বিশেষ নিবন্ধ

গণপিটুনি: আইনটা যদি পাঁচ বছর আগে হতো!
তন্ময় মল্লিক

‘দিনটা ছিল ২৫ ডিসেম্বর। আমি তখন আঠারো। বন্ধুদের সঙ্গে পিকনিক করে সবে বাড়ি ফিরেছি। সিপিএমের কয়েকজন লোক আমার বাবাকে বাড়ি থেকে জোর করে তুলে নিয়ে গেল। কারণ আমার বাবা তৃণমূল কংগ্রেস করত। আমি আর মা তখন বাবার পিছন পিছন ছুটলাম। কর্ণপুর সিপিএম অফিসে নিয়ে যাচ্ছিল। তার আগেই মাঠে ফেলে বাবাকে প্রচণ্ড মারল। বাঁচাতে যাওয়ায় আমাকে আর মাকে ধাক্কা দিয়ে সরিয়ে দিয়ে পার্টি অফিসে নিয়ে চলে গেল। তার আগেই আমাদের গ্রামের মাজেদুল মল্লিক, জালিম শাহ আর 
ইউসুব আলিকে তুলে নিয়ে গিয়েছিল। তারপর সবাইকে করঞ্জগেড়ে নিয়ে গিয়ে গাছে বেঁধে চলল গণপিটুনি। মৃত্যু নিশ্চিত করতে কেটে দিয়েছিল গলার নলি। একমাত্র ইউসুব আলি বাদে সকলেই মারা গেল।’ কথাগুলো বলতে বলতে লালমোহন মল্লিকের গলা বুজে এল। 
লালমোহন গণপ্রহারে মৃত হাসেন মল্লিকের ছেলে। লালমোহন বলেন, পিটিয়ে মারার দায় এড়াতে গল্প ফেঁদেছিল সিপিএম। ওরা প্রচার করেছিল, স্থানীয় এক ব্যবসায়ীর টাকা ছিনতাইয়ের জন্যই গণরোষে তিনজনের মৃত্যু হয়েছে। আমাদের কাছ থেকে কোনও অভিযোগ নেয়নি। পুলিস সুয়োমোটো কেস করেছিল। তাতে ১১জনকে অভিযুক্ত করেছিল। প্রত্যেকেই তৃণমূলের সক্রিয় কর্মী। রাজ্যে পালা বদলের পর কেস রি-ওপেন হয়। তাতে সিপিএমের যারা এই ঘটনা ঘটিয়েছিল তাদের অভিযুক্ত করা হয়েছিল। কেউ কেউ গ্রেপ্তার হলেও সাজা এখনও হয়নি।
গোঘাটে যখন তিনজনকে পিটিয়ে মারা হয়েছিল তখন বাংলায় সিপিএম ছিল অপরাজেয়, অপ্রতিরোধ্য। সে-বছরই বাংলায় গঠিত হয়েছে সপ্তম বামফ্রন্ট সরকার। সেই সময় বিরোধীদের অস্তিত্ব খুঁজে পাওয়াই ছিল কঠিন। তবে, তারমধ্যেও গ্রামবাংলায় যাঁরা সিপিএমের বিরোধিতা করতেন, তাঁদের দিতে হতো চরম মূল্য। কাউকে হতে হতো ঘরছাড়া, কেউ মূল্য চোকাত জীবন দিয়ে। তবে, উন্নততর বামফ্রন্ট গড়ার প্রতিশ্রুতি দিয়ে সপ্তমবার ক্ষমতায় বসা সিপিএম বদলে ফেলেছিল বিরোধীদের দমিয়ে রাখার কৌশলও। কোথাও পারিবারিক বিবাদ উস্কে দিত, আবার কোথাও ‘চোর’ অপবাদ দিয়ে পিটিয়ে মারত। তাতে বিরোধীদের ‘শিক্ষা’ দেওয়া হতো, আবার খুনের দায়ও ঘাড়ে চাপত না। আর তখন অধিকাংশ গণপ্রহারে মৃত্যুর ঘটনায় অভিযুক্ত হতো ‘আননোন’। ফলে প্রায় কেউই গ্রেপ্তার হতো না। 
সাম্প্রতিক বাংলায় গণপিটুনির ঘটনা উস্কে দিয়েছে ২০০৬ সালের ২৫ ডিসেম্বর হুগলির গোঘাটের সেই নারকীয় গণহত্যার স্মৃতি। সেদিন যাঁদের পিটিয়ে মারার জন্য নিয়ে যাওয়া হয়েছিল, তাঁদের মধ্যে এখনও বেঁচে আছেন ইউসুব আলি খান। প্রায় দু’দশক আগের ঘটনা, তবুও তাঁর স্মৃতিতে ঩সেই ক্ষত এখনও দগদগে। ইউসুব বললেন, ওরা মেরে আমার হাত, পা ভেঙে দিয়েছিল। মরে গিয়েছি ভেবে ফেলে দিয়েছিল মাঠে। সাড়ে তিন মাস পিজিতে ভর্তি ছিলাম। আমার সব শেষ হয়ে গিয়েছে। এখন তো গণপিটুনিতে কেউ মারা গেলে মমতাদি টাকা দিচ্ছেন, চাকরি দিচ্ছেন। আর সিপিএম আমলে? ওরা প্রাণে মারার পাশাপাশি দোষ ঢাকতে দিত বদনাম। গোটা পরিবারটা সমাজের চোখে ছোট হয়ে যেত। তাতে জানে মরত মানুষটা, আর মানে মরত গোটা পরিবার। 
