বিদ্যার্থীদের বেশি শ্রম দিয়ে পঠন-পাঠন করা দরকার। কোনও সংস্থায় যুক্ত হলে বিদ্যায় বিস্তৃতি ঘটবে। কর্মপ্রার্থীরা ... বিশদ
আমার সঙ্গে সামান্য মালপত্তর সহ যে কিটব্যাগটা থাকে সেটি রেলের ক্লোকরুমে রেখে এলাম।
এখানে যে রেলকর্মচারী ছিলেন তিনি বেশ সদালাপী। আমার ব্যাগ জমা নিয়ে বললেন, ‘কাটনিতে কোথায় এসেছিলেন? এখানে কোনও আত্মীয় আছে নাকি?’
আমি তখন আমার কথা বললাম। ‘বহু তীর্থ দর্শন করলেও মৈহরপীঠ বাকি ছিল। তাই মৈহর মাতাকে দর্শন করে ট্রেন ধরার সুবিধার জন্য এখানে এসেছি।’
উনি দু’হাত জোড় করে কপালে ঠেকিয়ে বললেন, ‘আপনি আসেননি। এখানকার মা-ই আপনাকে কৃপা করে টেনে নিয়ে এসেছেন। এই কাটনিতেই সিদ্ধপীঠে বিরাজ করছেন জলপা দেবী। কেউ কেউ জালোয়া বা জলবাও বলেন। ইনি হলেন ত্রিগুণাত্মিকা দেবী। এখন আপনি আর এদিক-সেদিক না করে এখনকার জাগ্রতা মাতাকে দর্শন করে আসুন।’
আমি উল্লসিত হয়ে বললাম, ‘নিশ্চয়ই যাব। এটাই তো আমার কাজ। জলপা দেবীর মন্দির এখান থেকে কতদূর? যাবই বা কীভাবে?’
‘স্টেশনের বাইরে গিয়ে একটা অটো অথবা রিকশ নিন। মাত্র দু’ কিলোমিটার পথ।’
মুহূর্তমাত্র দেরি না করে বাইরে এসে এক কাপ চা খেয়ে সেই দোকান থেকে পথ নির্দেশ নিয়ে হাঁটা শুরু করলাম। দু’ কিমি পথের জন্য কোনও পরিবহনেরই দরকার হয় না আমার।
নতুন এক দেবী তীর্থ দেখার আনন্দে মন আমার দারুণভাবে উন্মুখ হয়ে উঠেছে। ভাগ্যে কাটনিতে এসেছিলাম।
কিছুদূর আসার পর প্রশস্ত রাজপথের উপর একটি মন্দিরকে ঘিরে অনেক জনসমাগম দেখে ভাবলাম এই বোধহয় জলপা মাতার স্থান। তবে মন্দিরে বিগ্রহ দর্শন করে ভুল ভাঙল। এই মন্দির হল দক্ষিণমুখী বড়ে হনুমানের মন্দির। ইনি হলেন এখানকার রক্ষক। সর্বজনের সংকটমোচনের জন্য ইনি সদা জাগ্রত।
মন্দিরে প্রণাম জানিয়ে আরও খানিক যাওয়ার পর এলাম লক্ষ্মীনারায়ণ মন্দিরে। সেখানে কিছুক্ষণ দাঁড়িয়ে আরতি দর্শন করে আর এক রম্য মন্দিরে এলাম। এটি সাঁই মন্দির। শিরডি সাঁইবাবার শ্বেতপাথরের পূর্ণাবয়ব মূর্তি দর্শন করে মন ভরে গেল। এই মন্দিরেরই বিপরীত দিকের গলিতে নবনির্মিত একটি কালীমন্দির অতিক্রম করলেই জলপা দেবীর স্থান।
একটি তোরণ পার হয়ে প্রথমেই এলাম ভৈরব মন্দিরে। জাগ্রত ভৈরবকে দর্শনের পর জলপা মন্দিরে। হিমালয় ভ্রমণের সময় চম্বাতে রাভী নদীর তীরে জলপা ভবানীর মন্দির ও বিগ্রহ দেখেছিলাম। সেই দেবী হলেন চণ্ডী। কিন্তু এখানকার যিনি অধিষ্ঠাত্রী তিনি কে?
অনেকখানি পাঁচিল ঘেরা জায়গা জুড়ে জলপা দেবীর মন্দির। মন্দির প্রাঙ্গণে ভক্ত দর্শনার্থীদের সংখ্যাও অনেক। তবে বেশিরভাগই মেয়ে। একপাশে বিশাল একটি বটবৃক্ষের নীচে অনেক দেব-দেবীর মূর্তি। সেখানেও জল ঢালা, সিঁদুর লেপা ও পুজো-আচ্চা চলছে। আমি সেখানে মাথা ছুঁইয়ে মূল মন্দিরে এলাম। মন্দিরটি বেশ খোলামেলা। ঘিঞ্জি নয়। সেখানে আছেন পরপর তিন দেবী। মন্দিরের সেবায়েতকে জিজ্ঞেস করলাম, ‘পণ্ডিতজি, এঁদের মধ্যে জলপা মাতা কোনটি?’
