বিদ্যার্থীদের বেশি শ্রম দিয়ে পঠন-পাঠন করা দরকার। কোনও সংস্থায় যুক্ত হলে বিদ্যায় বিস্তৃতি ঘটবে। কর্মপ্রার্থীরা ... বিশদ
‘আমার বয়স তখন ছ’বছর। অন্য চার ভাইবোন আকি, ইচিরো, মিসা আর তোশি। ছোট্ট তোশি প্রতিদিনই ডিম খেত। কিন্তু আমাদের মুরগিটা সেদিন ডিম পাড়েনি। মা আর তোশি মিলে অনেকক্ষণ ডিম খুঁজেছিল। পায়নি। আমরা কাদামাটি নিয়ে খেলছিলাম। হঠাৎ করেই আকাশে বি-২৯ বিমানের ইঞ্জিন গর্জে উঠল। পিকাডন! (জাপানি এই শব্দটি দিয়ে মূলত পারমাণবিক বোমার বিস্ফোরণকেই বোঝানো হয়ে থাকে। ‘পিকা’ অর্থ ‘অতি উজ্জ্বল আলো’ এবং ‘ডন’ অর্থ ‘বিস্ফোরণ’) অসহ্য যন্ত্রণা নিয়ে তোশি, আকি, ইচিরো— ওরা সবাই চলে গিয়েছে। চলে গিয়েছে মিসাও। আমার বাবা, আমার মা সবাই। আমিও প্রায় মরেই গিয়েছিলাম।’ এটুকু বলে থেমে গিয়েছিলেন সাচিকো। শেষে শুধু বলেছিলেন, ‘আমার সঙ্গে যা হয়েছে, তা যেন তোমাদের সঙ্গে কোনওদিন না হয়।’
কারেন স্টেলসনের লেখা ‘সাচিকো, আ নাগাসাকি বম্ব সারভাইভার্স স্টোরি’। এক হিবাকুশার গল্প। পারমাণবিক বোমা হামলার পর হিরোশিমা ও নাগাসাকির যারা বেঁচে গিয়েছিলেন, তাদের বলা হয় হিবাকুশা। তাঁরা কেউই হিবাকুশা হতে চাননি, চেয়েছিলেন আর দশজন স্বাভাবিক মানুষের মতোই সুন্দর একটা জীবন কাটাতে। কিন্তু ‘ফ্যাট ম্যান’ ও ‘লিটল বয়’ নামে দুটি অভিশাপ তছনছ করে দিয়েছিল তাঁদের সাজানো সংসার, সাজানো স্বপ্ন সহ সবকিছুই। তেমনই একজন হিবাকুশা সাচিকো ইয়াসুই। দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধ তার সর্বস্ব কেড়ে নিয়েছিল।
যুদ্ধের ফলে নাগাসাকিরও তখন জাপানের অন্য আর পাঁচটা শহরের মতো দুঃসহ অবস্থা। সাচিকোর মনে আছে, বিমান হামলার সাইরেন বাজার সঙ্গে সঙ্গেই গোটা পরিবারকে নিয়ে বাবা পাহাড়ের বুকে তৈরি গুহাগুলোর দিকে ছুটত। সাকামোতো সিমেট্রির কাছেই ছিল সেগুলো। ইচিরোর হাত ধরে সাচিকো ভেজা ঘাসের মধ্য দিয়ে ছুটত। তার গলায় ঝোলানো ব্যাগে রাখা বিস্কুটগুলো বারবার বুকে এসে আঘাত করত। গুহার প্রবেশপথে এসে মাথা নিচু করে ভিতরে ঢুকে যেত সাচিকো। গিয়েই উবু হয়ে বসে পড়ত। ভেজা খড়কুটো বিছানো মেঝের শীতল পরশ তাকে শিহরিত করে তুলত। আমেরিকান বি-২৯ বোমারু বিমানগুলো গুহার উপর দিয়ে গর্জন করে উড়ে যেত। আর গুহার ভিতরে সাচিকোর মাথার উপর তখন ভনভন করে উড়ত অজস্র মশা। কী ভয়ঙ্কর সেই দিনগুলো!
