শাল-পিয়ালের চুপকথা
সুপর্ণা সেনগুপ্ত: পুরুলিয়ার প্রত্যন্ত অঞ্চল বাগমুণ্ডি। আকাশ যেখানে গল্প করে মেঘের সঙ্গে। ঘন জঙ্গল, পাহাড় আর ঝর্ণা ঘেরা ছোট ছোট গ্রাম, আঁকা থাকে নীল আকাশের ক্যানভাসে। বর্ষায় সেখানে নদীর জল ছাপিয়ে যায়। বাঁধের জল উপচে পড়ে ঝর্ণার জলতরঙ্গে, সবুজ আর সবুজে ঢেকে যায় দিগন্ত। আবার ফাগুনে যেন আগুন লাগে সে রংমহলে।
এরই মাঝে ছোট ছোট গ্রাম, নিকানো উঠোন, পাথুরে মূর্তির মতো কালো কালো মানুষগুলোর দুঃখ-কষ্ট-হাসি-কান্না ফানুস হয়ে হয়তো বা উড়ে যায় পূর্ণিমার জোছনায়। কেন্দুপাতার বিড়ি আর শালপাতার থালা চুপকথা বলে দিনান্তে, মাটির উনানে।
বুমকা এমনি এক গাঁয়ের এক দামাল যৌবন। লোকে তাকে বুকা নামেই চেনে বেশি। পাহাড়ের কোলে জঙ্গল ঘেরা মুরগুডা ড্যাম। আর ওই ড্যামের গা বেয়ে বয়ে চলা ছোট্ট খালটাকে ঘিরে ওদের গাঁ। আগে এদিকে তেমন লোক ছিল না। চারদিকে বুনো জঙ্গল আর পাহাড়। জোছনা রাতে যখন চাঁদ উঠত ওই পাহাড়ের পেছন দিয়ে, মহুল বনের গন্ধে আর পলাশের কাঁচা রঙে জানান দিত রঙের দিন আসছে, তখন বুমকার মন যেন হু হু করে নাচন ধরত। অনেক রাত অবধি ড্যামের ধারে বসে বসে বাঁশি বাজাত সে। ওর নিকষ কালো দেহটা তখন জোছনার আলোয় যেন খুদে আঁকা কালো পাথরের কেষ্টঠাকুর। সে অনেক কাল আগের কথা, মনে পইড়ল্যে, আজও বুকুর পেরানটা ধুকপুকাইয়া ওঠে। দু’দিন দু’রাত মায়ের ধুম জ্বর। গা যেন পোড়া কয়লার মতো গরম। মাঝে মাঝে উইঠ্যা বসে, আর কী আলফাল বকে। সেবার শীতটাও পড়েছিল জইব্বর। ভাঙা উঠোনে জ্বালানো কাঠের আগুন তখন নিবু নিবু। ঘুমের ঘোরে মাকে জড়ায়ে ধরে ছোট্ট বুকা। উফ্ কী ঠান্ডা সে গা, যেন শক্ত লোহা। বোনটা ঘুমায় কোলের উপর। বাপটা মহুয়ার নেশায় সারারাত পড়েছিল ভাঙা ঘরের দাওয়ায়। ভোরবেলা কে যেন তারে ঠেইল্যা তোলে। আর পাঁচ ঘরের বিটিছিলারা তার মাকে ঘিরে কেমন যেন সুর করি কাঁদে। কী জানি ক্যানে। ওসব এত আজও আর তার মনে লয়। শুধু মইন্যে পড়ে, মায়ের দেহড্যা যতক্ষণে পুড়ল ততক্ষণ বসেছিল ওরা। তারপর তার হাতটি ধইর্যা বাপ বলে— ‘চল বুকা, উঠ, আর এখানে মন লয় রে। তারপর ওন্দা গ্রাম ছেড়ে শালবনির জঙ্গল পেরিয়ে এ পাহাড়, ও পাহাড়, এ গাঁ, ও গাঁ— ঘুরে ঘুরে কেটেছে কতদিন।
