পিতার স্বাস্থ্যহানী হতে পারে। আর্থিক ক্ষেত্রে প্রয়োজনীয় অর্থের অভাব হবে না। পঠন-পাঠনে পরিশ্রমী হলে সফলতা ... বিশদ
রাজমাতা রাজার বিকচ মাথায় হাত বুলিয়ে দিয়ে বলেন, ‘সাতরাজার ধন মানিক আমার, বুকের পাঁজর, চোখের মণি, সোনার খনি। কাঁদতে নেই রে বোকা! কাঁদিস নারে খোকা। প্রজারা করবে কান্নাকাটি। রাজা হবে ভাবগম্ভীর, পরিপাটি। কান্না তোকে করতেই হবে বর্জন। রাজার গুণ করতে হবে অর্জন। সিংহাসনে বসে সিংহের মতো করতে হবে গর্জন।’ প্রধানমন্ত্রী বলল, ‘তাছাড়া মহারাজ, করলে এমন কান্নাকাটি, আখেরে সব হবে মাটি। রাজার চোখে জল কি শোভা পায়? প্রজারা ভাববে রাজা অসহায়। তখন কি কেউ খাজনা দেবে? সবাই তখন সুযোগ নেবে।’ তা কে কার কথা শোনে? মাঝরাতে রাজপ্রাসাদ থেকে বহুদূরের গ্রামেও রাজার কান্নার স্বর ভেসে আসে। প্রজারা বলাবলি করে, রাজার এত কান্না কীসের জন্য? শোক-তাপ কিছু পেল কি রাজা? না কি কারণ কিছু অন্য?’
রাজা কাঁদছে চুলের শোকে। নোলকপুরের এই হাসিখুশি স্বনামধন্য গোলকরাজা, গোলকচন্দ্র গলুই কঠিন অসুখে পড়েছিল। জ্বরই সারছিল না। পাক্কা দু’মাস যমে-মানুষে টানাটানি হল। শেষে রাজবদ্যি এইসা কড়া দাওয়াই চার্জ করল, তাতে জ্বর তো সারল বিলক্ষণ। কিন্তু, কুলক্ষণ যা তা হল, ওই কড়া কড়া ওষুধের ধাক্কায় রাজার মাথার চুল সব ঝরে পড়ে গেল। জ্বরের ঘোর কাটার পরে রাজা আয়না দেখে বজ্রপাতের মতো গর্জন করে বলল, ‘এ কী! আমার মাথার সব চুল কোথায় গেল?’ কাছেই রাজবদ্যিকে দেখে রাজা বলল, ‘কী হল বদ্যি? উত্তর দিচ্ছ না কেন? শুনতে পাওনি যেন!’ রাজবদ্যি বলল, ‘মহারাজ, আপনার ওপর দিয়ে দু’তিন মাস কী ঝড়টাই না গেল! সেই ঝড়েই আপনার চুলগুলো যে কোথায় উড়ে গেল।’ রাজা ভেংচি কেটে বলে, ‘কোথায় উড়ে গেল!’ তারপর হুঙ্কার ছেড়ে রাজা বলল, ‘এবার তোমার ধড় থেকে মুণ্ডুটাও যে কোথায় উড়ে যাবে, বুঝবে তখন। তোমার গর্দান নেব আমি।’ রাজার চিৎকার শুনে বড়রানি ছুটে এল। বলল, ‘ওগো, যা গেছে তা যাক। এখন ও প্রসঙ্গ থাক।’ শুনে রাজা ভেউ ভেউ করে কেঁদে ফেলে। বলে, ‘থাকবে মানে কী? ওই হতচ্ছাড়া কোবরেজ চিকিচ্ছের জানে কী? আমার চুলের কী কোয়ালিটি ছিল তুমি বলো রানি?’ রানি বলল, ‘জানি গো জানি। ঘোড়ার ল্যাজের মতো থিকনেস। হায় হায়, দু’মাসের জ্বরে সব শেষ।’ রানির মুখে হা-হুতাশ শুনে রাজা চুলের শোকে সেই যে মরাকান্না শুরু করেছে, সেই কান্না আর থামে না। কাঁদতে কাঁদতে ফাটা কাঁসরঘণ্টার মতো ঘ্যাঙর ঘ্যাঙর করে রাজা বলছে, ‘রাজবদ্যি, তুমি ডাক্তার না ছাই। একমাসের মধ্যে আমার চুল গজাবার ব্যবস্থা করা চাই। বিদেশ থেকে ওষুধ আনাও। হোক সে ওষুধ যত দামি। নইলে তোমায় সপরিবারে শূলে চড়াব আমি।’ রাজবদ্যি কাঁদো কাঁদো স্বরে বলল, ‘চিকিচ্ছেয় আমি রাখিনি কোনও ফাঁক। তবু কেন যে এই অলুক্ষুণে টাক! আমি বলি কী, চুলোয় যাক চুল। পরে নিন পরচুল।’ শুনে গোলকরাজার কাটা ঘায়ে নুনের ছিটে পড়ল। ক্ষোভে, দুঃখে, অপমানে রাজা আরও উচ্চস্বরে কাঁদতে লাগল।
