বিশেষ নিবন্ধ

নিট দুর্নীতি থেকে কি নেতার ইগো বড়?
হিমাংশু সিংহ

নিট ও নেট দুর্নীতি কোমর ভেঙে দিয়েছে দেশের মেধাবী যুব সমাজের। একমাস কেটে গেলেও সরকার কোনও সুরাহা করতে পারেনি, দায়ও নেয়নি সেভাবে। সংসদে দু’সপ্তাহের অধিবেশনে শুধু সরকার ও বিরোধীদের বাগ্‌যুদ্ধ হয়েছে, আতান্তরে পড়া ছাত্রছাত্রীরা কোনও সুবিচার পায়নি। সবাই অন্ধকারে। অন্যদিকে শত্রুপক্ষের যাবতীয় ছক বানচাল করতে এলওসিতে কাজ করছে দু’জন জওয়ান। একজন পাকাপাকি সেনাকর্মী। অন্যজন মোদিজির সৌজন্যে অগ্নিবীর। প্রাণ হারালে দু’জনই শহিদ, কিন্তু বদলে যাবে ক্ষতিপূরণের অঙ্ক। অগ্নিবীরের পরিবার পেনশন পাবেন না, মিলবে না আজীবন রেশনও। বিমা-করা ক্ষতিপূরণ দিয়েই দায় সারবে সরকার। দেশমাতৃকার রক্ষায় প্রাণ বাজি রাখা দুই জওয়ানের মধ্যে এত ফারাক কেন? রেকর্ড বেকারত্বের দেশে পদে পদে যুবক-যুবতীদের আত্মবিশ্বাসে এভাবে আঘাত হানলে সুস্থ সামাজিক ভারসাম্য রক্ষা করা অসম্ভব। অথচ সেটাই হয়ে চলেছে সরকারের সৌজন্যে!
আগে গ্রামে গ্রামে হতো মুর঩গির লড়াই। দূর দূর থেকে লোক আসত দেখতে। উপচে পড়ত ভিড়। সেখানেও নিমেষে পক্ষ বিপক্ষ, দু’দলে ভাগ হয়ে যেত আদুল গায়ের গরিব সমাজ। তারপর চলত দড়ি টানাটানি, দিনভর উত্তেজনা। প্রত্যন্ত এলাকার কিছু না পাওয়া নাগরিক জীবনে সেটাই ছিল গুরুত্বপূর্ণ বিনোদনের মশলা। ওরা ‘হ্যাভ নটস’। আজ প্রতিনিয়ত ‘হ্যাভস’রা থুড়ি আমিররাও ভাগ হয়ে যাই বিবদমান দুই পক্ষে। যুযুধান শাসক ও বিরোধী পক্ষের ছদ্ম লড়াই চলে। হাজার কোটি টাকা ব্যয়ে তৈরি চোখ ধাঁধানো প্রাসাদের ঘেরাটোপে, যার কেতাবি নাম সংসদ। গণতন্ত্রের মন্দির। বাইরে দাঁড়িয়ে দেশি-বিদেশি লিমুজিনের সারি। দেশের সিংহভাগ সম্পদ এই এক-আধ শতাংশেরই হাতে। তারাই বেমালুম লোকদেখানো লড়াই জুড়ে নিজেদের আসন, নিজেদের ক্ষমতা অক্ষত রাখে। শুধু বঞ্চনা নিয়ে অন্ধকারে গুমরে মরে জনগণ, বিশ্বের বৃহত্তম গণতন্ত্রে স্বাধীনতার ৭৫ বছর পরেও!