কারণ যাই হোক না কেন, গণপিটুনিতে মৃত্যু সভ্য সমাজের লজ্জা। এটা কিছু মানুষের বিকৃত মানসিকতার করুণ পরিণতি। অনেকেই এই ঘটনাকে পুলিস প্রশাসনের উপর মানুষের অনাস্থা হিসেবে দেখানোর চেষ্টা করছেন। কোনও কোনও বিশেষজ্ঞ আবার নেতা, মন্ত্রীদের উপর রাগ থেকেই এমনটা ঘটছে বলে দাবি করছেন। তাঁদের বক্তব্য, নেতা, মন্ত্রীদের কিছু করতে পারছে না। তাই সুযোগ পেলেই পিটিয়ে মেরে গায়ের জ্বালা মেটাচ্ছে। এসব যে কেবলই রাজনীতির কথা, তা বলাই বাহুল্য। তবে, একের পর এক গণপিটুনির ঘটনার দায় পুলিস অস্বীকার করতে পারে না। পুলিসের গোয়েন্দা বিভাগ সজাগ থাকলে ঘটনাগুলি মৃত্যু পর্যন্ত গড়াত না।
রাজ্যে গণপিটুনির ঘটনা ঘটতেই মুখ্যমন্ত্রী মমতা বন্দ্যেপাধ্যায় কড়া পদক্ষেপ নিয়েছেন। তিনি জ্যোতি বসুর স্টাইলে ‘এমন তো কতই হয়’ জাতীয় মন্তব্য করে বিষয়টি হালকা করতে চাননি। উল্টে তিনি এই ঘটনার তীব্র নিন্দা করেছেন। অভিযুক্তদের বিরুদ্ধে কড়া ব্যবস্থা নেওয়ার নির্দেশ যেমন প্রশাসনকে দিয়েছেন, তেমনই মৃতের পরিবারকে দিচ্ছেন চাকরি। তাতে সেই পরিবারগুলির মানসিক যন্ত্রণা লাঘব না হলেও আর্থিক সঙ্কট থেকে মুক্তি পাবে। 
সম্প্রতি রাজ্যে কয়েকটি গণপ্রহারে মৃত্যুর ঘটনা ঘটেছে। তারকেশ্বরের ঘটনাটি তারমধ্যে পড়ে না। কিন্তু এই ঘটনাটি ‘খুনি মানসিকতা’র বৈশিষ্ট্য বোঝার জন্য যথেষ্ট। তারকেশ্বরে যাঁকে ‘চোর’ বলে দাগিয়ে দিয়ে পিটিয়ে মারা হয়েছে, তিনি মূল অভিযুক্তের আত্মীয়। সম্পর্কিত শ্যালক। ৫০ হাজার টাকা চুরি গিয়েছে, এই অভিযোগ তুলে বাড়ি থেকে এনে পিটিয়ে মেরে দিল। তারপর জানা গেল, টাকা চুরি যায়নি। অথচ একটা প্রাণ অকালে ঝরে গেল। পুলিসের অনুমান, পুষে রাখা রাগ থেকেই এমন কাণ্ড ঘটানো হয়েছে।
বিশেষজ্ঞরা মনে করেন, পিটিয়ে মারার ঘটনায় সক্রিয়ভাবে যারা যুক্ত হয় তারা ‘কান দিয়ে দেখা’ গোত্রের মানুষ। তাই তারা অতি সহজেই চোর, ছেলেধরা, ডাইনি প্রভৃতি গুজবের অংশীদার হয়ে ওঠে। পিটিয়ে মারার ঘটনায় কারও শাস্তি না হলে তা ছড়িয়ে পড়ে ছোঁয়াচে রোগের মতো। এই ধরনের ঘটনা আটকাতে গেলে সামাজিক সচেতনতা বৃদ্ধির পাশাপাশি দরকার অপরাধীদের কঠোর শাস্তি সুনিশ্চিত করা।
কারও কিছু অপছন্দ হলেই তাকে চরম শাস্তি দিতে হবে, এটা মানসিক বিকারের লক্ষণ। এই ধরনের বিকারমুক্তির সর্বোত্তম দাওয়াই কঠোর শাস্তি। সম্ভবত সেই উপলব্ধি থেকেই ২০১৯ সালে মুখ্যমন্ত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় পিটিয়ে মারার ঘটনায় দোষীদের কঠোর শাস্তি দিতে চেয়েছিলেন। তারজন্য তিনি সেবছর বিধানসভায় পাশ করিয়েছিলেন ‘দ্য ওয়েস্ট বেঙ্গল (প্রিভেনশন অফ লিঞ্চিং) বিল। আইনে পরিণত করার জন্য পাঠিয়ে ছিলেন রাজভবনে। কিন্তু তৎকালীন রাজ্যপাল জগদীপ ধনকার তো বটেই, বর্তমানের মহামহিমও সই করেননি। সেই বিলে পিটিয়ে মারার ঘটনায় দোষী প্রমাণিত হলে যাবজ্জীবন কারাদণ্ড থেকে মৃত্যুদণ্ডের বিধানও ছিল। 
