বিদ্যার্থীদের বেশি শ্রম দিয়ে পঠন-পাঠন করা দরকার। কোনও সংস্থায় যুক্ত হলে বিদ্যায় বিস্তৃতি ঘটবে। কর্মপ্রার্থীরা ... বিশদ
মৈহর হল মধ্যপ্রদেশের সাতনা জেলা তহশিলের এক প্রসিদ্ধ দেবীস্থান। একান্ন পীঠের অন্তর্গত পীঠ না হলেও উপপীঠ। এখানে সতীর দেহাংশ নয় কণ্ঠহার পড়েছিল। এই পুণ্যভূমিতেই ত্রিকূট পর্বতের চূড়ায়। সতীমাঈ কি হার। তাই থেকেই মাঈহার, মৈহার ও বর্তমানে মৈহর।
রেলওয়ে স্টেশন থেকে ত্রিকূট পর্বতের এই দেবীস্থানের দূরত্ব পাঁচ কিলোমিটার। স্টেশন ও বাসস্ট্যান্ড থেকে মন্দিরমার্গে যাওয়ার জন্য অটো, টেম্পো, ট্রেকার ও রিকশর অভাব নেই। সারা বছরই এখানে যাত্রীর ভিড় লেগেই থাকে।
এই মহাতীর্থে যাওয়ার জন্য হাওড়ার দিক থেকে উপযুক্ত ট্রেন হল ভায়া এলাহাবাদ মুম্বই মেল। স্টেশনের বাইরে প্রচুর হোটেল ও লজের ব্যবস্থা আছে। আমি অবশ্য হাওড়ার দিক থেকে এখানে আসিনি। এসেছিলাম জব্বলপুর হয়ে। আধারতলি, দেউরি, গোসলপুর, সিহোরা, কাটনি হয়ে মৈহরে।
স্টেশন সংলগ্ন লজে আশ্রয় নিয়ে স্নানাদিকৃত্য সেরে দশ টাকার অটোয় মাতা মন্দির রোডে ত্রিকূট পর্বতের পাদদেশে এলাম। বিস্তীর্ণ এলাকা জুড়ে এখানে যেন মেলার প্রস্তুতি। মোচাকৃতি সুউচ্চ পর্বত। উচ্চতা ৬০০ ফুট। এই পাহাড়ে ওঠার সিঁড়ির সংখ্যা এক হাজার এক। তবে কিনা দুরারোহ চড়াই। তাই রোপওয়েরও ব্যবস্থা আছে। যাতায়াতের ভাড়া সত্তর টাকা।
ত্রিকূট পাহাড়ের পাদদেশে এক রমণীয় উদ্যানে এসে মন মোহিত হয়ে গেল। উদ্যানের মধ্যস্থলে আছে উন্নত দেবীস্তম্ভ। সেখানেই রয়েছে পরপর সাজানো নবদুর্গার মন্দির। কালো পাথরের এইসব মূর্তিগুলো সত্যই অনবদ্য। এই স্থানটি আদিশক্তি স্থান মন্দির নামে পরিচিত। এই নবদুর্গা হলেন— শৈলপুত্রী, ব্রহ্মচারিণী, চন্দ্রঘণ্টা, কুষ্মাণ্ডা, স্কন্দমাতা, কাত্যায়নী, কালরাত্রি, মহাগৌরী ও সিদ্ধিদাত্রী।
নবদুর্গা দর্শনের পর পর্বতারোহণ। তবে প্রথমেই বলে রাখি দুর্বল ও অশক্ত লোকের পক্ষে পাহাড়ে ওঠার চেষ্টা না করাই ভালো। রোপওয়েই তাঁদের জন্য উপযুক্ত।
পর্বতের উচ্চস্থানে রেলিং ঘেরা সরু সিঁড়ি বেয়ে মন্দিরে প্রবেশ করতে হয়। আমিও সেইভাবে দর্শন করলাম। তবে কি না দেবীতীর্থ হলেও দেবী এখানে ত্রিগুণাত্মিকা। তিনি অম্বা বা দুর্গা নন। তিনি মহালক্ষ্মী, মহাকালী ও মহাসরস্বতী রূপে বিরাজমান। সরস্বতী বা সারদা নামে পূজিতা।