দিন বদলেছে বিনোদনের রূপ, ঢং, প্রকৃতিও পাল্টে গিয়েছে বিলকুল। মুরগির লড়াইয়ের স্থান নিয়েছে নেতাদের একে অপরকে তাক করা বিরামহীন বাক্যবাণ। ভোটপর্বে সেই নাটকই মঞ্চস্থ হয় হাটে-বাটে শহরে। দুর্নীতি, গায়ের জোর আর লুটের সমাজে—এ বলছে ও দায়ী, আবার অভিযুক্তও পাল্টা গলা অষ্টমে তুলে চেঁচাচ্ছে, ‘চোরের মায়ের বড় গলা। পঞ্চাশ বছর আগে তোমার বাপ-ঠাকুর্দা কী করেছিল মনে নেই?’ একজন অর্ধশতক আগের জরুরি অবস্থার কথা বলে তো অন্যজন সংবিধান দু’হাতে উপরে তুলে নীতিবাক্য আওড়ায়। কে সত্য বলছে, আর কে মিথ্যা, তা বোঝার উপায় নেই। জনগণকে ধাঁধায় ফেলে ভাবের ঘরে চুরি চলতেই থাকে। সরকার যায় আসে, লড়াই থামে না, কে প্রকৃত দোষী তার মীমাংসাও হয় না কোনও আদালতে, গোয়েন্দা তদন্তে, নির্বাচনের রায়ে। সেই ট্র্যাডিশন চলতেই থাকে সমানে। মধ্যিখানে খানপাঁচেক উচ্চপর্যায়ের কমিটি। লোকদেখানো তদন্ত কমিশন। সিট গঠন। প্রভুর নির্দেশ মেনে ইডি, সিবিআইয়ের মরণপণ দৌড়োদৌড়ি। সরকারি টাকার শ্রাদ্ধ। মহার্ঘ নিউজপ্রিন্টে ছাপা পাতার পর পাতা খবর ছবি গ্রাফিক্স। শেষে পিনপতন নিস্তব্ধতা। অন্তিম পরিণতি ধামাচাপা! সঙ্গে ফ্রিতে পাওয়া দুঃখ, অভিমান, হতাশা, ভুলিয়ে বয়ে যাওয়া বলবান সময়। মাস...বছর...দশক... অর্ধশতক... পেরিয়ে এই একই আলেখ্যর ক্লান্তিকর পুনরাবৃত্তি। আম পাবলিকের হাতে শেষে শুধুই পেন্সিল। সেই বোফর্স থেকে কয়লা বণ্টন কেলেঙ্কারি, টুজি, কফিন দুর্নীতি পেরিয়ে হালের ইলেক্টোরাল বন্ড, নিট, নেট, অগ্নিবীর। তালিকা দীর্ঘ হয় ক্রমাগত। এদেশে যেকোনও আমলের কেলেঙ্কারির এটাই ভবিতব্য। নেতারা জানেন জনগণের স্মৃতি বড়ই দুর্বল। সময় গেলেই পুজোয় চাই নতুন জুতোর মতো, নতুন সরকারের চাই নতুন দুর্নীতি... নতুন এক মহাকাব্য লেখার শুভ মহরত। পুরনো বহুল ব্যবহৃত প্রসঙ্গ তখন আর মনে রাখে কে? দিব্যি সব ভুলে আবার নতুন দুর্নীতির কথা নতুন উৎসাহে শতবর্ষ পরেও। বোফর্সের দালালি কার কাছে পৌঁছেছিল তা প্রমাণ করা যায়নি পঞ্চাশ বছরেও, তদন্তটাকেই মাঝপথে বন্ধ করতে হয়েছে। নির্বাচনী বন্ড দুর্নীতিও ধোঁয়াশায় ভরা। ওস্তাদ অপরাধীরা জানে সিবিআই, ইডির কনভিকশন রেট ১ শতাংশেরও কম। তাই কুছ পরোয়া নেই, চুনোপুঁটিরা ফাঁসলেও মাথা অক্ষতই থাকবে!
ভোটের আগে সপ্তদশ সংসদের শেষে প্রধান ইস্যু ছিল নির্বাচনী বন্ড নিয়ে দুর্নীতি। স্বাধীনতার পর এত বিরাট ও ব্যাপক কেলেঙ্কারি এবং তাকে আইনি রক্ষাকবচ দেওয়া নিয়ে উত্তাল হয়েছিল সংসদ। নির্বাচনী বন্ড থেকে হাজার হাজার কোটি টাকা আয় করেছে শাসক দল বিজেপি। দিল্লির বুকে পেল্লায় সাততারা পার্টি অফিস। রাজ্যে রাজ্যে নেতা কেনাবেচা। যখন যেখানে প্রয়োজন প্রতিপক্ষ দল ভাঙা। সবশেষে গত লোকসভা ভোটের আগে আড়াই মাসের তাক লাগানো প্রচার। হাওয়াই জাহাজের বিস্তর ছোটাছুটি। শুধু বাংলাতেই প্রায় দু’ডজন সভা প্রধানমন্ত্রীর। এক-একটিতে খরচ কোটি ছুঁই ছুঁই। সবই ইলেক্টোরাল বন্ডের দৌলতে। কিন্তু একবারও যাওয়ার সময় হল না জ্বলন্ত মণিপুরে। জাতিদাঙ্গায় কুকি, মেইতেইরা রক্তাক্ত। পরিস্থিতি অগ্নিগর্ভ। মোদিজি সর্বত্র যেতে পারলেন, ব্রাত্য রইল শুধু মণিপুর। উত্তর-পূর্বের ওই রাজ্যটা কি স্বাধীন দেশের অংশ নয়? 