দুর্গম পাহাড়ি রাস্তায় গাড়ি চালকদের উদ্দেশে লেখা থাকে, রাস্তা বিপজ্জনক, সামনে বাঁক, গাড়ি আস্তে চালান। জীবন অমূল্য। কিন্তু এই ধরনের সতর্কবাণীতে কি খুব একটা কাজ হয়? অনেকে মনে করেন, সতর্কবাণীর বদলে খাদে পড়া দোমড়ানো মোচড়ানো গাড়ি রাস্তার ধারে রেখে দিলে তা অনেক বেশি কার্যকর হতো। ভয়ঙ্কর পরিণতির কথা ভাবলেই কমে যাবে বেপরোয়া হওয়ার প্রবণতা।
বাম আমলে গণহত্যা ও গণপিটুনির কথা বলতে গেলে আস্ত একটা  মহাভারত হয়ে যাবে। তবে, ১৯৮২ সালের ৩০ এপ্রিল বিজন সেতুর ঘটনা সমস্ত নারকীয়তা ও নৃশংসতাকে ছাপিয়ে গিয়েছিল। ছেলেধরা গুজব রটিয়ে দিয়ে ১৭জন আনন্দমার্গীকে পিটিয়ে পুড়িয়ে মারা হয়েছিল। তারজন্য বামফ্রন্টের কেউ দুঃখ প্রকাশ করেননি। কেউ গ্রেপ্তারও হয়নি। উল্টে জ্যোতি বসুর সরকার আনন্দমার্গীদেরই দায়ী করেছিল। মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় সে রাস্তায় হাঁটেননি। যারা আইন নিজেদের হাতে তুলে নিয়ে নির্মম হত্যাকাণ্ড ঘটিয়েছে তাদের দৃষ্টান্তমূলক শাস্তির ব্যবস্থা করতে নির্দেশ দিয়েছেন। 
যে কোনও গণহত্যার পিছনে থাকে পরিকল্পনা। আর তাকে ‘গণরোষে’র তকমা দিতে গেলে রটাতে হয় গুজব। সোশ্যাল মিডিয়ার দৌলতে গুজব আগুনের চেয়েও দ্রুত ছড়িয়ে পড়ে। গুজবের জেরে মুহূর্তে উত্তপ্ত হয়ে ওঠে এলাকা। তাই সোশ্যাল মিডিয়ার উপরে কড়া নজর রাখার নির্দেশ দিয়েছেন মুখ্যমন্ত্রী। 
১ জুলাই থেকে কেন্দ্রীয় সরকার আইন সংশোধন করেছে। ন্যায় সংহিতার ১০৩(২) ধারায় গণপিটুনিতে দোষীর শাস্তির উল্লেখ রয়েছে। সেখানে যাবজ্জীবন কারাদণ্ড থেকে মৃত্যুদণ্ডের বিধান রয়েছে, যা কার্যত মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ের পাশ করানো সেই বিলের ‘ফটোকপি’। গণপিটুনি রোধে বাংলা পাঁচ বছর আগে যা ভেবেছিল, দিল্লি তা ভাবল আজ। অনেকে বলছেন, রাজভবন তখন বিলে সম্মতি দিলে হয়তো বহু নারীর জীবনে নেমে আসত না অকাল বৈধব্য, বাবাকে হারানোর যন্ত্রণায় কাতর হতো না শৈশব, শূন্য হতো না মায়ের কোল! আক্ষেপটা এখানেই।
3Months ago
কলকাতা
রাজ্য
দেশ
বিদেশ
খেলা
বিনোদন
ব্ল্যাকবোর্ড
শরীর ও স্বাস্থ্য
সিনেমা
প্রচ্ছদ নিবন্ধ
আজকের দিনে
রাশিফল ও প্রতিকার
ভাস্কর বন্দ্যোপাধ্যায়
mesh

মৃৎশিল্পী, ব্যবসায়ী প্রমুখদের বিশেষ কর্মোন্নতি যোগ প্রবল। পেশাদারি কর্মে শুভ ফল প্রাপ্তি। মানসিক চাঞ্চল্য।...

বিশদ...

এখনকার দর
ক্রয়মূল্যবিক্রয়মূল্য
ডলার৮৩.১৩ টাকা৮৪.৮৭ টাকা
পাউন্ড১০৮.৫০ টাকা১১২.০৬ টাকা
ইউরো৯১.০৪ টাকা৯৪.২২ টাকা
[ স্টেট ব্যাঙ্ক অব ইন্ডিয়া থেকে পাওয়া দর ]
*১০ লক্ষ টাকা কম লেনদেনের ক্ষেত্রে
দিন পঞ্জিকা