পিতার স্বাস্থ্যহানী হতে পারে। আর্থিক ক্ষেত্রে প্রয়োজনীয় অর্থের অভাব হবে না। পঠন-পাঠনে পরিশ্রমী হলে সফলতা ... বিশদ
বছরখানেক আলিপুরে থাকার সময় হঠাৎ একটা চিঠি পেলাম, বেশ সুন্দর রংচঙে চিঠি। একটা রঙিন সুতো দিয়ে মুখটা বন্ধ করা। দেখেই বুঝলাম এটা বিবাহের নিমন্ত্রণপত্র। চিঠির মুখটা খুলেই জানলাম চিঠিটা এসেছে বাঁকুড়া থেকে। আদালতের সাবজজবাবু তাঁর মেয়ের বিয়েতে নিমন্ত্রণপত্র পাঠিয়েছেন। বাঁকুড়ায় চাকুরিসূত্রে থাকার সময় সাবজজের সঙ্গে একটা হৃদ্যতার সম্পর্ক গড়ে উঠেছিল। নিমন্ত্রণ পত্রের খামের ভিতরে হাতে লেখা একটা ছোট্ট চিঠি।—‘বিয়েতে অবশ্যই আসবেন। আমার প্রথম কন্যার বিবাহে আপনার আসা চাই। নতুন থার্ড মুন্সেফ না আসার জন্য আপনার কোয়ার্টারটা খালি। বাঁকুড়া এসে দুটো দিন ওখানেই থাকবেন। জজসাহেবের অনুমতি নিয়ে সব ব্যবস্থা করে রেখেছি।’
এরপর অবশ্য আর নেতিবাচক কিছু বলা সম্ভব নয়। ঠিক করে ফেললাম বিয়ের আগের দিন পুরুলিয়া ফার্স্ট প্যাসেঞ্জার ধরে বাঁকুড়া রওনা হব। সাবজজবাবুকে একটা পোস্ট কার্ড লিখে পাঠালাম। আপনার কন্যার বিয়ের আগের দিন রাতে পুরুলিয়া ফার্স্ট প্যাসেঞ্জার ধরে আমি রওনা হচ্ছি। বাঁকুড়া তো আমার চেনা জায়গা। তাই স্টেশন থেকে বেরিয়ে একটা রিকশ করে আপনার কোয়ার্টারে পৌঁছতে কোনও অসুবিধে হবে না।
তখনকার সময়টা ছিল অন্যরকম। ট্রেন ঠিক সময়ে ছাড়ত। গন্তব্যস্থলে পৌঁছতে দেরি করত না। যাই হোক নির্ধারিত দিনে ঠিকসময়েই আমার গাড়ি এসে বাঁকুড়ায় থামল। এটা জংশন স্টেশন। ওই সময় ইলেকট্রিক ইঞ্জিন কিংবা ডিজেল গাড়ির চল হয়নি। তাই কয়লার ইঞ্জিনকে জংশন স্টেশন থেকে জল নিতে হতো। মূল গাড়ি থেকে ইঞ্জিনের যোগাযোগ বিচ্ছিন্ন করে দেবার পর সেটা কিছুদূরে গিয়ে বিশাল এক পাইপের মাধ্যমে ইঞ্জিনের জলাধারে জল ভরতে হতো।
আমার লাগেজ বলতে ছোট্ট একটা চামড়ার সুটকেস। সেটা হাতে নিয়ে ওভার ব্রিজের উপর দিয়ে হেঁটে বাইরে চলে এলাম। রিস্টওয়াচের দিকে তাকিয়ে দেখলাম আড়াইটে বাজছে। অত রাত্তিরে দু-তিনটে রিকশ যাত্রীর প্রতীক্ষায় দাঁড়িয়ে। সামনে যে রিকশটা পেলাম তাতেই উঠে বসলাম। বললাম,—‘কোর্ট কম্পাউন্ডে নিয়ে চল সাবজজবাবুর বাড়ি। রিকশওয়ালা কোর্ট কম্পাউন্ড চেনে। তাই দ্বিরুক্তি না করে সে সিটে বসে প্যাডেলে চাপ দিল।’
গাড়ি চলতে শুরু করল। পথ জনহীন। শুনশান। অগ্রহায়ণ মাস। ইতিমধ্যেই বিহার-ঘেঁষা এই শহরে মধ্যরাত্রির পরই বেশ ঠান্ডা। তবু বুদ্ধি করে জামার নীচে সোয়েটার পরে এসেছিলাম বলে ঠান্ডা তেমন লাগেনি।