৪ জুন ফল বেরল। একসঙ্গে নির্বাচন ও নিটের। ভোটে চারশো দূরঅস্ত, ৬৩ আসন কমে ২৪০-এ এসে দাঁড়াল বিজেপি। উত্তরপ্রদেশের মাটিতে ভরাডুবি হল গেরুয়া স্বপ্নের। দলিতরা মোদির চাপিয়ে দেওয়া পাঁচশো বছর পর রামকে ঘর দেওয়ার স্পর্ধা ও আস্ফালনকে আঘাত করল সজোরে। কিন্তু সেই রাতেই অন্য যে ঝড় শত শত প্রতিভাবান তরুণ-তরুণীর ভবিষ্যৎকে ধাক্কা দিয়েছিল, তার খোঁজ আমরা ক’জন নিয়েছি। যাঁরা আগামী দিনে দেশের নাগরিকদের চিকিৎসা করবেন, প্রাণ ফিরিয়ে দেবেন, হাতের নাড়ি সচল রাখার মন্ত্র শিখবেন, তাঁদের নিয়ে সরকার ছিনিমিনি খেলল! প্রশ্নপত্র ফাঁসের অভিযোগ তো আছেই, সঙ্গে জুড়েছে ১,৫৬৩ জনকে দেওয়া রহস্যজনক গ্রেস মার্ক। এত বড় দুর্নীতি সরকারের যোগসাজশ ছাড়া সম্ভব? কীসের ভিত্তিতে ওই ছাত্রছাত্রীরা গ্রেস পেয়েছিল, তা আজও জানাতে পারেনি ন্যাশনাল টেস্টিং এজেন্সি। সবচেয়ে আশ্চর্যের ব্যাপার গ্রেস পাওয়ারা সবাই রিটেস্টেও অংশ নেয়নি। গত দু’সপ্তাহে প্রত্যাশিতভাবেই সংসদে উঠল স্বাধীন ভারতের অন্যতম পরীক্ষা দুর্নীতির কথা। কিন্তু দায়সারা সাফাই ছাড়া সরকার আর কী করেছে। এতকিছুর পর দায় মাথায় নিয়ে কেন্দ্রীয় শিক্ষামন্ত্রীর ইস্তফা দেওয়া কি উচিত ছিল না?
যদি বলি, গত দু’সপ্তাহের সংসদীয় অধিবেশনে দেশ কী পেল? হাজার হাজার কোটি টাকা ব্যয়ে পৃথিবীর অন্যতম বৃহৎ গণতন্ত্রের সবচেয়ে খরচ সাপেক্ষ নির্বাচন। ১ লক্ষ ৩৫ হাজার কোটি টাকা শুধু ভোটের ব্যয়। আর প্রচার? সব মিলিয়ে দু’লক্ষ কোটি টাকার ধাক্কা। তারপর অষ্টাদশ সংসদের প্রথম অধিবেশন। নিঃসন্দেহে প্রত্যাশা বিরাট। নিট দুর্নীতিতে বিপন্ন ভবিষ্যতের তরুণ ডাক্তার সমাজ, নেটের পরীক্ষা বাতিল হওয়ায় পরবর্তী প্রজন্মের কলেজ শিক্ষকরা কেউই  ঘণ্টার পর ঘণ্টা বিতর্ক, রাষ্ট্রপতির ভাষণ এবং সবশেষে বিরোধী দলনেতা ও প্রধানমন্ত্রীর সওয়াল-জবাবে আশ্বস্ত হলেন কী? বোধ হয় না। আর এটাই আজকের ভারতীয় গণতন্ত্রের সীমাবদ্ধতা, ব্যর্থতাও বলতে পারেন। অনেক কথা বলা হয়। বিরোধী ও সরকার পক্ষ দু’পক্ষই একে অপরের দিকে তীক্ষ্ণ থেকে তীক্ষ্ণতর আক্রমণ শানিয়ে আত্মতৃপ্তি পান, কিন্তু জনগণ সেই তিমিরেই। বিরোধীরা বলছে, সরকার ঝুট বলছে। আবার সরকার পাল্টা তোপ দেগে যাচ্ছে, কংগ্রেস অসত্য বলছে। সত্য অসত্যের এই টানাপোড়েনে আমরা মায় দিন আনা দিন খাওয়াদের কী যায় আসে? নিত্যদিন বেকারত্বের নয়া রেকর্ড। পেট্রল, ডিজেলের দাম কমার কোনও লক্ষণ নেই। খাদ্যদ্রব্যের মূল্যবৃদ্ধি নিয়ে খোদ রিজার্ভ ব্যাঙ্কও উদ্বিগ্ন। নেতানেত্রীদের তাতে কিছু যায় আসে না, ভাষণে মগ্ন থাকতে পারলেই তাদের দুনিয়া রঙিন।
