বিদ্যার্থীদের বেশি শ্রম দিয়ে পঠন-পাঠন করা দরকার। কোনও সংস্থায় যুক্ত হলে বিদ্যায় বিস্তৃতি ঘটবে। কর্মপ্রার্থীরা ... বিশদ
রাজনৈতিক পর্যবেক্ষকদের এই ভাবনা যে খুব অমূলক নয় তা বলাই বাহুল্য। লোকসভা ভোটে ১৮ আসনের ধাক্কা খাওয়ার পর তৃণমূলের এটাই প্রথম বড় সমাবেশ। শুধু তাই নয়, আগেই বলেছি, এই সমাবেশের সঙ্গে শহিদ স্মৃতির একটা বিশেষ আবেগ জড়িত। সিপিএম নেতৃত্বাধীন বাম সরকারের অন্যায়-অবিচারের বিরুদ্ধে লড়াই করতে গিয়েই দলের ১৩ জন কর্মী-সমর্থক প্রাণ হারিয়েছিলেন—এই সত্যটি ঘুরেফিরে ফিরে আসে এই সমাবেশের আবহে। ফলে, সমবেত কর্মী সমর্থকদের লড়াই মানসিকতায় সংকল্পের একটা বাড়তি মাত্রাও যোগ হয়। তার উপর দলনেত্রী মমতার উপস্থিতি এবং বক্তব্যে সেই সংকল্পের জোর যে আরও বেড়ে যায় তাতেই বা আশ্চর্য কী? এই দিক থেকে দেখলে এবারের ২১ জুলাইয়ের সমাবেশের গুরুত্ব ও তাৎপর্য বিগত বছরগুলির তুলনায় যে অনেকটাই বেশি—তা বলার অপেক্ষা রাখে না। এবং সেই কথা মাথায় রেখে তৃণমূলও প্রচার সভা-সমিতি নিয়ে ঝাঁপিয়ে পড়েছে—সে তো দেখাই যাচ্ছে। কিন্তু, এই সমস্ত উদ্যোগ আয়োজনের মাঝে এটাও সত্য—সমাবেশ নিয়ে আয়োজক ও সমর্থক মহলে সংশয়ের কিছু কাঁটাও ইতস্তত বিক্ষিপ্তভাবে খোঁচা দিয়ে চলেছে। এবারের সভায় ভিড়ের বহর বজায় থাকবে তো? গতবারের রেকর্ড ভেঙে শহিদ সমাবেশ উপচে পড়বে তো? আসলে প্রশ্ন একটাই—বয়ানটাই যা দুরকম। এরই পাশাপাশি আরও একটি বিষয়ে তৃণমূলের নেতা-কর্মী সমর্থকদের মধ্যে এখন কৌতূহল চরমে—আর তা হল—এবার কী বার্তা দেবেন দলনেত্রী? তবে, এই কৌতূহল কেবল তৃণমূল শিবিরেই সীমাবদ্ধ নেই, ছড়িয়ে পড়েছে আসমুদ্রহিমাচল। বলতে কী, আজ ২১ জুলাই সমাবেশে মমতা কী বার্তা দেন জানতে উৎসুক গোটা বাংলাই।
কারণ, লোকসভা ভোট পরবর্তী পশ্চিমবঙ্গের রাজনৈতিক লড়াইয়ের ময়দানে মুখ্যমন্ত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ের প্রভাব প্রতিপত্তি অক্ষুণ্ণ অটুট থাকলেও পরিস্থিতির বিচারে অনেকেই বলছেন, এখন আর তৃণমূল একচ্ছত্র এক নয়, বিজেপির গেরুয়া বাহিনীও সমান তালে তাল ঠুকছে। বিগত ভোটের ১৮ আসন এ রাজ্যে বিজেপির জোরালো প্রতিষ্ঠার প্রাথমিক কাজটি সেরে দিয়েছিল। অতঃপর কেন্দ্রে নরেন্দ্র মোদি সরকারের প্রবলভাবে ফিরে আসার সুবাদে রাজ্য বিজেপির জোশ আরও বেড়েছে। ২০২১ সালে বিধানসভা জয়ের স্বপ্নও দেখতে শুরু করেছে পদ্ম শিবির। সেই সুবাদে বহুদিনই শুরু হয়ে গেছে রাজনৈতিক ও পেশি ক্ষমতা প্রদর্শনের প্রক্রিয়া। ভোটের আগে-পরের সংঘাত সংঘর্ষে একসময় যেমন তৃণমূল-সিপিএমের নাম উঠে আসত, এখন উঠে আসছে তৃণমূল-বিজেপির নাম। খুন, পাল্টা খুন, মারদাঙ্গা, বাড়িঘর জ্বালানো, মিছিল, পাল্টা মিছিল, হুমকি শাসানির পাল্টা—সবই চলছে অকাতরে! সকলেই জানেন, পরিস্থিতি চরমে পৌঁছেছিল নৈহাটি ভাটপাড়া শিল্পাঞ্চলে। সেখানে এখনও তুষের আগুনের মতো জ্বলছে রাজনৈতিক সন্ত্রাসের আগুন। এখনও পুরোপুরি স্বাভাবিক হতে পারেনি সাধারণ জনজীবন, সবসময়ই একটা ভয় আতঙ্ক তাড়া করে বেড়াচ্ছে স্থানীয় সাধারণ জনতাকে।
