকে গিয়েছিল। একই ঘটনা ঘটেছিল নানুরেও। ফরওয়ার্ড ব্লক থেকে যোগ দেওয়া অভিজিৎ সিংহ ওরফে রাণা তৃণমূলে যোগ দেওয়ার পর তিনিই হয়ে ওঠেন অনুব্রত মণ্ডলের ছায়াসঙ্গী ও প্রধান পরামর্শদাতা। আর তাতেই অনুব্রতবাবুর সঙ্গে দূরত্ব বাড়তে থাকে শেখ শাহনওয়াজ, তাঁর ভাই কাজল শেখের মতো তৃণমূলের দুর্দিনের নেতা-কর্মীদের।
এমনকী, আশিস বন্দ্যোপাধ্যায়ের মতো অধ্যাপক মানুষও আত্মসম্মান বজায় রাখার জন্য কুঁকড়ে থাকতেন। এনিয়ে আদি তৃণমূলীদের মধ্যে তীব্র ক্ষোভ ছিল। এটা কোনও বিচ্ছিন্ন ঘটনা নয়, রাজ্যের প্রতিটি জেলায় এমন অজস্র উদাহরণ রয়েছে যেখানে জার্সি বদলে বামেরাই হয়ে উঠেছিলেন ঘাসফুল শিবিরের নিয়ন্ত্রক।
‘লাল তৃণমূলে’র দাপটে দমবন্ধ হতে বসা আদি তৃণমূলীরাই বিভিন্ন এলাকায় পঞ্চায়েত ভোটে কোথাও নির্দল দাঁড় করিয়েছিলেন, কোথাও তলে তলে বিজেপিকে সমর্থন করেছিলেন। পঞ্চায়েত ভোটে বিক্ষুব্ধরা যে বীজ রোপন করেছিলেন, লোকসভা ভোটে সেটাই হয়েছে মহীরুহ।
বিজেপির রাজ্য সভাপতি দিলীপ ঘোষ সম্ভবত বিপদটা কিছুটা হলেও উপলব্ধি করেছেন। তাই তিনি বোয়ালদের দলে অনুপ্রবেশ ঠেকাতে পুকুর পাড়ে জাল দেওয়ার একটা চেষ্টা করছেন। কেশপুরের আনন্দপুরে এক জনসভায় তাঁর ভাষণে অন্তত তেমন মনোভাবই প্রকাশ পেয়েছে। তিনি বলেছেন, ‘দল বাড়াতে হলে তৃণমূলকে ভাঙতে হবে। তাই তৃণমূল থেকে যাঁরা আসছেন তাঁদের নিতে হবে। কিন্তু, টাকাটা মিটিয়ে আসতে হবে।’
গত লোকসভা ভোটের নিরিখে তৃণমূল কংগ্রেসের এক ধাক্কায় ১২টি আসন কমে গেলেও শতাংশের বিচারে ভোট বেড়েছে। সাধারণত কোনও দলের ভোট বাড়লে ভাঙন হয় না। কিন্তু, লোকসভা ভোটের পর বিভিন্ন জেলায় তৃণমূলের নেতারা বিজেপিতে যাচ্ছেন এবং যাওয়ার মরিয়া চেষ্টা চালাচ্ছেন। তৃণমূল থেকে বিজেপিতে মূলত দু’ধরনের নেতা কর্মী যাচ্ছেন। একটা অংশ যাঁরা দীর্ঘদিন দলে কোণঠাসা। ‘কাটমানি নেতাদের’ বিরুদ্ধে জেলা ও রাজ্য নেতৃত্বকে জানিয়েও কিছু করতে পারছিলেন না, তাঁরা যাচ্ছেন। আর যাচ্ছেন তাঁরাই, যাঁরা কাটমানি ও কমিশনের দৌলতে আজ জমি, বাড়ি, গাড়ির মালিক। তাঁরা বাঁচার তাগিদে বিজেপিতে ভিড়ছেন।
দ্বিতীয় পর্যায়ের নেতাদের মধ্যে বেনোজলে গা ভাসানোর আকাঙ্ক্ষা প্রবল। কারণ রাজনীতিই এঁদের পেশা। ক্ষমতার সঙ্গে না থাকলে সংসার টানাই দায়। বিলাসিতা তো দূর অস্ত। এই সব কাটমানি নেতার একটাই পলিসি, এলো মেলো করে দে মা, লুটেপুটে খাই।
নব্যদের নিয়ে বিজেপির আদিরা কী ভয়ঙ্কর চাপে এবং অশান্তিতে আছে, তা একটা ঘটনার কথা উল্লেখ করলেই কিছুটা মালুম হবে। বর্ধমান স্টেশন এলাকায় একদা সিপিএমের অ্যাকশন স্কোয়াডের লিডার বলে পরিচিত খোকন সেন ও তাঁর অনুগামীরা কিছুদিন আগে বিজেপিতে যোগ দেন। তার দু’দিনের মধ্যে বিজেপির যুবমোর্চার জেলা সভাপতি শ্যামল রায়ের সঙ্গে খোকনবাবুর লড়াই লেগে যায়। উভয় গোষ্ঠীর গণ্ডগোল এমন চরমে ওঠে যে, বিজেপি জেলা অফিসে গুলি পর্যন্ত চলে। তার জের হিসেবে শ্যামল রায়ের বাড়িতে হামলা হয়।
জেলায় জেলায় নব্যদের নিয়ে বিজেপির আদিদের ক্ষোভ রয়েছে। আর এই ক্ষোভের অন্যতম কারণ যোগদানকারীদের বেশিরভাগই এক সময় হয় সিপিএমের হার্মাদ বাহিনীর সদস্য ছিলেন, অথবা তৃণমূলের ‘কাটমানি নেতা’। তাই এই সব নেতাকে নিয়ে স্বচ্ছ রাজনীতির স্লোগান মানুষ বিশ্বাস করবে না। উল্টে লোকসভা ভোটে যাঁরা নীরবে সমর্থন করেছিলেন, তাঁরা ফের নিঃশব্দেই মুখ ফিরিয়ে নেবেন।
‘ফ্লোটিং ভোট’ যে মুখ ঘুরিয়ে নিতে পারে, সেটা বিজেপির পোড়খাওয়া নেতারা বুঝতে পারছেন। তাঁরা বলছেন, ভোটের ফল প্রকাশের পর যাঁরা আসছেন তাঁরা কেউই বিজেপির আদর্শের জন্য আসছেন না, আসছেন বাঁচার তাগিদে। কেউ কেউ লুটেপুটে খাওয়ার অভ্যাস বজায় রাখার আশায়। তাই দলের বৃদ্ধির কথা ভেবে লকগেট খুলে দিয়ে অবাধে বেনোজল ঢোকার সুযোগ করে দিলে পরিণতি ভালো নাও হতে পারে। কারণ অতি বৃদ্ধি অনেক সময় ক্যান্সারের লক্ষণ হয়ে থাকে।