অবশেষে এখানে। এ গেরামের মোড়ল ডেবরু। তার শ্বশুরভিটার গাঁয়ে তখন দিনকতক ছিল বুকারা। ওদের দুঃখ দেখে ডেবরু বুড়ার মন কান্দে। সঙ্গে করে আনে এই গেরামে। সেই থেকে হিথায়। এখন বুকা মরদ। সব্বাই তারে সমঝে চলে। বাপের গলাখানা ছিল এককালে ভারী সুরেলা। জন্মসূত্রে সে সুর যেন বুকার বুকে বিঁধে গেছে। মিশে গেছে রক্তে। বিয়া আর করে নাই বাপটা। মন টেকে লয় কোথাও। মুখে মুখে গান বাঁধত। বুকার বাপ তার বাপ... এ তাদের জন্মসূত্রে পাওয়া। যখন শালগাছের জঙ্গল সাদাফুলে মাতাল হতো, চাঁদের আলো ছুঁয়ে যেত সুবর্ণরেখার জল, সোনার কণা সে জলে চিকমিকাইত, তখন বুকার বাপের গলায় সুর উঠত। সারা গেরাম জড়ো হতো রাতের আঁধারে। মেয়েরা কোমর হলায়ে দুলায়ে নাচত, ঝুমুর বাজত। মাদলের তালে মাতাল হতো মন।
আকাশের চাঁদকে ছুঁতে চাইত পলাশ ঝরা মাটি, আগুন ঝরা কৃষ্ণচূড়া। নাচের ঘোরে কত বিটিছিলা বুকার বাপের কোমর ধরি পীরিতের কথা বলত। সে গাঁ ছাইড়্যা আবার তারা চলে যেত নতুন গাঁয়ের পথে।
বুকা কিন্তু তবু লিখাপড়া ছাড়ি লাই। দু-এক বছর করে যেখানে ছিল, ঘর সামলেছে, সামলেছে খ্যাপা বাপডারে, বোনডারে। এইভাবে ফিরি পেরাইমারি ইস্কুলে কেলাস ফাইভ পাশ দিছে সে।
এ নতুন গাঁয়ে যখন আসল ওরা, তখন সবে পলাশ ফুলে রং ধরেছে। বুকার গানে মুগ্ধ হয়ে তাদের এ গেরামে এনেছে গেরাম প্রধান। বাপডা বুড়ো হইছে। আজকাল আর দম রাখতে পারে না। হাঁফ ধরে। তাতে কী? বুকা ইস্কুলে পড়াশোনা জানা। বাপের মুখে শোনা সব গান সে লিখে রেখেছে একটা খাতায়। এ খাতা তার প্রাণ। নতুন গান শুনলেই পরানডা ঝিক্মিকাইয়া উঠে। সুরগুলান মনের ভেতর হাঁচড় পাচড় করে। এ খাতা দিয়েছিল তার পেরাইমারি ইস্কুলের স্যার। বলেছিল, ‘বুকা গানগুলা লিখি রাখ বাপ্— এ তোদের বাপ ঠাকুরদার গান। এ হবে ইতিহাস। কত বাবুরা এসব দু’কলি গানের জন্য ঘুইর্যা মরে জানিস লাই।’ বুকার চোখে জল আসি যায়। সে গান ব্যেচবেক লাই। এ গান তার পরানের। তার মায়ের মরণ, তার চাঁদনি রাতের একলা হুহু মন, তার মরদ হয়ে ওঠা মনের চুপকথা। সব, সব এ গান। শহরের বাবুরা কে বুঝব্যে এ মনের যন্ত্রণা, এ বনপলাশির মায়া।
আজকাল এ দিকের বেশ উন্নতি হয়েছে। আগের মতন আর লাই। পাথুরে পাহাড় কেটে কেটে রাস্তা এসেছে এঁকেবেঁকে গেরামের মাঝে। মোরেম বিছানো লাল মাটির রাস্তা। বাকুও আজ আর ছোট নয়। সে এখন জোয়ান মরদ। তার পেশীতে ঢেউ খেলানো তুফান। কোমরে গামছা বেঁধে যখন সে নামে ঝিলের জলে, সাঁতরে করে এপার উপার, তখন মনে হয় যেন স্বয়ং খোদ কাটা কেষ্টঠাকুর জল ছিটায়ে লীলা করে ঝিলের বাঁকে। চাঁদনি রাতে ভাঙা দাওয়ায় বসে সে যখন গান ধরে, একে একে আসে বুগা, লঙ্গা, মহুল— ঘিরে ঘিরে মাদল বাজায় উঠান জুড়ে। লাচ হয়। যেন পরব লাগে বন জুড়ে।
