বিদ্যার্থীদের বেশি শ্রম দিয়ে পঠন-পাঠন করা দরকার। কোনও সংস্থায় যুক্ত হলে বিদ্যায় বিস্তৃতি ঘটবে। কর্মপ্রার্থীরা ... বিশদ
পরবর্তী সময়ে এই প্রবণতা ধীরে ধীরে কমতে থাকে। সবথেকে বেশি কাহিনী যাঁর থেকে পাওয়া সম্ভব ছিল, সেই ইন্দিরা গান্ধী নিজে সেভাবে লেখালেখি করলেন না। তাঁর একাধিক বায়োগ্রাফি প্রকাশিত হল বটে। কিন্তু নিজের লেখার মূল্য অনেক গুরুত্বপূর্ণ। যতই নতুন ভারত এসেছে, ততই এই রাজনীতিবিদদের অন্তহীন চিঠি লেখা কিংবা বই প্রকাশ হওয়ার প্রবণতা কমেছে। লালকৃষ্ণ আদবানি এবং প্রণব মুখোপাধ্যায় শেষ এরকম শীর্ষনেতা, যাঁদের গ্রন্থ ইতিহাসকে বুঝতে ও জানতে সাহায্য করে। এছাড়া যশবন্ত সিনহা, যশবন্ত সিং, অরুণ শৌরি, নটবর সিংরাও লিখেছেন আত্মজীবনী। কিন্তু সমকালীন রাজনীতি, সমাজ, কর্পোরেট মহল, ক্রিকেটের অন্দরমহল, হাই প্রোফাইল পার্টির আলাপচারিতার প্রচুর অজানা কাহিনীর ভাণ্ডার যাঁর কাছে পাওয়া সম্ভব ছিল, সেই ভারতীয় রাজনীতির সর্বশেষ কালারফুল ব্যক্তিত্বের এভাবে অসময়ে চলে যাওয়া এক অর্থে ইতিহাস চর্চার ক্ষতি করে দিয়ে গেল। অরুণ জেটলি নিজেও লিখতে ভালোবাসতেন। কিন্তু সমস্যা হল তিনি ব্লগ লিখতেন। এবং সেখানে সিংহভাগ ক্ষেত্রেই স্থান করে নিয়েছিল দলীয় রাজনীতির সমীকরণ। অথচ যাঁরা জেটলিকে চেনেন এবং যে সাংবাদিককুল তাঁর সঙ্গে নিয়মিত দেখা করার সুযোগ পেয়েছেন তাঁরাই জানেন, তিনি ছিলেন এক অফুরন্ত কাহিনীর উৎস। জেটলি নির্ঘাৎ ভেবে রেখেছিলেন যে, তিনি কখনও না কখনও অবশ্যই আত্মজীবনী কিংবা মেমোয়ার্স লিখবেন। কিন্তু মাত্র ৬৬ বছর বয়সে কেন? তাঁর ইনিংস তো আরও লম্বা! সুতরাং পরেই না হয় লেখা হবে! তিনি সেই লক্ষ্যে মেটেরিয়ালসও সংরক্ষণ করে রাখছিলেন। কিন্তু অকস্মাৎ একটি সাংঘাতিক বিস্ময়কর অসুস্থতা এবং তজ্জনিত মৃত্যু তাঁর পরিবার কিংবা রাজনীতির যে ক্ষতি করেছে, তার থেকে কোনও অংশে কম ক্ষতি হল না ভারতের ইতিহাস চর্চার। কারণ জেটলির সেই সম্ভাব্য বই থেকে ভারতের বদলে যাওয়া সমাজ, নাগরিক সংস্কৃতি, হাই প্রোফাইল জীবন, রাজনীতির গুরুত্বপূর্ণ বাঁকবদলের পিছনের আনটোল্ড স্টোরির মোড়কে অসংখ্য আকর্ষণীয় কাহিনী পেতাম আমরা। ভারতীয় ক্রিকেট টিম সিলেকশনের সময় কীভাবে বিভিন্ন জোনের মধ্যে দড়ি টানাটানি হয়, অথবা কোনও একজন প্লেয়ারের ব্যক্তিগত দুর্বলতা কী, বা লন্ডনের কোন পার্টিতে গিয়ে ভারতের এক দাপুটে রাজনীতিক কিংবা কর্পোরেট কর্তা নাস্তানাবুদ হলেন কোনও ইস্যুতে, সুপ্রিম কোর্টের উচ্চকোটির আইনজীবীদের কাদের শখ কেমন, কোন বিচারপতি ভারত