মোম জোছনা
সঞ্জয় রায়: ‘হেই, হ্যাট্-হ্যাট্-হ্যাট্, যাঃ যাঃ-যাঃ। উঃ, দ্যাকো দিকিনি উঠোনটা খালি খালি নোংরা করে। অ্যাই, যাঃ-যাঃ-যাঃ।’ কুসুম সক্কালবেলায় হাঁসের দলটাকে উঠোন থেকে তাড়াচ্ছিল। দীননাথ দাওয়ায় বসে কুসুমের ছলকে পড়া যৌবনটাকে জরিপ করছিল। নাঃ, একটা সন্তান হয়ে গেলেও কুসুমের শরীরটা এখনও বেশ আঁটোসাঁটো।
—‘ও মা, ওরম মুক করে আমার দিকে কি এত দেকচো! আমায় যেন তোমার নতুন লাগচে! এই বয়সে কী তোমার ভীমরতি ধরল! তা বলি, বেলা তো অনেক হল, কারখানায় যাবা না?’
‘উঃ, হ্যাঁ হ্যাঁ এই যাবোখন।’ অন্যমনস্ক দীননাথ কুসুমের ঝাঁঝে বাস্তবে ফিরে আসে। সকালের ঝকঝকে রোদে হাঁসের পালটাকে জলে ঠেলে দিয়ে তবেই কুসুমের শান্তি।
দীননাথের কারখানা বলতে ওই একচিলতে ছোট্ট ঘরে মোমবাতি তৈরি করা। দীনুর সঙ্গে আরও দু’জন হাত লাগায়। সিজনে মোমবাতির বেশ চাহিদা। তবে বছরের অধিকাংশ সময়ই বাজারে ভাটা চলে। মেয়ে-বউকে নিয়ে সুখের মুখ না দেখলেও মোটের ওপর সংসার চালিয়ে নেয় দীননাথ।
মোমবাতি তৈরির ছোট্ট ব্যবসাটা বাবা-ই একসময় শুরু করেছিল। দশ ক্লাস পাশ করার পর দীননাথ আর পড়াশোনা করতে চায়নি। বাবা-ই বলেছিল, ‘ওরে দীনু পড়াটা যকন ছেড়েই দিলি, তকন আমার ব্যবসাটাই ধরে নে দিকিনি।’
সেই শুরু, তারপর থেকেই দীননাথ মনোযোগের সঙ্গে ব্যবসাটা করেই চলেছে। রোজগারপাতি বেশি না হলেও খুব একটা মন্দও না। ইদানীং তো মোমবাতির বেশ চাহিদাও বেড়েছে। এখন সিজন ছাড়াও বিক্রিবাটা বেশ ভালো। তবে এই বিক্রিটা হঠাৎ বাড়ল কেন সেটা দশ ক্লাসের বিদ্যা নিয়ে দীননাথ বুঝে উঠতে পারে না। সেদিন কার্তিকের চায়ের দোকানে বসে নবীন খুড়ো বলছিল, ‘ওরে দীনু ব্যবসাটা ধরে রাক্। তোদের বোধহয় সুদিন আসতে চলেচে রে।’ দীননাথ নবীন খুড়োর কথাগুলো ঠিক ধরতে পারেনি। খালি ফ্যাল ফ্যাল করে চেয়েই থেকেছে।
দুই
আজ কারখানায় গিয়ে দীননাথের মেজাজটা বেশ চড়ে গেল। লক্ষ্মীর মা’টা আসেনি। মাল তৈরির দায়িত্ব ভুতো একাই সামলাচ্ছে। ওদিকে শহর থেকে প্রচুর অর্ডার এসেছে। দিন দশেকের মধ্যেই মালগুলো তৈরি করে দিতে হবে। দীনু ভুতোকে হাত চালাতে বলেই লক্ষ্মীদের বাড়ির দিকে পা বাড়াল। বাইরে বেরিয়ে টের পেল সূর্যের তাপ যেন শরীরের সব জলটুকু শুষে নিচ্ছে। পথে দেখা হল আসলামের সঙ্গে। দীনুকে দেখেই একগাল হেসে আসলাম বলল, ‘আসসালাম আলেকুম।’ দীনু প্রত্যুত্তরে নমস্কার জানাল। আসলাম দীননাথের ছেলেবেলার বন্ধু। এক ক্লাসেই বেড়ে ওঠা। এক উঠোনে ছুটোছুটি। তবু বছর কয়েকের মধ্যেই ওদের দু’জনের সম্পর্কটা কেমন যেন শীতল হয়ে গেছে। আগে দেখা হতেই আসলাম দীননাথকে ভাইজান বলে গলায় জড়িয়ে ধরত। আর এখন সৌজন্যমূলক ভাব বিনিময়ে ওরা দু’জনেই যে যার দিকে হাঁটা লাগায়। আজকেও তার কোনও ব্যতিক্রম হল না। আসলে গ্রামের এই আবহাওয়ায় দু’জনের মধ্যেই কেমন যেন একটা সন্দেহের বাতাবরণ তৈরি হয়েছে।
লক্ষ্মীদের বাড়ির কাছে পৌঁছে দীননাথ দু’বার হাঁক পাড়ল।
‘লক্ষ্মীর মা, ও লক্ষ্মীর মা...।’ ডাক শুনেই ঘর থেকে ছুট্টে লক্ষ্মী বেরিয়ে এসে বলল, ‘কাল রাত থেকে মা-এর খুব জ্বর হয়েচে। বিছানা ছেড়ে একদম উঠতে পারচে নাকো।’
দীননাথ ঘরের ভেতরে গিয়ে দেখল স্বামী পরিত্যক্তা লক্ষ্মীর মা বিছানায় শুয়ে শুয়ে ভুল বকছে। লক্ষ্মী মাথায় জলপট্টি দিয়ে দিচ্ছে। দীননাথ লক্ষ্মীকে বলল, ‘এ তো দেখছি ধুম জ্বর। দাঁড়া, আমি এক্ষুনি সুমন কবিরাজকে বলে দিচ্ছি। বাড়ি এসে তোর মা’কে দেখে যাবে। আর হ্যাঁ, এই নে টাকা ক’টা। এই দিয়ে ওষুধগুলো কিনে নিস।’
কারখানায় এত্তগুলো মালের অর্ডার। লক্ষ্মীর মা’টা না আসাতে দীননাথ বেশ ঝামেলায় পড়ে গেল। অগত্যা কাজের তাড়ায় দীননাথকেই হাত লাগাতে হল। তা না হলে বাবুদের অর্ডারগুলো ঠিক সময়ে তুলে দেওয়া যাবে না।
বাড়ি ফিরতে বেশ রাত হল দীননাথের। হাত-মুখ ধুয়ে খেতে বসতে যাবে, অমনি বাইরে শুনতে পেল রতন তাকে ডাকছে।
‘দীনুদা। ও দীনুদা। তাড়াতাড়ি একবারটি এসো দিকিনি। দীননাথ হন্তদন্ত হয়ে যেতেই কানের কাছে মুখটা এনে রতন বলল, ‘সব্বোনাশ হয়েছে দীনুদা। নক্ক্যিটাকে খুঁজে পাওয়া যাচ্চে না।’
‘সে কী রে, ওর মা কাজে আসেনি বলে তো ওদের বাড়ি গেছিলাম। তারপর সুমন কবিরাজকে ডেকে দিয়ে লক্ষ্মীর হাতে কিছু টাকাও গুঁজে দিয়ে এলাম!’
রতন হাঁপাতে-হাঁপাতে বলল, ‘দেকো না সেই বিকেল থেইকে মেয়েটা নিরুদ্দেশ। মা’টাও বেহুঁশ হয়ে জ্বরে পড়ে আচে। পাশের বাড়ির মেনকা দিদি সব্বাইকে ডেকে খবরটা দিল। আমাদের সব্বাইকে একবার ওকে খুঁজতে বেরুতে হবে।’
দীননাথ মানুষটা একটু অন্য ধরনের হলেও সব সময় মানুষের বিপদে-আপদে পাশে দাঁড়ায়। ঘরে গিয়ে বউকে বলতেই কুসুম ঝাঁঝিয়ে উঠল, ‘কেবল কাজ আর কাজ। আমার দিকে মুক তুলে তাকাবারও তো সময় পাও নাকো।’
কুসুমের কথাকে এক ফুৎকারে উড়িয়ে দিয়ে ভাতের থালা ফেলে রেখেই উঠে পড়ল দীননাথ। হন্তদন্ত হয়ে সকলের সঙ্গে বেরিয়ে পড়ল। কুসুম চেঁচিয়ে উঠে বলল, ‘ওমা। এক গাল মুকেও তুললে নাকো!’