শুধু তাই নয়, মুকুল রায়ের উদ্যোগে তৃণমূল ভাঙিয়ে রাজ্যের শাসকদলের নেতানেত্রী কাউন্সিলার চেয়ারম্যান অভিনেতা অভিনেত্রীদের বিজেপি শিবিরে শামিল করার যে প্রক্রিয়া শুরু হয়েছে তাতেও খানিকটা অস্বস্তি দেখা দিয়েছে শাসক শিবিরে। আবার তার মধ্যেই যখন বিজেপিতে যোগ দেওয়ার কদিন বাদেই ঘরে ফিরছেন কাউন্সিলার বা অন্যরা তখন নিঃসন্দেহে অস্বস্তি অনেকটা উবে গিয়ে তৃণমূলের মনোবল পাচ্ছে বাড়তি অক্সিজেন। দলবদলুদের এই আসা-যাওয়া নিয়েও দুপক্ষের তরজা, দাবি, পাল্টা দাবি অবশ্য অব্যাহত। পরিস্থিতি দেখে আমার এক সুরসিক বন্ধুর মন্তব্য, আরে বাবা, কোনদিকে থাকলে ভবিষ্যতে ‘ফায়দা’ বেশি সেই হিসেব যারা গুলিয়ে ফেলছে তারাই অমন খাবি খাচ্ছে, গেরুয়া না সবুজ, ঘাসফুল না পদ্মফুল—ভুগছে দোটানায়! হয়তো তাই। কারণ, রাজনৈতিক আদর্শের টানে দলবদল চলছে—এমনটা বোধহয় কেউই বিশ্বাস করেন না!
কিন্তু সে যাই হোক, সবমিলিয়ে রাজ্য রাজনীতির পরিসরে উত্তেজনা যে বেশ টানটান তা স্বীকার করছেন সকলেই। তৃণমূল-বিজেপির শক্তিক্ষমতার দ্বন্দ্বটা এখনও সমানে সমানে বলা না গেলেও যে প্রায় তুল্যমূল্য এবং বিগত ভোটে পদ্ম শিবিরের ভোটপ্রাপ্তি যে শাসককে যথেষ্ট চিন্তায় ফেলেছে তা রাজনৈতিক পর্যবেক্ষকদের অনেকেই বলছেন। নির্বাচন বিশেষজ্ঞ প্রশান্ত কিশোরের নিযুক্তি এবং তৃণমূলের পরবর্তী ভোট প্রস্তুতিতে তাঁর সক্রিয় ভূমিকাকে পর্যবেক্ষকেরা তাঁদের বক্তব্যের যুক্তি হিসেবে খাড়া করছেন। যতদূর খবর সমবেত মানুষজনের মনের খবর নিতে আজ সমাবেশেও সক্রিয় থাকছেন প্রশান্ত কিশোর এবং তাঁর টিম। তবে, প্রশান্ত কিশোর কেবল বিজেপি ঠেকাতে এসেছেন—এমন ভাবনা কি একেবারে একমাত্রিক হয়ে যায় না! এমনকী হতে পারে না যে ভবিষ্যতের জন্য দলীয় ভিত অধিকতর মজবুত করতে এবং বাংলার জনমন দখলে রাখতে কী করা উচিত, কী করা উচিত নয়, কী বলা উচিত, কী বলা উচিত নয় সেসব ভালো করে বুঝে নিতেই টিচার প্রশান্তর শরণাপন্ন হয়েছে তৃণমূল! সংগঠনশক্তি অটুট এবং ক্রমবর্ধমান রাখতে পারলে বিজেপি কেন ভবিষ্যতে কোনও রাজনৈতিক আক্রমণই দলীয় আত্মপ্রত্যয়ে চট করে চিড় ধরাতে পারবে না, কর্মী-সমর্থকদের মধ্যে সংশয়ও তৈরি করতে পারবে না। সেই লক্ষ্যেই প্রশান্ত কিশোরের আইপ্যাক নিয়োগ—হতে পারে না?