৮ আগস্ট, ১৯৪৫
সেই সকালটা আর পাঁচটা উষ্ণ, আর্দ্র গ্রীষ্মের দিনের মতোই ছিল। দরদর করে ঘামছিল মেয়েটি। জামাকাপড়ও ঘামে ভিজে একাকার। জুতো জোড়া পায়ে গলিয়ে ঘর থেকে বেরিয়ে এসেছিল সাচিকো। তাপে ঝলসে যাচ্ছিল সে। একই অবস্থা সাকামোতো সিমেট্রি, স্যানো শিন্তো মঠ, নাগাসাকি মেডিক্যাল কলেজ এবং পুরনো কর্পূর গাছগুলোর। উত্তপ্ত হচ্ছিল এশিয়ার সর্ববৃহৎ চার্চ হিসেবে খ্যাত উরাকামি ক্যাথেড্রাল এবং ছোট্ট দেজিমা দ্বীপ। যেখানে একসময় পা দিয়েছিল পর্তুগিজ বণিকরা। যখন জাপানের অন্যান্য এলাকার সঙ্গে বহির্বিশ্বের কোনও যোগাযোগ ছিল না, তখনও নাগাসাকির সঙ্গে বাণিজ্যিক সম্পর্ক ছিল পাশ্চাত্য দুনিয়ার।
হাঁটতে হাঁটতে স্যানো মঠের কাছাকাছিই চলে এসেছিল সাচিকো। কর্পূর গাছগুলো আর একটু দূরেই। গাছগুলো প্রায় পাঁচশো বছরের পুরনো। এই গাছগুলোর পিছনেই স্যানো মঠের বৃহদাকার, পাথুরে গেটটি। আধ্যাত্মিকতার চাদরে মোড়া এই জায়গায় দাঁড়িয়ে সাচিকো মনে মনে প্রার্থনা করল। ‘আবার যেন প্রথম শ্রেণীতে ভর্তি হতে পারি!’
গত এপ্রিলের কথা। চারদিকের পরিবেশ তখন চেরি ফুলের গন্ধে সুশোভিত। জাপানের স্কুলগুলোর নতুন শিক্ষাবর্ষ সবেমাত্র শুরু হয়েছে। সাচিকোকে নিয়ে তার বাবা জেনজা প্রাইমারি স্কুলে গিয়েছিলেন। বাবা তাকে বলেছিলেন, ‘স্যার-ম্যাডামদের কথা মেনে চলবে।’ কিন্তু বাবা আর সাচিকো যখন স্কুলে প্রবেশ করলেন, শিক্ষকদের চোখ-মুখে আতঙ্কের ছাপ। মার্কিন বিমান হামলার মাত্রা বেড়ে গিয়েছিল। বিমান হামলার সাইরেনের জন্য সেদিন সকালেও স্কুল বন্ধ রাখতে হয়েছিল। সাচিকো শুধুমাত্র তার নতুন শিক্ষকের সামনে মাথা নোয়াতে পেরেছিল। এরপরই প্রিন্সিপাল স্কুল বন্ধ করে দেওয়ার ঘোষণা করেন। সাচিকোর প্রথম শ্রেণীতে ভর্তির স্বপ্ন সেখানেই মিলিয়ে যায়। পড়াশোনা শেখার বদলে সে শিখেছিল আঙুল দিয়ে কান এবং চোখগুলো ঢেকে রাখতে। সেই সঙ্গে শিখেছিল বাইরে থাকাকালে ‘টেকি’ (শত্রুপক্ষের বিমান) শব্দটি শুনলে সঙ্গে সঙ্গে মাটিতে শুয়ে পড়ার বিদ্যা!
৯ আগস্ট, ১৯৪৫
সবেমাত্র ঘুম ভেঙেছে সাচিকোর। অসুস্থ এক বন্ধুর খোঁজ নিতে বাবা তাড়াতাড়িই বের হয়ে গিয়েছিলেন সেদিন। মা রান্নাঘরে গমের বল বানাচ্ছিলেন। মাকে কেমন আতঙ্কিত লাগছিল। কিছুক্ষণ পর মা ডাক দিলেন, ‘বাচ্চারা, এস, তাড়াতাড়ি খেয়ে নাও।’ সকাল ৭টা ৫০ মিনিট। হঠাৎ বিকট এক শব্দে মা মাথা তুলে চাইলেন। ‘বাচ্চারা, তাড়াতাড়ি’, এটুকু বলেই মা তোশিকে কোলে তুলে নিলেন। সাচিকো তার হুডটা খুঁজতে দৌড় দিল। আকি মিসাকে তার হুড খুঁজে দিল। সাচিকোর হাতটা ধরল ইচিরো। থেমে থেমে বাজতে থাকল সাইরেন। সাচিকোর পরিবার আবারও ছুটল সেই গুহাগুলোর দিকে। মাথা নিচু করে গুহার ভিতর ঢুকে স্যাঁতস্যাঁতে মাদুরের উপর বসে পড়ল সাচিকো। সকাল ৮টা বেজে ৩০ মিনিট। সাইরেন থেমে গেল। পরিচিত আরেকটি সাইরেনের শব্দ সবাইকে বুঝিয়ে দিল, বিপদ কেটে গিয়েছে। গুহা থেকে বেরিয়ে এল সবাই। তোশির হাত ধরে রেখেছিলেন মা। ফের মুরগির ডিম খুঁজতে তিনি বেরিয়ে পড়লেন।