পাটপুরে যাবার মুখে রিকশওয়ালা গাড়িটা ডানদিকে ঘুরিয়ে নিল। কোর্ট-কম্পাউন্ডে যাবার এটাই অবশ্য রাস্তা। পাটপুরে যাবার পথ ছেড়ে কোর্ট-কম্পাউন্ডের দিকে চলেছি। পথ জনহীন। একটা সারমেয়র অব্যক্ত আওয়াজও শোনা যায় না। পথের ধারে টিমটিমে বৈদ্যুতিক আলো। কোথাও বাল্বটা ফিউজ হবার পর আর পাল্টানো হয়নি। হঠাৎ ফস করে একটা শব্দ হতেই আমি চমকে উঠলাম। রিকশওয়ালা বলল,— ‘সামনের চাকাটা পাংচার হয়ে গেছে স্যার, এখন কী যে করি। এখানে দাঁড়িয়ে থাকলে খালি রিকশ পেতে রাত কাবার হয়ে যাবে।’
রিকশওয়ালা বলল,— ‘স্যর কোর্ট-কম্পাউন্ড তো কাছেই। আর আপনার সঙ্গে তো কোনও মালপত্র নেই। এইটুকু পথ আপনি হেঁটেই যেতে পারবেন। নইলে পাটপুরে যাবার মোড়ে গিয়ে দাঁড়াবেন চলুন। যদি খালি রিকশ পাওয়া যায়।’
ওকে বললাম,—‘তার প্রয়োজন নেই। এই পথটুকু আমি হেঁটেই যেতে পারব। আর এই সুটকেসটা প্রায় খালি। এটা হাতে নিয়ে কোর্ট কম্পাউন্ড যেতে আমার কোনও অসুবিধে হবে না।’
রিকশওয়ালা গাড়ির মুখ ঘুরিয়ে পাটপুরের দিকে চলে গেল। সুটকেসটা হাতে নিয়ে আমি ধীরে-ধীরে হাঁটছি। কী গাঢ় অন্ধকার। অমাবস্যা নয় তো? হঠাৎ মনে হল উল্টোদিক থেকে পিপে গোছের কোনও বস্তু গড়াতে-গড়াতে আমার দিকে এগিয়ে আসছে। আবছা অন্ধকারে দেখলাম একটা কুচকুচে কালো লোক পিপেটার পিছনে দাঁড়িয়ে সেটাকে ঠেলে নিয়ে এগচ্ছে। এই অবস্থায় থমকে দাঁড়ালাম। গড়াতে-গড়াতে পিপেটা যদি আমাকেই ধাক্কা দেয় তাহলে আমার অবস্থা সেই পপাত ধরণীতলে। কিন্তু নাহ। পিপেটা গড়াতে-গড়াতে হঠাৎ দাঁড়িয়ে গেল। যে কুচকুচে কালো লোকটা ওটাকে ঠেলে নিয়ে আসছিল সে হঠাৎ সামনে এসে পিপেটাকে ফের উল্টোদিকে ঠেলতে শুরু করল। দেখতে পেলাম ওই কুচকুচে কালো লোকটা পিপেটাকে ঠেলতে-ঠেলতে ফের ওপরে উঠছে। বেশ ভয় পেয়ে কী করব তাই ভাবছি। পিছন ফিরে এক দৌড়ে পাটপুর কিংবা ফিডার রোডে পালিয়ে যাব নাকি? ঠিক সেই মুহূর্তে দেখলাম ওই রকমই আর একটা কুচকুচে কালো লোক অন্য একটা পিপেকে পিছন থেকে ঠেলতে ঠেলতে আমার দিকে এগিয়ে আসছে। বুঝতে দেরি হয়নি যে এটা ভৌতিক কাণ্ড। ওই দুটো কুচকুচে কালো লোক দুটো অশরীরী আত্মা বই অন্য কিছু নয়। এরপর ওরা যদি পিপে দুটোকে ফেলে আমার সামনে এসে দাঁড়ায়? পা দুটো কাঁপছিল। মুখ দিয়ে ভয়ে একটি বাক্য সরেনি। সুটকেসটা হাতে নিয়ে পিছন ফিরে পাটপুর কিংবা ফিডার যাব বলে পা বাড়িয়েছি। হঠাৎ সামনে তাকিয়ে দেখি হেড-লাইটের জোরালো আলো ফেলে একটা জিপ গাড়ি এগিয়ে আসছে। আমি উদ্ভ্রান্তের মতো সামনে দাঁড়াতেই ব্রেক কষে জিপ থামল। গাড়িতে একজন পুলিস অফিসার। আমাকে ওই অবস্থায় দেখে তিনি গাড়ি থেকে নেমে জিজ্ঞেস করলেন,—‘কী ব্যাপার? এত রাত্তিরে এই অবস্থায় এখানে আপনি?’
