বিদ্যার্থীদের বেশি শ্রম দিয়ে পঠন-পাঠন করা দরকার। কোনও সংস্থায় যুক্ত হলে বিদ্যায় বিস্তৃতি ঘটবে। কর্মপ্রার্থীরা ... বিশদ
——— রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর
সাম্প্রতিক পাতাল রেলের দুর্ঘটনা নাড়িয়ে দিয়ে গেছে শহর কলকাতাকে। আমাদের আত্মবিশ্বাসকে একেবারে কাঁপিয়ে দিয়েছে এই ঘটনা। দুর্ঘটনায় মৃত্যু আসে বারবার, সময়ের সঙ্গে তা সয়েও যায়। মানুষটাকে মনে থেকে যায় খুব কাছের কিছু আত্মীয়-স্বজনের। বাকিদের কাছে বিষয়টা প্রতিদিন দাঁত মাজার মত। সকালের চোখ বোলানো সংবাদপত্র, কিংবা বিকেলের সিরিয়ালের ফাঁকে চটজলদি খবরের চ্যানেল। এর মাঝেই জাল দিয়ে দুভাগ করা ছোট্ট টেবিলে পিংপং বলের মত জীবন আর মৃত্যুর খবর। নিজের গায়ে ছ্যাঁকা না লাগলে পুরোটাই অন্য জগতের, টেবিলের অন্য পাশটার। একটু তলিয়ে ভাবলে কিন্তু বিশ্বজুড়ে দুর্ঘটনায় কত মানুষ মারা যাচ্ছেন সে সংখ্যা চমকে ওঠার মত। এ দুনিয়ায় প্রতিদিন পথ দুর্ঘটনায় মারা যান তিন হাজারের বেশি মানুষ, আর তাদের অর্ধেকের বয়েস সাধারণভাবে ১৫ থেকে ৪৪ এর মধ্যে। শুধু আমাদের দেশেই প্রতিদিন পথ দুর্ঘটনায় মৃত্যুর সংখ্যা চারশোর মত। সোজা হিসেবে নিজেকে আপনি প্রতিদিন মরতে দেখছেন না, অথবা নিজে মরার কথা ভাবছেন না একেবারেই। কিন্তু এদেশে প্রত্যেকটি দিন কমবেশি চারশো বাড়িতে কান্নার রোল। অন্তর্জাল খুঁজে যা তথ্য পাওয়া যাচ্ছে তাতে মার্কিন দেশে প্রতিদিন পথ দুর্ঘটনায় মৃত্যুর সংখ্যা একশোর কিছুটা বেশি। অঙ্কের তাতে অসুবিধে নেই, কারণ সহজ অনুপাত কষলেই বোঝা যায় ভারতের জনসংখ্যা মার্কিন দেশের থেকে যতটা বেশি তাতে ভারতে বেশি লোক মরার সম্ভাবনা বাড়বেই। আর্থসামাজিক প্রেক্ষিত আলোচনা করলে সঙ্গে আরও কয়েকটি বিষয় যোগ হবে। যেখানে খুব সহজেই অনুসিদ্ধান্তে আসা যাবে যে গরিব মানুষের জীবনের দাম কম। ঠিক সেই কারণেই বিহার বা উত্তরপ্রদেশে এনসেফেলাইটিসে শিশু মৃত্যুর সংখ্যা সহজেই একশো ছাড়িয়ে যায়, যেমনটা ইউরোপ বা আমেরিকায় বছর বছর ঘটে না।
একথা তো মানতেই হবে যে মৃত্যুর সবথেকে বড় কারণ জন্ম। আপাতত বিজ্ঞানের যা অবস্থা তাতে জন্মালে মরতেই হবে। হয়তো বছর পঁচিশ পরে এমন সময় আসবে যখন যন্ত্রপাতি বসিয়ে অমর হওয়ার ব্যবস্থা করা যাবে, তবে তার খরচ সাধারণ মানুষের নাগালে থাকবে না। অল্প কজন মানুষ সেই সুযোগ পাবেন। ঠিক যেমন কর্কট রোগ থাবা বসালে মার্কিন দেশে গিয়ে অনেক ভালো চিকিৎসা