গ্রামের পথে বেরিয়ে আদাড়ে-বাদাড়ে জঙ্গলে কোত্থাও মেয়েটার হদিশ পাওয়া গেল না। অবশেষে মাঝরাতে বাড়ি ফিরে এক ঘটি জল খেয়ে যেই না দীননাথ শরীরটা এলিয়ে দিয়েছে, অমনি রতনের গলা শুনতে পেল। বাইরে যেতেই চাপাস্বরে রতন বলল, ‘দীনুদা নদীর ধারে পোড়ো শিবমন্দিরটার কাচে আকন্দ ঝোপে নক্ক্যিকে পেইয়েচে। জ্ঞান ছিল নাকো। গায়ের জামা-কাপড়ও ছেঁড়া। মদন-কার্তিকদারা স্বাস্থ্যকেন্দ্রে নিইয়ে গেচে।’
রতনের কথায় দীননাথের মাথায় আকাশ ভেঙে পড়ল। রতন মুখটাকে আরও কাছে এনে বলল, ‘পুলিস এইচিল, একটা ডাইরি কইরতে বলেচে। সব দেকেশুনে মনে হয় এইটা অত্যাচার কেস।’
তিন
সকালবেলায় সারা গ্রাম ভেঙে পড়ল স্বাস্থ্যকেন্দ্রে। লক্ষ্মীকে শেষ পর্যন্ত বাঁচানো যায়নি। সারাটা গ্রাম ফুঁসছে। দোষীদের ধরতে সব রাজনৈতিক দলগুলোই এ নিয়ে কাজিয়া শুরু করেছে। দীননাথ কারখানা থেকে বেরিয়ে এসে কিছুক্ষণ কার্তিকের চায়ের দোকানে এসে বসল। নবীন খুড়ো বলল, ‘এ কেমন ব্যাপার হল দীনু! বাপের জম্মে তো এমন ঘটনা এ গাঁয়ে দেকিনি!’ উত্তরে দীনু মেজাজটা চড়িয়ে বলল, ‘দেখেননি। এখন দেখুন। আমাদের সমাজ কেমন উন্নত হচ্ছে। আর মা-বোনেরাও কেমন সম্মান পাচ্ছে!’
লক্ষ্মীর মা’টার জন্য দীনুর দুঃখ হয়। স্বামীটা কবেই ছেড়ে চলে গেছে। কারখানায় কাজ করে মেয়েটাকে পড়াচ্ছিল ও। তা সেই লক্ষ্মীটার ওপরও হায়নার দলের চোখ পড়ল! নানান অগোছালো কথা ভাবতে ভাবতে মনে পড়ল নিজের মেয়েটাও বড় হচ্ছে। আশঙ্কায় দীনুর বুকটা কেঁপে উঠল। নবীন খুড়ো গলা খাঁকারি দিয়ে চেঁচিয়ে উঠল, ‘ও দীনু এতশত কী ভাবচো বলো দিকি। তবে কতায় বলে, কারও সব্বোনাশ— কারও পৌষমাস। তোমার কারখানায় আরও মোমবাতির অর্ডার পড়ল বলে।’
দীনু মনে মনে হাসল। এতটা অর্ডারই সে করে উঠতে পারছে না। তার ওপর আবারও মাল তৈরি! নবীন খুঁড়োকে জিজ্ঞেস করল। ‘এত্ত মোমবাতি লাগবে কেনগো খুঁড়ো?’ দীননাথের প্রশ্ন শুনে হেসেই ফেলল খুড়ো।
‘বলি, তুমি কি কাগজপত্তর দেকোনা না কি দীনু!’