বললাম,—‘রিকশটা পাংচার হয়ে গেল। তাই বাকি পথটুকু হেঁটে সাবজজবাবুর বাড়ি যাচ্ছিলাম। হঠাৎ—
আর কোনও প্রশ্ন না করেই পুলিস অফিসার হাত ধরে টেনে আমাকে গাড়িতে তুললেন। তারপর সাবজজবাবুর কোয়ার্টারের সামনে নামিয়ে দিয়ে চলে গেলেন।
সেই রাত্তিরে পথে আসার সময় কী ঘটেছিল সাবজজবাবুকে সে কথা বলিনি। পরদিন ভোরে ঘুম থেকে উঠে একটা রিকশ নিয়ে আমি ফের সেই জায়গায় চলে এলাম। আশ্চর্য! রাস্তা থেকে দশ-বারো হাত দূরে একটা বন্ধ বাড়ির সামনে পিপে দুটো দিব্যি পাশাপাশি রয়েছে, অথচ গতকাল রাত্রির প্রায় শেষ যামে এই পিপে দুটোকে কারা যেন ঠেলতে-ঠেলতে একবার নীচে নিয়ে যাচ্ছিল। আবার উল্টোমুখে ওই দুটোকে ফের ঠেলে-ঠেলে ওপরে টেনে তুলল।’
রাস্তায় দাঁড়িয়ে রিকশওয়ালা বলল, —‘বাবু কি এই সাতসকালে পিপে দুটোকে দেখবেন বলেই এখানে এসেছেন?’
ওকে বললাম,—‘হ্যাঁ মানে গতকাল রাত্তিরে একটা ঘটনা—’
আমার মুখের কথা কেড়ে নিয়ে রিকশওয়ালা বলল,—‘বুঝতে পেরেছি। গতকাল অনেক রাত্তিরে আপনি ওই পিপে দুটোকে রাস্তায় গড়াতে-গড়াতে একবার নীচের দিকে আবার ওপরের দিকে উঠে আসতে দেখেছেন, তাই না?’
অস্ফুটে বললাম,—‘হ্যাঁ মানে—’
রিকশওয়ালা বলল,—‘কুচকুচে কালো দুটো লোক পিপে দুটোকে পিছন থেকে ঠেলছিল। আবার উল্টোমুখে ঠেলতে-ঠেলতে পিপে দুটোকে ওপরে নিয়ে এল। তাই না?’
‘ওর কথার জবাব না দিয়ে আমি চুপ করে দাঁড়িয়ে’ আমাকে প্রায় একটা ধমক দিয়ে রিকশওয়ালা বলল,—‘চলে আসুন ওখান থেকে। ওই যে বন্ধ ঘরটা দেখছেন ওটা কী জানেন?’
আমি নেতিবাচক দৃষ্টিতে ওর দিকে তাকিয়ে।
রিকশওয়ালা বলল,—‘ওটা হল মড়াকাটা লাশঘর।’
‘তার মানে মর্গ?’
‘হ্যাঁ। আপনার মতো আরও অনেকে অমাবস্যার রাত্তিরে কুচকুচে কালো দুটো লোককে পিপে দুটো গড়াতে-গড়াতে একবার নীচের দিকে নিয়ে যেতে দেখেছে আবার ঠেলতে-ঠেলতে ওপরে টেনে এনেছে।’
রাস্তায় এসে রিকশতে ওঠার সময় আর একবার তাকিয়ে দেখলাম। লাশঘরের দরজা বন্ধ। আর সামনেই পিপে দুটো দিব্যি বহাল তবিয়তে রয়েছে।
কে বলবে গতকাল অমানিশার শেষ যামে এই পিপে দুটো কারা যেন ঠেলতে-ঠেলতে একবার নীচে নিয়ে গেল। ফের ঠেলতে-ঠেলতে ওপরে টেনে নিয়ে এল?’