পিতার স্বাস্থ্যহানী হতে পারে। আর্থিক ক্ষেত্রে প্রয়োজনীয় অর্থের অভাব হবে না। পঠন-পাঠনে পরিশ্রমী হলে সফলতা ... বিশদ
রাইটার্স বিল্ডিং-এর সামনে দিয়ে যাবার সময় তোমরা হয়তো অনেকেই দেখেছ দৃপ্তভঙ্গিতে সহাস্য মুখে দাঁড়িয়ে থাকা তিনজন যুবকের স্ট্যাচু। কিংবা মিনিবাসের গায়ে দেখেছ লেখা আছে ‘বি-বা-দী-বাগ’, কি মনে পড়ছে তো? এই ‘বি’ হলেন বিনয়কৃষ্ণ বসু, ‘বা’ হলেন বাদল গুপ্ত আর ‘দী’ হলেন দীনেশ গুপ্ত। এঁরাই হলেন সেই তিনজন অসম সাহসী যুবক যাঁদের মূর্তি তোমরা দেখেছ ‘রাইটার্স বিল্ডিং’-এর ঠিক সামনে। কিন্তু কারা এঁরা? আর কেনই বা তাঁদের মূর্তি ‘রাইটার্স বিল্ডিং’-এর সামনে প্রতিষ্ঠিত আছে? আজ তোমাদের শোনাব সেই কাহিনীই।
১৯০৮ সালের ১১ সেপ্টেম্বর ঢাকার রাইতভোর গ্রামে বাবা রেবতীমোহন ও মা ক্ষীরোদবাসিনীর ঘরে জন্মেছিলেন বিনয়কৃষ্ণ বসু। কৈশোরেই তিনি ঢাকার বিপ্লবী নেতা হেমচন্দ্র ঘোষের দ্বারা প্রভাবিত হন। হেমচন্দ্র ঘোষের নেতৃত্বে তখন ঢাকায় গড়ে উঠেছিল মুক্তি সঙ্ঘ। সঙ্ঘের মুখপত্র ছিল ‘বেণু পত্রিকা’। বিনয় মুক্তি সঙ্ঘের সঙ্গে যুক্ত হয়ে পড়লেন। তারপর যখন ১৯২৮ সালে ‘বেঙ্গল ভল্যান্টিয়ার্স’ দল গঠিত হল তখন সেই দলের সঙ্গেও যুক্ত হলেন তিনি। ঢাকা মিড কোর্ট মেডিকেল স্কুলে ডাক্তারি পড়ার সময়ই নির্মম অত্যাচারী বাংলার পুলিস প্রধান মিঃ লোম্যান ও ঢাকার পুলিসকর্তা কুখ্যাত মিঃ হডসন যখন মেডিকেল হাসপাতাল দেখতে এলেন তখন দুঃসাহসী বিপ্লবী বিনয়কৃষ্ণ বসু দলের নির্দেশে গুলি করে হত্যা করলেন তাদের। এক সরকারি ঠিকাদার তাঁকে ধরে ফেললেও বিনয়ের এক মোক্ষম ঘুসিতে সে ঘায়েল হয়ে পড়ল এবং বিনয় পালিয়ে আত্মগোপন করলেন। পুলিস তাঁর মাথার দামের পুরস্কার ঘোষণা করল দশ হাজার টাকা। কিন্তু তাঁকে ধরা পুলিসের অসাধ্য ছিল। পুলিসের চোখে ধুলো দিয়ে তিনি কৌশলে পূর্ববঙ্গ ছেড়ে কলকাতায় পালিয়ে এলেন। এরপরই তাঁর ওপর দায়িত্ব পড়ল কারাধ্যক্ষ সিম্পসন ও স্বরাষ্ট্রসচিব মারকে হত্যার অভিযানে নেতৃত্ব দেবার।
বিনয়ের মতোই বাদল গুপ্তেরও জন্ম ঢাকায়। বিদগাঁও গ্রামে। বাবার নাম অবনীনাথ। বিক্রমপুরের বার্নার স্কুলের শিক্ষক বিপ্লবী নেতা নিকুঞ্জ সেনের প্রভাবে বাদলও বৈপ্লবিক কাজকর্মে জড়িয়ে পড়লেন কিশোর বয়স থেকেই। বাংলাদেশের সর্বত্র তখন চলছে ব্রিটিশ সরকারের বিরুদ্ধে লড়াই। বিপ্লবীরা ঠিক করলেন ব্রিটিশ সরকারকে অচল করে দেবার জন্য সমস্ত টেলিগ্রাম