করানো যায়, জীবন লম্বা হয় অনেকটা। কিন্তু আমাদের দেশে ক্যান্সার আক্রান্তদের মধ্যে বেশিরভাগেরই সঠিক চিকিৎসা করানোর, কিংবা বলা ভালো চিকিৎসা পাওয়ার সুযোগই নেই। মার্কিন দেশ তাই স্বপ্নের চলচ্ছবিতে ঘুরঘুর করে। তবে জীবন বিজ্ঞানের প্রাথমিক স্তরের বিদ্যায় আপাতত এটুকু সহজবোধ্য যে নিজে কেঁদে ভূমিষ্ঠ হলে ভবিষ্যৎ নিশ্চয়তার সঙ্গে খোদাই হয়ে যায়। তার পরের কোনও একটা সময় কেউ কাঁদুক বা না কাঁদুক, নশ্বর দেহ ত্যাগ করে পটল খেতে কাগতাড়ুয়া হতেই হবে। বিষয়টায় সবথেকে মুশকিল হল, জন্ম আর মৃত্যু কোনওটাই মানুষের নিজের হাতে নেই। ভাটপাড়ায় গুলিবিদ্ধ ফুচকাওয়ালা তাই পুতিনের ছেলে না হওয়ার জন্যে বিধাতাকে দোষ দিতেই পারে। শীতাতপ নিয়ন্ত্রিত গাড়ি না থাকায় ভিড় মেট্রোয় কিংবা বনগাঁ লোকালে ফেরিওয়ালার মৃত্যু শেখায় পূর্ণ সংখ্যা থেকে ভগ্নাংশের অঙ্ক। সমান্তরাল লোহারেখার সারির মাঝে চাঁদের আলোয় চিকচিক করে সস্তার বয়াম-ভাঙা হিরের টুকরো। সঙ্গে মণিমুক্তো লাল-নীল-সবুজ টাকায় দুটো আর গুণ ভুল করা দুটাকায় পাঁচটা চিনির মণ্ড। কাঁধে ঝোলা-বওয়া “চুষতে থাকুন” তখন আর কখনও না ফেরা হলুদ পাখি। গ্রুপ থিয়েটারের আঁতলামোর ফাঁকে নন্দন চত্বরে বেখাপ্পা হাওয়ায় যদৃচ্ছ উড়ে বেড়ায় পথ হারানো লিটল ম্যাগাজিনের পাতা। যেগুলো ছেঁড়ে নি, যাদের ছেঁড়া হয়েছে ঝালমুড়িকে আস্তানা দেওয়ার জন্যে। সে পাতায় ভাসা মৃত্যুর গন্ধ মাখা দীর্ঘ কবিতার ছুটি নেই কোনও।
আসলে মৃত্যু তো বাড়বেই। এখনই এই গ্রহের জনসংখ্যা সাতশো কোটি। গত এগারোই জুলাই গেল বিশ্ব জনসংখ্যা দিবস। নামী হোটেলে নৈশভোজের আসরে নড়েচড়ে বসলেন বিশেষজ্ঞরা। জানা গেল দক্ষিণ এশিয়ার বিভিন্ন জায়গায় দরিদ্র পরিবারের সন্তানসন্ততির সংখ্যা চার থেকে পাঁচ। পাকিস্তানে এ সমস্যা প্রচণ্ড। সর্বভারতীয় সংবাদমাধ্যমে গুরুগম্ভীর ইংরেজি আলোচনায় গাঢ় অক্ষরে লেখা হল একই অবস্থা নাকি বিহার, উত্তরপ্রদেশ, পশ্চিমবঙ্গ বা কাশ্মীরে। এ সমস্ত তথ্য অর্থনীতির পক্ষে ভীষণ বিপদের। বুঝতে অসুবিধে হয় না যে বিত্তশালীদের কমসংখ্যক ছেলেমেয়ে এবং নিম্নবিত্তদের বৃহৎ পরিবার অর্থনৈতিক বৈষম্য এবং সামগ্রিক অসাম্যকে অনেকগুণ বাড়িয়ে দেবে। উন্নত দেশে রাস্তা দিয়ে মানুষ হাঁটলে অনেক দূরে দাঁড়িয়ে যায় চলমান যানবাহন। কলকাতার রাজপথে যিশু হেঁটে বেড়ায় অবলীলায়, বাস, ট্রাম, ট্যাক্সির সঙ্গী হয়ে। মানুষ বাড়লে, এবং