শোনা যায়, এই তীর্থভূমির পবিত্র স্থানটি দীর্ঘকাল লোকচক্ষুর অন্তরালে ছিল। মৈহরের রাজা দুর্জন সিং এক রাতে স্থানটি আবিষ্কার করেন। দেবী এক বৃদ্ধার বেশে রাজাকে স্বপ্ন দেন, ‘হে রাজন! আমি আদ্যাশক্তি মা সারদা। আমি কখনও কালী রূপে বিরাজ করে অশুভ শক্তি নাশ করি, কখনও সম্পদের অধিষ্ঠাত্রী মহালক্ষ্মী হই, আবার কখনও বা বিদ্যার অধিষ্ঠাত্রী দেবী সরস্বতী রূপে আমি জ্ঞানদায়িনী হই। এই পর্বতশিখরে আমার অধিষ্ঠান। এখানে আমার কণ্ঠহার পতিত হয়েছে। তাই এই পর্বত আমার প্রিয় স্থান। এই পর্বতে যে গুহা সেই গুহার আশপাশে আমার একটি শিলাময় মূর্তি আছে। ওই মূর্তি যেখানে আছে ঠিক সেখানেই একটি মন্দির ও মন্দিরে আসার জন্য রাস্তা তৈরি করিয়ে দিলে রাজ্যের প্রজারা এখানে এসে আমার পূজা বা আরাধনা করতে পারবে। কেউ ভক্তিভরে আমার শরণ নিলে আমি অবশ্যই তার মনোবাসনা পূর্ণ করব।’
স্বপ্নাদেশ পেয়ে রাজা মন্দির এবং যাতায়াতের পথ তৈরি করিয়ে প্রজাদের কাছে দেবী মহিমা প্রকাশ করলেন। রাজ্য এবং রাজ্যের বাইরে থেকে যাত্রীরা এসে তখন থেকে নিয়মিতভাবে পূজা দিতে লাগলেন মা সারদার।
এখানে মা সারদার প্রাচীন মূর্তির নীচে দেবনাগরী অক্ষরে যে শিলালেখটি আছে তাই থেকে জানা যায় ১৪৯৪ বছর আগে বিক্রম সংবত ৫৫৯ (৪২৪ শকে) চৈত্র মাসের কৃষ্ণপক্ষে চতুর্দশীর দিন মঙ্গলবারে (ইসবী সন ৫০২) তোরমান হুন শাসনকালে নূপুলদেব দ্বারা মা সারদার এই শিলামূর্তির প্রাণ প্রতিষ্ঠা হয়েছিল।
খাজুরাহোর মন্দির প্রতিষ্ঠারও ৫৫০ বছর আগে এখানেও একটি ছোট্ট মন্দির ছিল। পরবর্তীকালে যা সম্পূর্ণভাবে লয়প্রাপ্ত হয়।
দেবীর চরণতলে আর একটি শিলালেখ আছে। যেটি লম্বায় ১৫ ইঞ্চি এবং চওড়ায় ৩ ইঞ্চি। অপর শিলালেখটি লম্বায় ৩৪ ইঞ্চি ও চওড়ায় ৩১ ইঞ্চি। এই শিলালেখটি তৎকালীন সময়ের সুবিখ্যাত দামোদর পণ্ডিতের। তাঁকে বলা হতো সরস্বতীর বরপুত্র। কলির ব্যাসদেব হিসেবেও গণ্য ছিলেন তিনি।
মৈহরে আসার আগে বেশ কয়েকবার বুন্দেলখণ্ডে চারধারির কাছে মাহোবাতে মহাবীর আলহা ও উদলের প্রভাব শুনে এসেছি। আলহার মর্মর মূর্তিও দেখেছি মাহোবাতে। এখানে এসে শুনলাম সেই আলহা মা সারদার এমনই ভক্ত ছিলেন যে একবার একনাগাড়ে ১২ বছর ধরে এই ত্রিকূট পর্বতে বসে তপস্যা করেন।
মৈহরে দেখার মতো অনেক মন্দির আছে। এর মধ্যে রামমন্দির, চণ্ডী মন্দির, গায়ত্রী মন্দির উল্লেখযোগ্য। সাতনা রোডে ‘বড়ীমাঈ কি শক্তি পীঠ’ও দেখার মতো। তবে আমার কাছে যেটির আকর্ষণ সবচেয়ে বেশি তা হল সরস্বতীর বরপুত্র আলাউদ্দিন খান সাহেবের বসতবাড়িটি দেখা। মৈহর শহরে হাঁটাপথের দূরত্বে আলাউদ্দিন, আলি আকবর ও পণ্ডিত রবিশংকরের স্মৃতিধন্য, মা সারদার কৃপাধন্য এই বাড়িও এক তীর্থভূমি। মৈহর পীঠের মা সারদার কৃপা পেলে মানুষ বিশ্বজয়ীও হতে পারে। অথচ আশ্চর্য! অনেক তীর্থযাত্রীই এই স্থানটি সম্বন্ধে তেমন অবহিত নন।
(ক্রমশ)
অলংকরণ : সোমনাথ পাল