ও টেলিফোনের তার ছিঁড়ে ফেলা হবে। এই কাজে বিক্রমপুরের দায়িত্ব দেওয়া হল বাদলকে। তিনি সে দায়িত্ব অত্যন্ত সাহসিকতার সঙ্গে পালন করলেন। বিক্রমপুরের কোথাও কোনও টেলিগ্রাম, টেলিফোনের চিহ্ন পর্যন্ত রাখলেন না বাদল। বাদলকে গ্রেপ্তার করতে বিশাল পুলিসবাহিনী ছুটে এলেও তার আগেই বাদল পালিয়ে চলে এলেন কলকাতায়। গুপ্ত বিপ্লবী দল ‘বেঙ্গল ভল্যান্টিয়ার্স’-এর সভ্য হলেন। এবং এঁদেরই নির্দেশ অনুসারে তাঁর ওপর দায়িত্ব পড়ল সিম্পসন ও মারকে হত্যা করার।
এই ত্রয়ীর তৃতীয় সদস্য হলেন দীনেশচন্দ্র গুপ্ত, ঢাকার বিক্রমপুরের যশোলং গ্রামে ১৯১১ সালের ৬ ডিসেম্বর বাবা সতীশচন্দ্র গুপ্ত ও মা বিনোদিনীদেবীর ঘরে জন্মগ্রহণ করেন। বিপ্লবী দীনেশচন্দ্র গুপ্তের অন্যতম প্রধান কীর্তি হল প্রথমে ঢাকা ও পরে মেদিনীপুরে এক বিশেষ বিপ্লবী সংগঠন গড়ে তোলা। এই সংগঠনের বিপ্লবীরা মেদিনীপুরের তিনজন অত্যাচারী জেলা ম্যাজিস্ট্রেটকে পরপর হত্যা করতে সফল হন। দেশে তখন শুরু হয়েছে অসহযোগ আন্দোলন। সেই সময় কুখ্যাত পুলিস সুপার মিঃ হডসন পিকেটরদের ওপর অমানুষিক অত্যাচার চালাতে থাকে। তখন এই দোর্দণ্ডপ্রতাপ বিদেশি শাসককে একাই প্রতিহত করেন নির্ভীক বিপ্লবী দীনেশ গুপ্ত।
দলের আদেশে বিনয় বসুর নেতৃত্বে, বাদল গুপ্ত ও দীনেশ গুপ্তকে নিয়ে ‘রাইটার্স বিল্ডিং’ অভিযানের পরিকল্পনা শুরু হল। প্রথমে দীনেশ আর বাদল পার্ক স্ট্রিটের এক গোপন স্থানে আস্তানা নিলেন। মেটিয়াবুরুজে রাজেন গুহর বাড়ি থেকে বিনয় এসে মিলিত হবেন তাঁদের সঙ্গে এমনই পরিকল্পনা। দীনেশ খুব খেতে ভালোবাসতেন। তাই অ্যাকসান স্কোয়াডের নিকুঞ্জ সেনকে আগেই বলে রেখেছিলেন এই অভিযানে যাবার আগে তাঁদের পেট ভরে খাওয়াতে হবে। কথা রেখেছিলেন নিকুঞ্জ সেন। নিশ্চিত মৃত্যুর মুখে দাঁড়িয়েও জীবনের এই রসাস্বাদন করবার মানসিকতা বোধ হয় শুধু এই দুঃসাহসী বিপ্লবীদের পক্ষেই সম্ভব।
শীতের দিনের এক কর্মব্যস্ত নগরী। ‘রাইটার্স বিল্ডিং’-এর সামনে জমজমাট জীবন বয়ে চলেছে। দিনটা ১৯৩০ সালের এমনই এক ৮ ডিসেম্বর। ঘড়িতে তখন বেলা সাড়ে বারোটা— তিনজন যুবক সাহেবি পোশাকে সজ্জিত হয়ে এসে দাঁড়ালেন ‘রাইটার্স বিল্ডিং’-এর বড় গেটের সামনে। সপ্রতিভভাবে তাঁরা উঠে গেলেন দোতলায়। দেখা করতে চাইলেন কারা বিভাগের অত্যাচারী ইন্সপেক্টর জেনারেল কর্নেল সিম্পসন সাহেবের সঙ্গে। পরমুহূর্তেই অনুমতি বা বাধা কোনওটারই তোয়াক্কা না করে দরজা ঠেলে ঘরে