শুকনো গাছের ডালপালা, জ্বালানির কাঠ কেটে আনে ওরা দলবেঁধে। কুঠার দিয়ে কাঠ কাটতে কাটতে পেশীতে পেশীতে ছড়ায় যৌবনের শিহরন। বাকুর কোঁকড়ানো চুলের ফাঁক গলে ঝরে পড়ে ঘাম। চওড়া কাঁধে যেন পিছলে পড়ে ভোরের আলো। সে আলো চমক ধরায় বিটিছিলাদের বুকে।
বাকু তবু বেভোলা। কোনও দিকে যেন তার লজর লাই। চোখ বুজলেই সুর যেন তার শরীর বেয়ে খেলা করে। এই গান তার জান-কলিজা। কিছুটা লেখাপড়া জানে সে। গান লেখে নতুন নতুন। সুর বান্ধে। এ নিয়ে তার বড় দেমাক। আপন মনে সে সুর তোলে। সবাই অনেক মন্ত্রণা দেয়। বাকুরে— ‘ইবার ঘর বান্ধ, বিয়া কর্।’ বাকুর মুখে শুধু পরান ভুলানো হাসি— ‘ও হবে-হবে বটেক।’ পঞ্চায়েতের বুড়া বাবা তারে বড্ড ভালোবাসে। সেই কোনকালে হাত ধরে এনেছিল এ গেরামে। বলে— ‘বাকুরে, তুয়ার আর হবেক লাই’, এই সুযোগ। সরকার থেকে টাকা দেয়, ২ টাকা কেজি চাল, পাকা বাড়ি বানা। আর কদিন চলবি বাপ এভাবে?’ বাকু হাসে, তার মনডাও কদিন যেন একটু ছলাৎ ছলাৎ করে ওই বান্ধের পানির মতো। পাশের গাঁয়ের বামনি। কালো মাজা রঙে যেন গহিন গাঙ। চোখের তারায় মাদলের তাল, চলনে বুনো ফুলের বেহিসেবি দোলা। মনডা যেন ক্যামন ক্যামন কইর্যা ওঠে। বারো কেলাস পাশ দেছে মেয়েডা এবারে। এ গাঁয়ে আসে। আশা দিদিদের সঙ্গে সঙ্গে ঘোরে। মাঝে মাঝে পোয়িতে মায়েদের ঔষধ দেয়, কচিগুলারে পড়ায়, টিকা দেয়। পেরাইমারির মাঠে যেদিন পোলিওর টিকা খাওয়ানো হয়, সেদিন তাড়াতাড়ি চলে যায় বাকু। দূর থেকে ওরে দ্যেখতি বড় সাধ হয়। গায়ে পাঁচকান হয় কথাডা। চোরা চোরা চাহুনি, এদিক-ওদিক। বাকু ভাবে বারো কেলাস পাশ মেয়ে ও। আর সে কিনা ফাইভ পাশ সেই কোনকালে। পেরানটা ডরায়। তবু ওরে একটিবার দেখার জন্য হাসপাতালের বাইরের গাছটিতে হেলান দিয়ে দাঁড়ায়। পেরানটা হাঁকপাঁক করে।
হঠাৎ-ই বাকুর মনে হয় একটা পাকা বাড়ি করা দরকার। একটা ছিমছাম নিজের ঘর হবেক। নিকানো উঠোন ঘিরে শাল-মহুলের জংলা, বেড়ার গায়ে বুনো ফুলের রংমহল। সে নিজেই বোঝে কখন জানি তার মনের বুনো ফুলেও লেগেছে একটু একটু কাঠচাঁপার গন্ধ, হাস্নুহানার সুবাস।
অনেক কষ্টে, দিনরাত মেহনত করে, গতর খাটিয়ে আর আবাস যোজনার টাকায় ইটের চার দেওয়াল তুলল বাকু। ইধারে বেবাক গরম। তাই টালির ছাদের তলায় ছিল বিচালির ছাওয়া। বেশ লাগছে এখন। বাইরের লোকেরাও দু’বার দাঁড়ায়। খানিক জিরায় বাড়ির উঠানে।