কিন্তু পরিকল্পনা খানিকটা অন্যরকমই ছিল বি-২৯ বোমারু বিমান ‘বক্সকার’-র ককপিটে থাকা মেজর চার্লস সোয়েনির। প্লেনটিতে ছিল প্লুটোনিয়ামের তৈরি ‘ফ্যাট ম্যান’ নামে একটি পারমাণবিক বোমা। যার ধ্বংসাত্মক ক্ষমতা ছিল ২১ হাজার টন টিএনটির সমতুল। সোয়েনির প্রধান লক্ষ্য ছিল শিল্পনগরী কোকুরা। যদি কোনও কারণে কোকুরার মিশন ব্যর্থ হয়, তাহলে তালিকায় পরের নামটি ছিল নাগাসাকি।
সকাল ৯টা বেজে ৪৫ মিনিট। বক্সকারকে নিয়ে কোকুরা শহরের উপর দিয়ে নিরাপদেই উড়ে গেলেন ক্যাপ্টেন সোয়েনি। কিন্তু হঠাৎই বাতাসের বেগ বেড়ে গেল। শুরু হল ঘন মেঘের চলাচলও। সেই মেঘরাশি সোয়েনির চোখ আবছা করে দিল। সোয়েনি কোকুরার উপর দিয়ে দ্বিতীয়বার চক্কর দিলেন। জাপানি অ্যান্টি এয়ারক্রাফট গানগুলো ততক্ষণে গোলাগুলি শুরু করে দিয়েছে। সোয়েনি তৃতীয়বার চক্কর দিলেন। বিমানের ক্রু’রা শঙ্কিত হয়ে পড়লেন। সকালে উড়ানের সময় ফুয়েল পাম্পটা ঠিকমতো কাজ করছিল না, প্রয়োজনের তুলনায় কম তেল নিয়ে যাত্রা শুরু করেছিলেন এবং সময়ও ফুরিয়ে আসছিল বেশ দ্রুত। দ্রুততার সঙ্গে অবশিষ্ট জ্বালানি নিয়ে একটা হিসাব কষে ফেললেন সোয়েনি। তালিকায় থাকা পরবর্তী নগরী নাগাসাকিতে যাওয়ার মতো পর্যাপ্ত জ্বালানি তখনও ছিল। সোয়েনি প্লেন ঘুরিয়ে নাগাসাকির পথ ধরলেন। সকাল ১১টা বাজার কয়েক সেকেন্ড পরই বক্সকার নীচের দিকে নামতে শুরু করল। উপর থেকে নাগাসাকিকেও ঠিকমতো দেখা যাচ্ছিল না। পুঞ্জ পুঞ্জ মেঘ নগরীটি ঢেকে রেখেছিল। বক্সকারের টার্গেট ছিল পোতাশ্রয়ে থাকা মিৎসুবিশি শিপইয়ার্ড। কিন্তু উপর থেকে সেটা তারা ঠিকমতো দেখতে পাচ্ছিলেন না। হঠাৎ করেই একখণ্ড মেঘ সরে গেল। ফলে নাগাসাকির ঘনবসতিপূর্ণ উরাকামি উপত্যকা বক্সকারের ক্রুদের কাছে উন্মুক্ত হয়ে গেল। টার্গেট থেকে মাত্র ১ মাইল দূরে। চিৎকার করে উঠলেন সোয়েনি, ‘খুঁজে পেয়েছি, খুঁজে পেয়েছি’। সঙ্গে সঙ্গে নিশানা করে সুইচে চাপ। নাগাসাকির উদ্দেশে ধেয়ে গেল ফ্যাট ম্যান।