ঢুকে পড়লেন তাঁরা তিনজন। সিম্পসন তখন টেবিলে বসে জরুরি ফাইল দেখছিলেন। মুখ তুলে তাকাতেই তিনি কিছু বুঝে উঠবার আগেই বিনয়-বাদল-দীনেশের হাতের পিস্তল গর্জে উঠল আর সঙ্গে সঙ্গেই মাটিতে লুটিয়ে পড়ল কুখ্যাত সিম্পসনের নিথর, নিস্পন্দ দেহ। সফল অভিযানের আনন্দে যখন উৎফুল্ল হয়ে উঠেছেন তাঁরা তিনজন, তখনই গুলির শব্দ শুনে ছুটে এল রক্ষীর দল। শুরু হল গুলিবর্ষণ। ততক্ষণে বারান্দা পার হয়ে গুলি চালাতে চালাতে ওঁরা তিনজন পাসপোর্ট অফিসের সামনে চলে এসেছেন। দু’পক্ষই গুলি চালাতে পিছপা হচ্ছেন না। জরুরিবার্তা ততক্ষণে পৌঁছে গেছে পুলিসের হেড কোয়ার্টার লালবাজারে। ছুটে এসেছে বিশাল পুলিসবাহিনী। গুলি চালাতে চালাতেই একটি ঘরের ভিতর গিয়ে আশ্রয় নিয়েছেন ওঁরা তিনজন। একসময় গুলি ফুরিয়ে গেল তাঁদের। কিন্তু ধরা তো তাঁরা কিছুতেই দেবেন না। দলনেতা বিনয়ের নির্দেশে তিনজনেই পকেট থেকে বার করলেন পটাশিয়াম সাইনায়েড বিষ এবং ‘বন্দেমাতরম্’ ধ্বনি দিতে দিতেই পুরে দিলেন মুখে, তারপর শেষ গুলি কটা নিজেদের মাথা লক্ষ করে চালিয়ে দিলেন। তৎক্ষণাৎ লুটিয়ে পড়লেন বাদল। জ্ঞান হারালেন দীনেশ আর আচ্ছন্নের মতো মাথায় গুলির আঘাত নিয়ে বসে রইলেন বিনয়।
পুলিস হাসপাতালে নিয়ে গেল দীনেশ ও বিনয়কে। চিকিৎসা শুরু হল তাঁদের। কিন্তু পাছে সুস্থ হয়ে উঠলে পুলিস তার মুখ থেকে কোনও কথা বার করতে চেষ্টা করে, সেই আশঙ্কায় বিনয় নিজের মাথার ক্ষতস্থানের ব্যান্ডেজ নিজেই আলগা করে ক্ষতস্থানে আঙুলের খোঁচা দিয়ে ঘা বিষিয়ে দিলেন। পাঁচ দিন পর ১৩ ডিসেম্বর ক্ষতস্থান সেপটিক হয়ে মৃত্যুকে বরণ করে নেন তিনি।
দীনেশ সুস্থ হয়ে ওঠেন। কিন্তু কোনও স্বীকারোক্তি তাঁর কাছ থেকে আদায় করতে পারে না পুলিস। বিচারে তাঁর ফাঁসির হুকুম হয়। কারাগারে থাকার সময় তিনি কয়েকটি চিঠি লেখেন, যাতে বিপ্লবীদের সাধনা, তাঁদের ত্যাগ স্বীকারের কথা ফুটিয়ে তোলেন তিনি। চিঠিগুলির সাহিত্যিক মূল্যায়নও যথেষ্ট উল্লেখযোগ্য। ১৯৩১ সালের ৬ জুলাই তাঁর ফাঁসি হয় আলিপুর জেলে। ইতিহাস তাঁদের এই ‘রাইটার্স বিল্ডিং’ অভিযানকে বিখ্যাত ‘অলিন্দ-যুদ্ধ’ নামে চিহ্নিত করেছে।
১৯৬৯ সালে ডালহৌসি স্কোয়ারের নাম পরিবর্তন করে রাখা হয় বিনয়-বাদল-দীনেশ বাগ। এবার থেকে যখনই ‘রাইটার্স বিল্ডিং’-এর সামনে দিয়ে যাবে, ভারতমায়ের এই তিন অসমসাহসী সন্তান বিনয়-বাদল-দীনেশের উদ্দেশে সশ্রদ্ধ প্রণাম জানাতে ভুলো না কিন্তু।