বাকু এখন জোয়ান বিটাছিলে। রক্তে তার নেশা। পিরিতি তার বুকের খাঁচায়। তবু কেন্যে জানি বামনিরে দেখলেই লাজ লাগে, বুকের ধুকপুকানি বাইড়্যা যায়। কথা আইস্যা না।
বোশেখ মাসে সমস্ত অযোধ্যা পাহাড় জুড়ে চলে শিকারের উৎসব। সমস্ত আদিবাসী মরদরা তির-ধনুক নিয়ে বেরিয়ে পড়ে জঙ্গলে জঙ্গলে। বনবিবির পূজা দিয়ে মানত করে। সে সময় ময়ূরের পালকের মুকুট মাথায় দিয়ে দুলে দুলে গান হয়। চওড়া কাঁধে ধনুক আর হাতে তির নিয়ে দূর থেকে বাকুরে দেখেছে বামনি একদিন। একটা শিহরন জাগে সারা শরীরটা জুড়ে তার। বলতে ইচ্ছা লাগ্যি— ‘তু কেমন মরদ বটেক, তুয়ার মুখে কি কথা লাই, পরানে পিরিত লাই?’
বুকার খাতাও ভরে ওঠে গানে গানে। গলায় জাগে আরও নিত্যনতুন সুর। মন হারায় এধার উধার। তবু পা এগয় না। মেয়েডারে যেন বড্ড মনে লাগছ্যে। ওর চোখের দিকে চাইতে বড় কেমন লাগে তার মতো ডাকাবুকো ছেলেরও।
চৈত্র মাস শেষ হয়ে বৈশাখ পড়ে গেল প্রায়। রোদের তেজ এখনই বেশ গনগনে। জঙ্গল থেকে জ্বালানির কাঠ কেটে সাইকেলে চাপিয়ে ফিরছিল বাকু। পঞ্চায়েতের আপিসের কাছে লাল মাটির রাস্তাটা পাকা হচ্ছে। দাউদাউ করে চুল্লি জ্বলছে, পিচ গলছে। ধোঁয়ায় বাতাস কালো হয়। দম যেন আটকে আসে। বাকু ভাবে শালবনের ভিতর দিয়ে রাস্তাটা ধরি, তাড়াতাড়ি যাওয়া যাবে। সব কাজ পড়ে আছে। না সংসারটা যেন আর টানা যায় না। একা মরদ কি পারে। জঙ্গলের বাঁক ঘুরতেই সাইকেলটা যেন থেমে যায়। পা আর নড়তে চায় না। শালে ঢাকা জঙ্গলি রাস্তার ও ধারে সাইকেলের উপর শ্যামলা, মাজা ও চেহারাটা তো তার কত চেনা। মুখোমুখি থেমে যায় দুটো সাইকেল। শালগাছে ফুল এসেছে। বাস ছড়াচ্ছে খুউব। পলাশের আগুন লেগেছে জঙ্গলে জঙ্গলে। যেন একটা ঘোরের মধ্যেই এগিয়ে যায় বাকু। বামনির মাজা রঙে কমলা-পেড়ে হলদে শাড়ি, যেন গাছ থেকে সদ্য খসে পড়া একটা ঝরা পলাশ। বামনির মুখে যেন হালকা হাসি খেলা করে। সাইকেল থেকে নেমে পড়ে দু’জনে— বাকু বলে, ‘বড় তাপ আজ বটেক্। চল কেনে একটু জিরাই গে, ও গাছের তলে।’
—বামনি অবলীলায় ওর হাতটি ধরে নামে। টিলার ঢালে গাছের তলায় ছায়ায় বসে দু’জনে।
বামনি বলে, ‘এত তাতে জঙ্গলে যাস ক্যেন্যে? রাত পোহালেই যাতি পারিস লাই?’ বাকু হাসে। বামনি বলে, ‘বাপ যাবে কাল বিকালে তুয়াদের বাড়ি।’
—কেনে রে?