বিশেষ ভাবে নিম্নবিত্ত মানুষের সংখ্যা দ্রুতহারে বাড়তে থাকলে জীবনের দাম কমা ভাগের অঙ্কের মতই বাস্তব। সেজন্যে তো ব্যবস্থা নেবে সরকার। কাছের ভারতবর্ষই হোক কিংবা সুদূর সুদান, জনসংখ্যা নিয়ন্ত্রণ সরকারের দায়িত্ব। সমর্থ সরকার সেই দায়িত্ব নেবে, জনপ্রিয়তা কমলেও। আর ভবিষ্যতের দায় যদি না থাকে তাহলে যেমন চলছে তেমনটাই চলুক। বিশ্বের জনসংখ্যা যতদিনে হাজার কোটি ছোঁবে, তার আগেই চীনকে হারিয়ে আমরা পৌঁছব প্রথম স্থানে। সঙ্গে থাকবে আশেপাশের অনুন্নত দেশের মানুষের চাপও। রাজনীতির কচকচিতে মিলেমিশে একাকার হবে শরণার্থী আর অনুপ্রবেশকারী।
জনসংখ্যা বৃদ্ধির সমস্যাকে যে মানচিত্রের দেশভাঙা রেখা দিয়ে সমাধান করা যাবে না সে বোধটুকুই এখনও আত্মস্থ হয়নি বিশ্বের সেরা রাষ্ট্রনায়কদের। তবে মৃত্যুর বাস্তবতা এবং নিশ্চয়তার সঙ্গে মনুষ্যত্বকে গুলিয়ে ফেললে খুব ভুল হবে। রাস্তায় ভিড়, পরিষেবা অপ্রতুল, পরিকাঠামো ঝরঝরে এসব কথা বলে মৃত্যুকে যৌক্তিক করার চেষ্টা বড়ই অমানবিক। যে মানুষটি আত্মহত্যা করেন, তার মৃত্যুকেও সম্মান জানানোর দায় থাকে এই সমাজের। মুহূর্তের অসতর্কতায় কেউ দুর্ঘটনায় মারা গেলে রাজনীতি হবে সেটাই স্বাভাবিক। কারণ রাজনীতির কারবারিদের এক বড় মূলধন মৃত্যু।
তা বলে প্রয়াত সেই মানুষটিকে অসতর্কতার
জন্যে দুষলে পৌরুষত্ব দেখানো যেতে পারে, কিন্তু সেক্ষেত্রে মননশীলতার মাথা মাছের বাজারে সস্তায় বিক্রি হবে।
সেই প্রেক্ষিতেই টেলিভিশনে দৈনন্দিন মৃত্যু দেখে সাধারণ মানুষ অভ্যস্ত হয়ে গেলে মুশকিল। সরকারি হাসপাতালে কোনও এক রাতজাগা চিকিৎসক স্বপ্ন খুঁজে পান এক হতদরিদ্র শিশুর জীবন বাঁচানোর উল্লাসে। বাংলাদেশের এক জাহাজ ভর্তি মাল্লা আনন্দে গর্জন করে ওঠেন চারদিন সমুদ্রে ভাসা এ বঙ্গের এক জীবন্ত মাঝিকে উদ্ধার করে। রাস্তার মাঝে চিৎ হয়ে দিবানিদ্রায় মগ্ন বমি-মাখা মদ্যপকে মাথায় জল ঢেলে ফুটপাথে তুলে দেয় কোনও অজানা বন্ধু। তাই কার দায়, কোনও রাজনীতি, নামী বেসরকারি হাসপাতালে কার ভুলে প্রসূতির মৃত্যু, মেট্রো রেলের কামরার ভেতর আর বাইরে ভাগ হওয়ার অসহায়তা, এসব মেনে নিয়েও কাজ করুক সামান্য সহমর্মিতা। একটু শিউড়ে উঠে ভাবা যাক অন্যের এই মৃত্যুটা নিজেরও হতে পারত। আর সেটা যে হয় নি সেখান থেকেই আর একবার জন্মাক প্রতিদিনকার জীবন। মৃত্যু থেকে মুখ ফিরিয়ে নয়, তাকে সামনা-সামনি রুখে দিয়ে—“জগৎটাকে গায়ের চামড়ার মত আঁকড়ে ধরে”।