দীর্ঘ দশবছর মোদি রাজত্বে প্রায় প্রতিটা অধিবেশনই ছিল একপেশে। চোখের পলক পড়ার  আগেই পাশ হয়ে গিয়েছে বিল। আইন প্রণয়ন এমনকী বিরোধী নেতানেত্রীদের বক্তব্য রাখার সময় প্রধানমন্ত্রী নিজের অহংকে চরিতার্থ করতে বহু ক্ষেত্রেই কক্ষে হাজির পর্যন্ত হননি। সংসদ ভবনে নিজের অফিসে বসেই নজর রেখেছেন। তখন লোকসভায় তাঁর শুধু একক গরিষ্ঠতাই ছিল না, ৩০৩ আসন জেতার মধ্যে কাউকে পাত্তা না দেওয়ার একটা আশ্চর্য গরম ছিল। এবার ৬৩টি আসন কমে তা হয়েছে ২৪০। তাতেই সরকার টলমলে, শীতল। নতুন নতুন ক্রাচের খোঁজে মরিয়া শাসক। চেঁচামেচি, বাদানুবাদ, টানাপোড়েনও চরমে পৌঁছেছে। ২৮০ জন নতুন এমপি এসেছেন ঠিকই, কিন্তু নারী সংরক্ষণ বিল পাশ করালেও শাসক দল নিজেও এক তৃতীয়াংশ মহিলা প্রার্থী দাঁড় করায়নি। অষ্টাদশ সংসদীয় অধিবেশনে মোট নির্বাচিত মহিলা এমপির সংখ্যা ৭৮ থেকে কমে ৭৪ হয়ে গিয়েছে। শতাংশের হিসেব ছেড়ে দিন, শাসক দলের কোনও মুসলিম এমপিই নেই। এতেই বোঝা যায়, রাজনীতির কারবারিদের ভড়ংটাই ষোলোআনা, বাস্তবে কেউ কথা রাখে না।
মোদিজি বলেছেন, পারফরম‌্যান্সই আসল, প্রোপাগান্ডা নয়। খুব ভালো কথা। কিন্তু গত দশ বছরের শাসনকালে বহু সময় কাজ, দক্ষতা ও তার ব্যাপ্তিকে অতিক্রম করে প্রোপাগান্ডাই মুখ্য ভূমিকা নিল কোন জাদুতে? ফ্লপ নোট বাতিল থেকে মঙ্গলসূত্র হারানোর ভয় দেখানো, জুমলা আর প্রোপাগান্ডারই প্রদর্শনী চলেছে এক দশক। এই টানাপোড়েনে সংবিধান নিছকই একটা আড়াল মাত্র। তাকে মানলে দেশ ও জাতির বিবেক। আর না মানলে সামান্য কিতাব। সরকার থেকে বিরোধী কেউই ব্যক্তিগত ইগোর ঊর্ধ্বে উঠে তাকে কি যোগ্য সম্মান দিয়েছে? সংবিধানই সম্মান না পেলে বেকার যুবকের চাকরি, সরকারি পরীক্ষার পবিত্রতা, অগ্নিবীরের আত্মত্যাগ ও মণিপুরবাসীর কান্না মুছবে কে?
3Months ago
কলকাতা
রাজ্য
দেশ
বিদেশ
খেলা
বিনোদন
ব্ল্যাকবোর্ড
শরীর ও স্বাস্থ্য
সিনেমা
প্রচ্ছদ নিবন্ধ
আজকের দিনে
রাশিফল ও প্রতিকার
ভাস্কর বন্দ্যোপাধ্যায়
mesh

মৃৎশিল্পী, ব্যবসায়ী প্রমুখদের বিশেষ কর্মোন্নতি যোগ প্রবল। পেশাদারি কর্মে শুভ ফল প্রাপ্তি। মানসিক চাঞ্চল্য।...

বিশদ...

এখনকার দর
ক্রয়মূল্যবিক্রয়মূল্য
ডলার৮৩.১৩ টাকা৮৪.৮৭ টাকা
পাউন্ড১০৮.৫০ টাকা১১২.০৬ টাকা
ইউরো৯১.০৪ টাকা৯৪.২২ টাকা
[ স্টেট ব্যাঙ্ক অব ইন্ডিয়া থেকে পাওয়া দর ]
*১০ লক্ষ টাকা কম লেনদেনের ক্ষেত্রে
দিন পঞ্জিকা