নবীন খুড়োর কথাই সত্যি হল। একের পর এক দল এসে দীননাথের কারখানার সব মোমবাতি কিনে নিয়ে গেল। রাতে গ্রামের সব মাথারাই লক্ষ্মীর স্মৃতিতে মিছিল বের করল। দীনু দেখল বহুকালের চেনা গ্রামটা তার চোখের সামনে বদলে গেছে। নিকষ কালো আঁধার ভেদ করে দীনুর তৈরি মোমবাতিগুলি জ্বালিয়ে একের পর এক মিছিল চলেছে। সক্কলের হাতে ধরা এক-একটা মোমবাতি। নরম আলোয় মিছিলের সারি সারি মুখগুলো উদ্ভাসিত। হাতে ধরা পোস্টারে লেখা ‘অপরাধীর শাস্তি চাই’। এত মানুষ নীরবতাও যেন দীননাথের কাছে বাঙ্ময় হয়ে উঠেছে। কার্তিকের চায়ের দোকানে বলা নবীন খুড়োর কথাগুলো দীনু এতদিনে বুঝতে পেরেছে।
সকালে চায়ের দোকানে বসে নবীন খুড়ো বলল, ‘এবার বুজলা দীনু তোমার মোমবাতির চাহিদা কেন দিনে দিনে বাড়বে! একন তো শহর জুড়ে খালি অন্যায়-অবিচার, মৃত্যু। আর তার সঙ্গে পাল্লা দিয়ে বেইরে চলা পোতিবাদ। সক্কলেই নীরবে মোমবাতি মিছিলে অংশ নিচ্চে।’ খুড়োর কথায় দীনু বুঝতে পারল শহরের বাবুরা এত্ত কেন মালের অর্ডার দিচ্ছে। মনে মনে ভাবল যাক ব্যবসাটা হয়তো এবার সুদিনের মুখ দেখবে। রাতে শুয়ে দীনু পুরনো দিনের কথাগুলো ভাবছিল। বাবা কত্ত কষ্ট করে ব্যবসাটা দাঁড় করিয়েছিল। তখন খালি উৎসবের ভরা মরশুমেই মালের চাহিদা। দীপাবলির সময় চাহিদা তুঙ্গে উঠত। তখন বাড়ির সক্কলেই মাল তৈরিতে হাত লাগাত। মাও রান্নাঘর ছেড়ে দীনুর বাপকে সাহায্য করত। ওইটুকুন ব্যবসাতেই দীনুদের সংসারে খুশির রোশনাই খেলে যেত। অবশ্য তখন দীননাথদের সংসারে চাহিদা বলতে কিছুই ছিল না। মা সব কিছু নিয়ে অল্পেতেই খুশি। কিন্তু দীনু আজকাল কুসুমটাকে যেন কিছুতেই খুশি করতে পারে না।
‘কী গো ঘুমুলে নাকি!’
‘নাঃ, ঘুম আর আসছে কই। মেয়েটা বড় হচ্ছে। তারপর গ্রামের এই অবস্থা। নবীন খুড়ো সেদিন বলছিল যে, বাপের জম্মে এমন ঘটনা দেখেনি। জানিস বউ মাঝেমধ্যে আমারও ভয় হয়...।’
দীনুকে থামিয়ে দিয়ে কুসুম বলে ওঠে, ‘এমন ভয় পেলি চলবে ক্যামনে! মেয়ের বাপ হয়েচো। এত্ত ডরালে চলে!’
দীননাথের পুরুষত্বে ঘা লাগে। কথা ঘুরিয়ে বলে, ‘জানিস বউ, ক’দিন হল ব্যবসাটায় যেন জোয়ার লেগেছে। ওই যে, লক্ষ্মীর জন্য সব্বাই কেমন মোমবাতি মিছিল করল দেখলে না! নবীন খুড়ো বলছিল এমনই মিছিলের ঢল আজকাল দেশ জুড়ে। সক্কলে প্রতিবাদের অস্তর হিসাবে আজকাল মোমবাতি মিছিলকেই বেছে নিচ্ছে গো!’