পরিস্থিতি ক্রমশ জটিল হচ্ছে দেখে, প্রধানমন্ত্রী কোতোয়ালকে ডেকে বলল, ‘কোচোয়ানকে সাজাতে বলো গাড়ি। যাব বিদূষকের বাড়ি।’ তারপর আটঘোড়ার টমটম ছুটিয়ে প্রধানমন্ত্রী গেল বিদূষকের কাছে দেশনা নিতে। সব শুনে বিদূষক বলল, ‘চলুন রাজার কাছে যাই।’ প্রধানমন্ত্রী বলল, ‘কী মতলব আঁটলেন, আগে সেটা শুনতে চাই।’ বিদূষক বলল, ‘মন্ত্রগুপ্তি যা আছে, তা দেব রাজার কানে। আশাকরি বুঝবে রাজা কী কথার কী মানে।’
রাজা তো সকালে ঘুম থেকে উঠে গলা সাধার মতো করে কেঁদেই চলেছে। বিদূষককে দেখে রাজার কান্না এক দমকে সপ্তমে গেল চড়ে। হাপুস নয়নে কাঁদতে কাঁদতে বলল, ‘দেখো বিদূষক দেখো। হতভাগা বদ্যিবুড়ো আমার কী হাল করেছে।’ বিদূষক বলল, ‘আছে সহজ সমাধান। চিন্তা কীসের অত? অচিরেই চুল গজাবে ধানের চারার মতো। তবে মহারাজ সার কথাটি যেমন জেনেছি, মন্ত্রগুপ্তি তেমন এনেছি। দয়া করে গুপ্তকক্ষে যেতে হবে, মন্ত্রগুপ্তি দেব।’ শুনে রাজা বেশ পুলকিত হল। তক্ষুনি বিদূষককে নিয়ে গুপ্তকক্ষে গেল রাজা। কয়েক মিনিটের মধ্যেই সেই কাঁদুনে রাজা প্রাসাদ কাঁপিয়ে অট্টহাসি হাসতে হাসতে বেরিয়ে এল গুপ্তকক্ষ থেকে।
রাজার এই আচমকা রূপান্তর দেখে সবাই খুব ঘাবড়ে গেল। বড়রানি, মেজরানি, ছোটরানি সবার চোখ ছানাবড়া। তারা ভাবছে রাজা কি পাগল হয়ে গেল? গুপ্তকক্ষে বিদূষক রাজা গোলকচন্দ্রের কানে কী মন্ত্র দিল! যে মন্ত্রের জোরে রাজার কান্না কর্পূরের মতো উবে গিয়ে অট্টহাসি হয়ে গেল? বড়রানি সাহস করে বলল, ‘ওগো তুমি হাসছ কেন অমন করে? রয়েছ কীসের ঘোরে? তুমি কি পাগল হলে?’ শুনে রাজা গোলকচন্দ্র বলল, ‘তোমাকে আমি বোঝাব কী বলে? হাসছি পাগল ছিলাম বলে। বুঝলে রানি, বিদূষক আমায় যে মন্ত্রগুপ্তি দিল, তা কানে শোনার চেয়ে মরণও ছিল ভালো। ব্যাটা বিদূষক বলে কি না, ধিন তাক ধিন তাক। টাকার বন্ধু টাক। টাকা গেলে টাকও যাবে। তখন ঠিক চুল গজাবে। রাজ্যজুড়ে ঢেঁড়া পিটিয়ে রাজকোষ করে ফাঁকা, মুক্ত হস্তে বিলিয়ে দিন গচ্ছিত সব টাকা। বোঝ কথা! আমি বললাম, এমন সর্বনাশা মন্ত্রগুপ্তি শোনালে বিদূষক, খেলাম যেন হাই ভোল্টেজ ইলেকট্রিকের শক। টাকার জন্য যদি টাক, তবে সে টাক তো লক্ষ্মী। সে লক্ষ্মী আমার মাথায় থাক। বলে রাজা মেঘের মতো গর্জন তুলে অট্টহাসি হাসতে লাগল। সে হাসি আর থামেই না...