—কথা আছে, তুয়ার বাপের সনে।
বাকুর বুকের উপর যেন ঝরে পরে পলাশ, শিমুল। বামনির খোঁপায় গুঁজে দিতে সাধ হয় একা থোকা বনপলাশ।
বামনি খলখল করে হেসে ওঠে। তারপর দৌড় দেয়। সাইকেলে চেপে, মিলায়ে যায়। জঙ্গলির বাঁকে। দূর থেকে শোনা যায় তার কথা, ‘কাল সাঁঝে থাকিস কেন্যে বাড়ি। বাপ যাব্যে বটেক্।’
বাড়ি ফিরে বাকুর আর তর সয় না। দরজায় গায়ে সুন্দর করে আঁকে কলকে, হাতি, ফুল। বেড়ার গায়ের লতানে গাছটা বাইয়ে দেয় ছাদে। বেশ ফুল এসেছে থোকায় থোকায়। সাঁঝের জোছনার আলোয় আজ যেন ভাসে পৃথিবী। মুরগুডার জলে নেমে চাঁদ বুঝি আজ গান শোনায়। বাকুর খাতা একের পর এক ভরে ওঠে নতুন নতুন গানে। সুরগুলা ঘুরপাক খায় গলায়।
অনেক রাত অবধি জেগে জেগে লম্ফ জ্বেলে গানগুলো নাড়াচাড়া করে সে। মোট প্রায় শ’দুয়েক গানের বসত এখন এ খাতা। সেই কোনকালে বাপ-ঠাকুরদার আমলে কত গান, সুর কথা। টুকরা টুকরা ছবিগুলা যেন ভাসে চোখের উপর। এসব জিনিস কি ভুলা যায়!
ঘুম আসে লাই কিছুতেই। এপাশ-ওপাশ করে বাকু। বামনির মুখখানি ভাস্যে ভাস্যে আসে বারবার।। বামনি তো তার কাছে শুধু বিটিছিলা নয়, তার কলজে। তার গান আইসব্যেক লাই, তার সুর আইসব্যেক লাই, ও ছাড়া। যেন খেপাইন্ যায় তার পরান, উয়ার কথা ভাবলেই। কাল উয়ার বাপ আইসব্যেক কেন্যে, কে জানে? তবে কি তার স্বপনগুলা সইত্য হবে বটেক। আরও আরও নতুন গান লিইখব্যেক সে। সে হবে গানের রাজা আর বামনি তার রানি। তারপর যখন ড্যামের জলে চাঁদ লাইচব্যেক, তখন উয়ার কোলে মাথা দিয়ে সে সুর দিবে বাঁশিতে... সে সুর ভাইসব্যে এ পাহাড় থেকে উ পাহাড়ে।
মাঝ রাতের দিকে ঘুমটা জড়ায়ে আসে দু’চোখের পাতায়। বুকের উপর খোলা খাতা যেন তারে ঘুম পাড়ায়। মাথার কাছে নিবু লম্ফ স্বপন দেখায়।
হঠাৎ কেমন একটা তাপে তার দমটা যেন বন্ধ হয়ে আসে। বুকা চোখ চেয়ে দেখে মাথার কাছে দাউ দাউ করে জ্বলছে ডাঁই করা কাপড়। উপরের চালে ছড়িয়ে পড়ছে সে আগুনের ফুলকি। বাইরে কারা যেন চিৎকার করে— ‘আগুন আগুন। বাকু ওঠ বাপ, ওঠ। দাওয়ায় অনেক মানুষের আওয়াজ, ধোঁয়ায় ঢেকে গেছে চারদিক। বাকু দিগ্ভ্রান্তের মতো আগলটা আলগা করতে চায়। হঠাৎ খেয়াল পড়ে, তার খাতার কথা। সবে একটা ফুলকি এসে পড়েছে খাতার পাতায়। বাকু প্রাণপণে ঝাঁপিয়ে পড়ে আগুন নিভাতে থাকে। বুকে চেপে ধরে খাতাটা। তারপর আর টাল রাখতে পারে না।