অবশ্যই হতে পারে। এবং সেদিক থেকে আজকের সমাবেশ প্রশান্ত কিশোরেরও পরীক্ষা বটে। কিন্তু, আজ বাংলার মানুষের যাবতীয় কৌতূহল কেন্দ্রীভূত হয়ে আছে মুখ্যমন্ত্রী তথা তৃণমূলনেত্রী মমতার বার্তার ওপর। রাজ্যের বর্তমান পরিস্থিতির মোকাবিলায় তিনি কোন পথ দেখান, দলবদলু বা যাঁরা দল-বদল নিয়ে উভয় সঙ্কটে ভুগছেন বা যাঁরা দলে বসে বসেই অলক্ষ্যে সিঁদ কাটছেন তাঁদের ক্ষেত্রে দলীয় শৃঙ্খলা রক্ষার কী দাওয়াই দেন, সিপিএম, কংগ্রেসের সঙ্গে রাজনৈতিক সম্পর্ক বিষয়েই বা কী বলেন এবং সর্বোপরি এবারের সমাবেশের মূল স্লোগান—মেশিন ফেলে ব্যালট ভোটে ফেরার জন্যই বা তিনি কতটা সোচ্চার হোন—সব কিছু নিয়েই আজ মানুষের জিজ্ঞাসা কৌতূহল তুঙ্গে। কারণটা খুবই সহজ—দুয়ারে কড়া নাড়ছে বিজেপি।
আসন্ন পূজার মরশুমে মা দুর্গার সঙ্গে ভক্ত শ্রীরামচন্দ্রও এবার নাকি সমান খাতির যত্ন পুজো ভক্তি পাবেন—শোনা যাচ্ছে এমনই। তারপর কলকাতা সমেত রাজ্যের পুরসভাগুলোর ভোট
এবং পরিশেষে ২০২১ বিধানসভা। কানাঘুষোয় এমনও শোনা যাচ্ছে, বিধানসভা ভোট এগিয়ে
আনাও হতে পারে।
অতএব ঘর গুছনোর সময় আর খুব বেশি বাকি নেই। বিজেপির ১৮ সিটের ক্ষত মুছে জবরদস্ত লড়াইয়ের ব্যবস্থা করতে তাই এখন থেকেই কোমর কষে নামতে হবে—এমন ইঙ্গিত নেতাকর্মী সমর্থক মহলে ইতিমধ্যেই দিয়েছেন মমতা। সেই ইঙ্গিতের সূত্র ধরে কি আরও কোনও নির্দিষ্ট এবং স্পষ্ট বার্তা শহিদ দিবসের মঞ্চ থেকে আজ দেবেন তিনি? উত্তরবঙ্গ এবং উত্তর ২৪ পরগনায় দলের সাম্প্রতিক পারফরম্যান্স এবং খামতি দূর করতে কোনও নতুন নিদান? পে-কমিশন? এনআরসি? কেন্দ্রের বঞ্চনার বিরুদ্ধে তোপ? তৃণমূলের সাধারণ মহল তো বটেই, রাজ্যের আমজনতাও আজ নিশ্চিতভাবেই তাঁদের এমন যাবতীয় জিজ্ঞাসার উত্তর খুঁজতে শহিদ দিবসের ওই মঞ্চের দিকে চেয়ে থাকবেন। এখন দেখার, মমতার বার্তায় দিনের শেষে কার জিজ্ঞাসা কতটা উত্তর পায়, বিশেষ করে বিজেপির অগ্রগতি ঠেকাতে সিপিএম কংগ্রেসের মতো বিরোধীদের সঙ্গে তৃণমূলের রাজনৈতিক সমীকরণে কোনও নূতন পথের আভাস মেলে কি না!