সেবায়েত বললেন, ‘মাঝেরটি। এখানে ত্রিগুণাত্মিকা দেবী, মহাকালী, মহালক্ষ্মী ও মহাসরস্বতী। তবে মহাসরস্বতী এখানে মধ্যস্থলে। এই দেবী এখানে পিণ্ডরূপা নন। মূর্তিমতী।’
আমি অনিমেষ নয়নে জলপা দেবীকে দর্শন করে বললাম, ‘এই দেবী কি একান্ন পীঠের অন্তর্গত কোনও দেবী?’
‘না। এটি কোনও পীঠ বা উপপীঠ নয়। এটি হল সিদ্ধপীঠ।’
জলপা দেবী দর্শনের পর মন্দির প্রাঙ্গণে প্রাচীরের গায়ে বহু দেবদেবীর মূর্তি খোদাই করা আছে দেখলাম। পুণ্যার্থী ভক্ত মহিলারা এঁদের সবাইকে ক্লান্তিবিহীনভাবে পুষ্পচন্দন, আলোচালসহ জলসিঞ্চন করছেন দেখলাম। এই দেবীরা কেউ ভয়ঙ্করী, কেউ সৌমাতিসৌম্য, কেউ বরাহমুখী, কেউ অশ্বমুখী, কেউ বা সারমেয়মুখী। ধন্দে পড়লাম। এঁরা কোন দেবী? অনুসন্ধানে জানলাম এই সব মূর্তি হল চৌষট্টি যোগিনীর। এঁরা মন্দির বেষ্টন করে জলপা দেবীকে রক্ষা করছেন।
এখানকারই একজন সেবায়েতের মুখে শুনলাম এই কাটনি শহর বা সিদ্ধপীঠ একসময় ছিল ভয়ঙ্কর মহারণ্যে ভরা ও শ্বাপদ সংকুলে পরিণত। কিছু ভীল ও শবর শ্রেণীর মানুষের বসবাস ছিল এখানে। এমনকী কোনও জলাশয়েরও চিহ্ন ছিল না। রামায়ণের যুগে ব্রহ্মর্ষি জাবালি এই মহারণ্যে কঠোর তপস্যা করেন। তাঁরই তপোপ্রভাবে এই স্থান সিদ্ধপীঠে রূপান্তরিত হয়।
রামায়ণ পরবর্তী যুগেরও অনেক পরে এই মহারণ্যে হঠাৎ আবির্ভাব হয় এক দিব্যজ্যোতিসম্পন্ন যোগীর। বর্তমান মন্দির প্রাঙ্গণে যে গাছটি আছে (প্রাচীন গাছটি নেই) সেখানে বসে তিনি কঠোর সাধনা শুরু করেন। এমনই সাধনা যে তিনি ছিলেন ক্ষুধা তৃষ্ণা রহিত। বনবাসী ভীলরা তাঁর সামনে কোনও ফল মূলাদি রেখে গেলেও তিনি তা গ্রহণ করতেন না।
এমন যখন অবস্থা তখন একরাতে এক অতীব সুন্দরী রমণী নানাবিধ অন্নব্যঞ্জন ও পরমান্ন এনে তাঁর তপোভঙ্গ করালেন। তারপর যোগীর মনোরঞ্জনের জন্য নানারকম ছলাকলায় নৃত্যগীতাদির দ্বারা তাঁর চিত্তবৈকল্য আনার চেষ্টা করলেন। এমনকী এও বললেন, ‘হে যোগীবর! শরীরের ধর্ম পালন না করে শরীরকে কষ্ট দিয়ে সিদ্ধিলাভ করা যায় না। অতএব তুমি প্রসাদ গ্রহণ করো।’ যোগীবর প্রসাদ গ্রহণ করলেন কিন্তু ছলাকলায় মজলেন না।
এইভাবে চৌষট্টি রমণীর ছলনায় চৌষট্টি রজনী অতিক্রান্ত হলে তাঁরা সবাই দিব্য শরীরে দেখা দিয়ে সাধককে বললেন, ‘আর তোমাকে সাধনা করতে হবে না যোগীবর। তুমি সিদ্ধিলাভ করেছ।’
যোগীবর বললেন, ‘আপনাদের পরিচয়?’
‘আমরা এখানকার দেবীর সহচরী। দেবী ত্রিগুণাত্মিকা। মহাকালী, মহাসরস্বতী ও মহালক্ষ্মী। ত্রিশক্তির ধারিকা হয়েও তিনি একাঙ্গী। এই বনভূমে এক রমণীয় সরোবরে দেবীর অধিষ্ঠান। দেবী কখনও উগ্রচণ্ডী, কখনও অশুভনাশিনী, জ্ঞানদায়িনী। আমরা এই চৌষট্টি যোগিনী সব সময় দেবীকে পাহারা দিই। রক্ষা করি। দেবীর প্রকাশ ব্রহ্ম হতে। দেবীর সহচরী আমরা। আসুন আপনি আমাদের সঙ্গে। আমরা দেবীকে দর্শন করিয়ে আনি।’
চৌষট্টি যোগিনীর সঙ্গে সরোবরের তীরে আসতেই শ্বেতশুভ্রা হংসবাহনা দেবীর দর্শন পেলেন সাধক।
দেবীর মহিমা প্রকট হল। জল থেকে উৎপত্তি বলে দেবীর নাম হল জালোয়া, জলবা বা জলপা। সাধকের কৃপায় এই স্থান সিদ্ধপীঠে পরিণত হল।