‘ও মা, তাই নাকি। তাহলে তো তোমার পৌষমাস চলচে। বাবা বদ্রীনাথকে পেন্নাম করি। তাই যেন হয় ঠাকুর। আমাদের দিকে একটু মুক তুলে তাকাও।’
মাঝেমধ্যে দীননাথের মনে বেশ অপরাধবোধ কাজ করে। মানুষের মৃত্যুযন্ত্রণার বিনিময়ে ব্যবসা বেড়ে চলাটা দীনুর মনে আঘাত দেয়। মন থেকে সবটুকু মেনে নিতে পারে না।
চার
সেদিন সকালে কার্তিকের দোকানে সবে চায়ের ভাঁড়ে একটা চুমুক দিয়েছে। অমনি কোত্থেকে নবীন খুড়ো এসে দীনুকে ধরল।
‘আরে দীনু শুনেচো, জঙ্গিদের কোপে দেশের কত্ত সেনা মারা পড়েচে!’ দীননাথ বুঝতে পারল নবীন খুড়ো কোন দিকে কথা ঘোরাতে চাইছেন।
‘বলি এবার তো তোমার পোয়াবারো। দেশ জুড়ে মোমবাতি মিছিলের বন্যা বয়ে যাবে। শহর-নগর-গ্রাম প্রান্তর জুড়ে দেকবে খালি মিছিলের সারি। আর তোমার ব্যবসা ফুলে-ফেঁপে এক্কেবারে কলাগাচ!’
দীননাথ চুপ করে খুড়োর কথাগুলো শুনতে থাকে। কুসুমের মুখটা মনে পড়ে যায়। ঝকঝকে রোদের মতো হাসিতে ভরে আছে সারা মুখ। আহ্লাদে গদগদ হয়ে দীনুর কাছ ঘেঁষে বসেছে। মেয়েটাও নতুন জামা-কাপড়ে আনন্দিত। সংসারটা যেন সুখের সাগরে ভাসছে। হঠাৎ নবীন খুঁড়োর কথায় সংবিৎ ফিরে পায় দীনু।
‘কী গো, একেবারে চুপ মেরে গেলে যে’!
‘নাঃ, খুড়ো, এই সাত-সকালে এত এত মানুষের মৃত্যু মনটাকে বেশ ভারী করে তুলেছে। দেখো খুড়ো তুমি শুধু আমার ব্যবসার লাভটাকেই দেখলে, অতগুলো মানুষের মৃত্যুতে ঘরের বউগুলো স্বোয়ামী হারা হয়ে গেল, এটা একবারও ভাবলে না!’
দীনুর কথায় নবীন খুড়ো বিস্ময়ে হতবাক হয়ে থাকে। অস্ফুটে শুধু বলে ওঠে, ‘নিজেরটুকু বোজে না এমন মানুষ আজকাল আর আচে রে দীনু!’
সেই সকাল থেকেই দীনুর মনটা আজ বেশ ভারাক্রান্ত। ব্যবসাটা বাড়ার কথাতেও দীননাথের মনে কোনও হেলদোল নেই। অসময়ে বাড়ি ফিরতে দেখে কুসুম বলল, ‘কী গো শরীল-টরিল ঠিক আচে তো! এত্ত তাড়াতাড়ি চলে এলে?’
‘নাঃ, এমনিই চলে এলাম। তেমন কিছু নয়।’ দীনুর কথায় কুসুম আশ্বস্ত হয়।
—‘নাও দিকি এবার হাত-মুক ধুয়ে একটু বিশ্রাম করো। আমি তোমার খাওয়ার জোগাড় করি গে।’
গরমের ছুটিতে মেয়েটাকে কয়েকদিনের জন্য দীনু মামার বাড়ি দিয়ে এসেছে। কারখানার কাজের চাপে দীনুর কষ্ট হবে, তাই কুসুম আর বাপের বাড়ি যায়নি। জ্যৈষ্ঠের গরমটাও বেশ জাঁকিয়ে পড়েছে। হাতপাখাটা নিয়ে দীনু দাওয়ায় একটু বসল। টালির ফাঁক দিয়ে চাঁদের জোছনা উঠোনটায় যেন সাদা চাদর বিছিয়ে দিয়েছে। খাওয়া-দাওয়ার শেষে কুসুমও দীনুর পাশটিতে এসে বসল। দু’জনেই অনেকক্ষণ চুপ থাকার পর কুসুম বলল, ‘একটা কতা কইব শুনবে!’