সদরের হাসপাতালের বিছানায় যখন জ্ঞান আসে, তখন বাকু যেন নিজেকেই চিনতে পারে না নিজে। সাদা ব্যান্ডেজে পেঁচানো ভূতের মতো চেহারায়, কালো চোখ দুটো শুধু ঝলমল করে তারার মতো। আয়নায় নিজের চেহারা দেখে চমকে ওঠে নিজেই। তারপর হঠাৎ চিৎকার করে কী যেন খুঁজতে থাকে সে। ছেঁড়া ঝুলির ভেতরে থেকে হাত ঢুকিয়ে বের করে তার আধপোড়া ছেঁড়া খাতা। তারপর খাতাটা বুকে চেপে হাসতে থাকে— হা হা করে। সেই হাসির দমকে কেঁপে কেঁপে ওঠে তার অত বড় শরীরটা। গ্রামের লোকে দূর থেকে বলে— ‘ছেলেডার মাথাডা এক্কেবারে গ্যেইল বটেক। এ শোক আর সইতে লারে।’
বামনির বাপ মাথা নেড়ে নেড়ে বলে— ‘এ বুকার সাথে আর লয়গো খুড়ো। বেকার বাউন্ডুলে, তার উপর মাথাট্টাই গেছে এক্কেরে। আমার বামনি তো আর সে হেলাফেলার বিটিছিলা লয়। চালচুলা লাই এ ভূতকে সে কখনও বিয়া কইরব্যাক লাই।’
বাকু দেখে যেন দূরে তার পোড়া কালো বাড়িটা দাঁত ভেংচে হাসছে মুখ বেঁকিয়ে। খাতাটা আরও বুকে চেপে ধরে, সে চিৎকার করে ওঠে— না ও ঘর তার লাইগব্যেক লাই। লাইকব্যেক লাই বামনির আদর। এ খাতাখানা ওই গানগুলা তার পেরান, তার আকাশ ভরা তারা, জোছনা রাতে পলাশ ঝরা বন।
এ খাতার প্রতিটি কথা তার গলায় সুর তোলে, বুকে ঝড় ওঠে। সব যায় যাক, তবু গান তো তারে ছাইর্যা যায় নাই। তারে জড়ায় আছে। এ সাদা কথাগুলোন সে বুঝাইত্যে চায় সব্বাইরে— ‘আগুন আমার কিছুটি লিতে লায় রে কিচ্ছুটি লিতে লায়।’ দু’চোখের জল সামলে দু’হাত-বাড়ায়ে হেঁটে যেতে চায় সে সামনে। ছুটে আসে ওয়ার্ডের সিস্টার দিদিমণিরা। জোর করে হাত-পা বেঁধে সবাই মিলে শুইয়ে দেয় তারে। সদর হাসপাতালের মানসিক ডাক্তারবাবুর ঘরে কল যায়। দক্ষ হাতে ইঞ্জেকশন দেয় সিস্টার দিদিমণি। আধো ঘুমে বাকু দেখে বামনি যেন দাঁড়িয়ে তার চুলে বিলি কাটে, হাসিমুখে। দু’জনের গলায় পিরিতির গান বাজে— ‘সুখের লাগিয়া এ ঘর বাঁধিনু অনলে পুড়িয়া গেল’— বামনি খোঁপায় গোঁজা পলাশ, ঠোঁট দুটো যেন নেমে আসে তার কপাল ছুঁয়ে। সুরে সুরে ভরে ওঠে জোছনা ঢাকা মুরগুডা ড্যাম, অযোধ্যা পাহাড় আর শাল-পিয়ালের বন।
অলংকরণ : সুব্রত মাজী
07th July, 2019