সকাল ১১টা বেজে ১ মিনিট। দশ বছর বয়সি মেয়েটি হঠাৎ করেই ভয়ে পাথরের মতো জমে গেল। ‘টেকি’ বলে চিৎকার করে উঠল সে। সঙ্গে সঙ্গেই মাদুরের উপর উপুড় হয়ে গেল সাচিকো। সকাল ১১টা ২ মিনিট। অতি উজ্জ্বল আলো, প্রচণ্ড শব্দে কেঁপে উঠল গোটা নাগাসাকি। অদ্ভুত, চোখধাঁধানো এক আলো আকাশজুড়ে। লাল, নীল, সবুজ- হরেক রকমের রং। নাগাসাকির আকাশে, প্রায় ৩.২ কিলোমিটার উপরে, ধীরে ধীরে জমাট বাঁধল একটি পারমাণবিক মেঘ। দেখতে অনেকটা বৃহদাকার মাশরুমের মতো। খানিক বাদেই আগুন চারদিকে ছড়িয়ে পড়ল। ছাদের টাইলসগুলো পুড়ে গেল। ল্যাম্পপোস্টগুলো গলে নুয়ে পড়ল। একসময় সেই মেঘ পুরো আকাশটাকেই ছেয়ে ফেলল। ধূসররঙা, মোটা কম্বলের মতো ঢেকে দিল সূর্যটাকে। নাগাসাকির বুকে ভরদুপুরে নেমে এল রাতের অন্ধকার। সাচিকোকে কে যেন শূন্যে ছুঁড়ে দিয়েছিল। পরক্ষণেই আবার সজোরে মাটিতে আছড়ে পড়েছিল সে। পাথরের টুকরো, ভাঙা টাইলস, গাছের ডাল-পাতা— সবকিছু তার উপর একে একে পড়তে লাগল। ক্রমশ এগুলোর নীচে চাপা পড়তে লাগল সে। নাকে-মুখে ধুলোবালি ঢুকে গিয়েছিল তার। বিস্ফোরণের কেন্দ্রস্থল থেকে মাত্র ৯০০ মিটার দূরে মাটিতে পড়ে কাঁপতে লাগল মেয়েটি। প্রবল হাওয়ায় বৈদ্যুতিক তারগুলো ছিড়ে গিয়েছিল। দুমড়ে-মুচড়ে গিয়েছিল রাস্তায় থাকা গাড়িগুলো। কাচ ভেঙে গিয়েছিল জানালার। কব্জা ভেঙে বেরিয়ে এসেছিল অনেক দরজা। উল্টে পড়েছিল অনেক ঘরবাড়ি। ভাঙা কাচের টুকরাগুলো বাতাসে বুলেটের মতোই এদিক ওদিকে ছুটে যাচ্ছিল। নাগাসাকি মেডিক্যাল কলেজ ধ্বংস হয়ে গিয়েছিল। ভেঙে পড়েছিল উরাকামি ক্যাথেড্রাল। ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছিল স্যানো মঠও। আগুনে পুড়ে কালো হয়ে যাওয়া কর্পূর গাছগুলো দাঁড়িয়ে সাক্ষ্য দিচ্ছিল, কী ভয়াবহ ঝড়টাই না বয়ে গিয়েছে তাদের উপর দিয়ে।
এরপর তছনছ হয়ে যাওয়া জীবন নিয়ে সাচিকোর কেটে গিয়েছে কয়েক দশক। পারমাণবিক বোমা হামলার দুঃসহ স্মৃতি, নিজের ভিতরে চেপে রাখা কষ্ট। এই সবকিছু নিয়েই সাচিকো কথা বলা বন্ধ করে দিয়েছিলেন। ঘুরঘুরে পোকার মতো সে পুষ্টিদ্রব্য সংগ্রহ করত বাবার জ্ঞানের শিকড় থেকে। হেলেন কেলারের সাহস থেকে। এবং ভালোবাসা, অহিংসা ও ন্যায়বিচারের প্রতীক গান্ধীজি ও মার্টিন লুথার কিং জুনিয়রের বিশ্বাস থেকে। ১৯৯৫ সালের ৯ আগস্টের পর থেকে সাচিকো ইয়াসুই জাপান ছুটে বেড়িয়েছেন। গিয়েছেন কানাডা এবং আমেরিকাতে। হাজার হাজার শিক্ষার্থীর সঙ্গে নিজের অভিজ্ঞতা ভাগ করে নিয়েছেন, বিভিন্ন বিশ্ববিদ্যালয়ে লেকচার দিয়েছেন, বিভিন্ন রেডিও, টেলিভিশন ও সংবাদপত্রে দিয়েছেন সাক্ষাৎকার। সাচিকোর জীবনটা যেন ‘ওলিয়েন্ডার’-এর মতো।
আসলে পরমাণু হামলার পর জাপানের মাটিতে প্রথম ফুটেছিল ওলিয়েন্ডার (করবী ফুল)। যা ঢেকে দিয়েছিল গত শতাব্দীর কলঙ্ক! সাচিকো ছিলেন নাগাসাকির ওলিয়েন্ডার।
সহযোগিতায় স্বাগত মুখোপাধ্যায়
ছবি সংশ্লিষ্ট সংস্থার সৌজন্যে