‘বলো কী বলবে।’
‘আমি বলছিলাম কী, তোমার ব্যবসা-পত্তর তো একরকম বেশ ভালোই চলতেচে। তা একদিন আমাকে ওইসব বড়নোকেদের মতো অনেক ভালো ভালো খাবার খাওয়াবে?’ কুসুমের কথায় হেসে ফেলে দীনু।
—‘বলি, এ আর এমন কী বড় কথা হল! তা কী খেতে চাও তো বলবে।’
‘ওই যে গো শহরের বাবুরা টেবিলে কত্ত খাবার সাজিয়ে মধ্যিখানে একটা মোমবাতি জ্বেলে, ওই যে কী যেন বলে গো— ক্যান্ডেন নাইট...’
কুসুমের মুখের কথা কেড়ে নিয়ে দীননাথ হোঃ হোঃ করে হেসে ওঠে।
‘ওহঃ, ওটাকে বলে ক্যান্ডেল লাইট ডিনার। ওসব বড়লোকেদের ব্যাপারস্যাপার। তা তুমি এত্তসব জানলে কী করে!’
কুসুম কাঁচুমাচু মুখ করে বলে, ‘জানো, মিতালি বউদি সেদিন একটা কাগজ নিয়ে দেকাচ্চিল। আর বলচিল, দ্যাক্ কুসুম দ্যাক্— তোদের হাতে গড়া মোমবাতিগুলো দিয়ে সব্বাই কেমন সাহেব-মেমদের মতো ক্যান্ডেন নাইট ডিনার করচে।’
—‘ওগুলো বড়লোকেদের ব্যাপার। ওসব কি আর আমাদের মানায় কুসুম!’
এতসব কথার পরেও সেদিন রাতে দীননাথ শহরের রেস্তরাঁ থেকে অনেক ভালো ভালো খাবার নিয়ে বাড়ি ফিরল। মাটন, মোগলাই, বিরিয়ানির গন্ধে কুসুমদের ঘরটা একেবারে ম-ম করছে। দীননাথ হাত-মুখ ধুয়ে টেবিলটায় একটা সাদা চাদর পাতল। বিপরীতে মুখোমুখি রাখল দুটো চেয়ার। একের পর এক খাবারগুলো থরে-থরে টেবিলের উপর সাজিয়ে দিল। টেবিলের মাঝখানে রাখা মোমবাতিটা জ্বালাল। দীনুর একচিলতে অন্ধকার ঘরটায় খাবারের গন্ধ আর মোমবাতির স্মিত আলোটুকু যেন এক মায়াবী পরিবেশ সৃষ্টি করেছে। কুসুম মিতালি বউদিদের বাড়ি গেছিল টিভিতে সিরিয়াল দেখতে। ঘরে ফিরে দীনুর কাণ্ডকারখানা দেখে তো একেবারে হতবাক। দীনু কুসুমের হাত দুটো ধরে হিড়-হিড় করে টেনে নিয়ে একটা চেয়ারে বসিয়ে দিল। উল্টোদিকের চেয়ারে নিজে বসল। মোমবাতির মায়াবী আলোয় এক চিলতে ঘরে যেন ছেঁড়া-ছেঁড়া রোমান্টিকতা জোর করে ঢুকে পড়েছে। স্বপ্নের আবেশে কুসুম যেন কোনও কিছুই বিশ্বাস করতে পারছে না। কাচের গ্লাস আর প্লেটের ঠুকঠাক শব্দে নিঃশব্দ ঘরটা শুধু বাঙ্ময়। মোম জোছনায় অঙ্গ ভিজিয়ে দুটি মানব-মানবী ভেসে যাচ্ছে প্রেমের জোয়ারে।
অলংকরণ : সুব্রত মাজী
30th June, 2019