কাঁপানো রায় দেওয়ার আগে বা পরে কেমন আচরণ করলেন ইত্যাদি হাজারো গল্প ছিল তাঁর ঝুলিতে। সিনেমা, রাজনীতি, সুপ্রিম কোর্ট, ক্রিকেট, লেটেস্ট ফ্যাশনের ঘড়ি অথবা পেন, দিল্লির চাঁদনি চক কিংবা লখনউতে কাইসারবাগের কোন গলির দোকানে বিশ্বের শ্রেষ্ঠতম কাবাব পাওয়া যায় ইত্যাদি—জীবনের প্রতিটি মাঠেই অনায়াস বিচরণকারী এরকম এক রাজনীতিবিদ ভারতীয় রাজনীতির জগতে আর একজনও রইলেন না।
অসম্ভব মানুষ চেনার ক্ষমতা ছিল জেটলির। কিলার ইনস্টিঙ্কট বলা যেতে পারে। মনে পড়ছে ২০০৬ সালের এক সন্ধ্যার কথা। ১১ নং অশোক রোডে প্রাত্যহিক সাংবাদিকদের সঙ্গে হাল্কা মেজাজে গল্পগুজবের সময় সদ্য তাঁর সঙ্গে দেখা করে বেরনোর পর একজন তরুণ দিল্লির ক্রিকেটার সম্পর্কে জেটলি বলেছিলেন, ‘ইস লড়কে কে অন্দর দম হ্যায়... ইয়ে অগর থোড়া ডিসিপ্লিনড হো যায়ে, ইসে রোকনা মুশকিল হ্যায়... বহোৎ দূর যায়েগা ইয়ে...।’ সেই তরুণ ক্রিকেটারের নাম বিরাট কোহলি! সবথেকে গুরুত্বপূর্ণ হল, জেটলি তাঁর জীবনের প্রতিটি প্যাশনকেই একেবারে অন্তর থেকে ভালোবাসতেন। সুপ্রিম কোর্টের বার কাউন্সিল থেকে সংসদের করিডর, ক্রিকেট প্রশাসনের সর্বোচ্চ সিদ্ধান্তগ্রহণের বৈঠক থেকে মুকেশ আম্বানির সঙ্গে ব্রডওয়ের থিয়েটার দেখতে যাওয়া। জীবনের প্রতিটি মুহূর্তকেই তিনি উপভোগ করতেন প্রাণ থেকে।
২০০২ সালের এপ্রিলে গোয়ায় বিজেপি এগজিকিউটিভ কমিটির বৈঠক। গোটা দেশের মিডিয়া আর রাজনীতির নজর সেদিকে। কারণ একটাই। সেই বৈঠকে গুজরাত দাঙ্গা আলোচিত হয় কি না। আর হলেও কী মনোভাব নেওয়া হবে গুজরাতের মুখ্যমন্ত্রী সম্পর্কে। গোটা ঘটনায় অটলবিহারী বাজপেয়ি ছিলেন অত্যন্ত আপসেট। গোয়া যাওয়া হচ্ছিল এয়ারফোর্সের বিশেষ বিমানে। একসঙ্গে প্রধানমন্ত্রী বাজপেয়ি এবং উপপ্রধানমন্ত্রী লালকৃষ্ণ আদবানি যাচ্ছেন। তাঁদের সঙ্গে একটি আসনে রয়েছেন যশবন্ত সিং এবং অন্য আসনে অরুণ শৌরি। বাজপেয়ি কোনও কথা বলছেন না। চুপ করে জানালার বাইরে তাকিয়ে। আদবানি নীরবতা ভঙ্গ করে বললেন, ‘অটলজি আপনি কী ভাবছেন?’ অটলবিহারী বাজপেয়ি ম্লান হেসে বললেন, ‘কমসে কম ইস্তিফা তো অফার কর সকতে...।’ এটা গুজরাতের মুখ্যমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদিকে লক্ষ্য করে। দেশজুড়ে গুজরাত দাঙ্গায় মোদিকে টার্গেট করে তীব্র আক্রমণ করা হচ্ছে তখন। স্বয়ং বাজপেয়িই বলেছেন, রাজধর্ম পালন করা উচিত ছিল। আদবানি ওই কথা শুনে বললেন, ‘মোদি ইস্তফা দিলেই কি সব সমস্যার সমাধান হয়ে যাবে? যদি আপনি তা মনে করেন আমি নিজেই মোদিকে বলব ইস্তফা দিতে। যদিও আমি জানি না পার্টির নেতাকর্মীরা এটা মেনে নেবে কি না।’ সেইমতো আদবানি সেদিনই গোয়া পৌঁছে মোদিকে বললেন বিষয়টি। নরেন্দ্র মোদি শুনলেন এবং আলোচনাও করলেন। তাঁকে তাঁর অনেক পুরনো এক সঙ্গী বললেন, এটাই সবথেকে বড় সুযোগ সাধারণ পার্টিকর্মী বা নেতাদের মধ্যে আপনার কতটা জনপ্রিয়তা, সেটা জনসমক্ষে প্রমাণ করার। আর আপনি যে ক্ষমতা ধরে রাখতে মরিয়া নয়, বরং গুজরাতই চায় আপনাকে—এই বার্তাও দেওয়া দরকার। মোদি ন্যাশনাল এগজিকিউটিভ বৈঠকে ঘোষণা করলেন তিনি ইস্তফা দিতে চান। আর তৎক্ষণাৎ গোটা সভা তুমুলভাবে চিৎকার করে প্রতিবাদে ফেটে পড়ে। ‘ইস্তফা মাত দো... ইস্তফা মাত দো...।’ প্রমোদ মহাজন উঠে গিয়ে মাইক টেনে নিয়ে বললেন, ‘আপনার ইস্তফা দেওয়ার প্রশ্নই ওঠে না।’ এই স্লোগানে গোটা শীর্ষ নেতৃত্ব তখন বসে বসে দেখছেন, পার্টির অন্দরে মোদির জনপ্রিয়তা কতটা। সঠিক সময়ে সঠিক পরামর্শ দেওয়া সেই সঙ্গীর নাম অরুণ জেটলি। তিনি তখনই বুঝেছিলেন যে গোটা দেশে একজন নতুন নেতা আসতে চলেছেন। এবং সঠিকই বুঝেছিলেন। কারণ মোদির জনপ্রিয়তা তখন দেশের বিভিন্ন প্রান্তে উদীয়মান। মোদিও জেটলিকে সম্মান করতেন। প্রথমত ১৯৮৬ সালে লালকৃষ্ণ আদবানি যখন প্রথম বিজেপির সভাপতি হলেন, তিনি এসেই ঠিক করেছিলেন, একঝাঁক তরুণ রক্ত আনবেন দলে। সেইমতো তিনি বাছাই করে বিজেপির অন্দরে এনেছিলেন একটি স্বপ্নের টিম। সুষমা স্বরাজ, অরুণ জেটলি, নরেন্দ্র মোদি, বেঙ্কাইয়া নাইডু, রাজনাথ সিং, কে এন গোবিন্দাচারিয়া। প্রত্যেকেই যুবক। প্রত্যেকেই দুর্দান্ত বাগ্মী এবং জনপ্রিয়। সেই টিম কতটা শক্তিশালী তা পরবর্তী ভারত দেখেছে। সুতরাং সেই তখন থেকেই গোটা টিমের মধ্যে মোদি লক্ষ্য করে এসেছেন দিল্লির সেন্ট জেভিয়ার্স, শ্রীরাম কলেজ অব কমার্স, দিল্লি ইউনিভার্সিটি হয়ে সুপ্রিম কোর্টের করিডরে ঘোরাফেরা করা জেটলি বাকি সকলের থেকে আলাদা। ধীরস্থির, ঠান্ডা মাথা, বিশ্লেষণ ক্ষমতা অসাধারণ। সুতরাং একইসঙ্গে রাজনীতিতে উঠে এলেও জেটলি প্রথম থেকেই হয়ে উঠলেন মোদির অন্যতম পরামর্শদাতা। সেই প্রবণতা ছিল ২০১৪ সালে মোদির ক্ষমতায় আরোহণ পর্যন্ত। এবং ঠিক ওই ইনস্কিঙ্কট এসেছিল ২০০৯ সালের পর। যখন দ্বিতীয়বারও ইউপিএর কাছে পরাজিত হল বিজেপি। অরুণ জেটলি সম্ভবত প্রথম ও দ্রুত উপলব্ধি করেছিলেন যে, লালকৃষ্ণ আদবানি ডঃ মনমোহন সিংয়ের বিকল্প হিসেবে দেশজুড়ে জনমনের আগ্রহে পরিণত হতে পারবেন না। এবং ডঃ মনমোহন সিংয়ের সম্পূর্ণ বিপরীতধর্মী কোনও স্ট্রং লিডার হয়তো একমাত্র ট্রাম্প কার্ড হতে পারেন। কারণ কংগ্রেসের সবথেকে বড় সঙ্কট আগামীদিনে যে লিডারশিপই হতে চলেছে, সেটা বুঝতে পেরেছিলেন তিনি। আর এখানেই এক বিস্ময়কর কাজ করলেন জেটলি। তিনি নিজেকে সরিয়ে নিলেন বিজেপির পরবর্তী প্রজন্মের সর্বোচ্চ নেতা হওয়ার দৌড় থেকে। জেটলি সর্বদাই কিং মেকার হওয়ায় আগ্রহী ছিলেন। নিজে কিং হতে চাননি। কারণ তিনি নিজের ওই সামগ্রিক এনজয়েবল জগৎটিকে তাহলে মিস করতেন। এবং অঙ্ক কষে দেখলেন যে, একমাত্র এক শক্তিশালী দেশনায়কের মেন্টর তথা গাইড হওয়া অনেক ভালো। তাই তাঁর মনে ফের এল একটি নাম। যাঁকে বিজেপির প্রধানমন্ত্রী পদপ্রার্থী করা যায়। ২০১৩ সালেই বিজেপি ন্যাশনাল এগজিকিউটিভ বৈঠকে সামনে এল সেই নাম। মাস্টারস্ট্রোক। গোটা পার্টির সাধারণ নেতাকর্মীদের মধ্যে যেন ইলেকট্রিকের চমক লাগল। আলোড়ন পড়ে গেল দলে এবং গোটা দেশে। অরুণ জেটলির স্ট্র্যাটেজি আবার নিখুঁত প্রমাণ হল। আদবানি সমাপ্ত। বিজেপি প্রবেশ করল মোদিযুগে!
* * *
প্রতিরক্ষামন্ত্রী মনোহর পারিক্করের ফোন বাজছে রাত ১২টায়। ডিসেম্বরের প্রথম সপ্তাহ। ২০১৪। দিল্লিতে প্রবল শীত। মনোহর পারিক্করের ফোন তাঁর পুত্র ধরেছেন। বললেন, ‘বাবা তো ঘুমিয়ে পড়েছে।’ ‘আমি সুষমা আন্টি বলছি বেটা! মনোহর ভাইকে একটু ডাকতেই হবে। ইটস আর্জেন্ট!’ ঘুম চোখে উঠে ফোন ধরলেন মনোহর পারিক্কর। ‘সুষমাজি বলুন! সব ঠিক আছে তো!’ উদ্বেগ তাঁর কণ্ঠে। বিদেশমন্ত্রী সুষমা স্বরাজ বললেন, ‘মনোহর ভাই শুনিয়ে! জরুরি কথা। আমার এয়ারফোর্সের একসঙ্গে বেশ কয়েকটা কার্গো এয়ারক্র্যাফট চাই। ইন্টারন্যাশনাল ফ্লাই করতে হবে।’ মনোহর পারিক্কর বিস্মিত! ‘কেন?’ সুষমা জানালেন একটু আগেই মালদ্বীপের হাইকমিশনার ফোন করে জানালেন, মালের সেন্ট্রাল ওয়াটার রিজার্ভার বার্স্ট করেছে। গোটা মালে জলহীন। ওরা ইন্ডিয়ার হেল্প চাইছে। ‘ইউ আন্ডারস্ট্যান্ড মনোহর! উই মাস্ট রিচ দেয়ার বিফোর চায়না!’ এবার নড়েচড়ে বসলেন পারিক্কর। এটা একটা সাংঘাতিক পয়েন্ট। চীন নিশ্চয়ই ঝাঁপিয়ে পড়বে মালদ্বীপকে খুশি করতে। তিনি সঙ্গে সঙ্গে বললেন, ‘সুষমাজি আমরা আগে রিচ করবই।’ ব্যস! সারারাত ধরে গোটা ভারত যখন গভীর ঘুমে নিমগ্ন, ভারত সরকারের বিদেশ ও প্রতিরক্ষামন্ত্রক অপারেশন শুরু করল। যার নাম অপারেশন নীর। ৪০ টন পানীয় জল নিয়ে প্রথম এয়ারফোর্স কার্গো ফ্লাইট উড়ে গেল ভোর পাঁচটায়। দুপুরে আরও একটি। সন্ধ্যার মধ্যে মালদ্বীপে ৪০০ টন জল ভারত। আর চীনের থেকে প্রথম ফ্লাইট জল নিয়ে মালদ্বীপে ল্যান্ড করেছিল ৭ ডিসেম্বর। ভারত অনেক আগেই জিতে গিয়েছিল ওই কূটনীতির লড়াইয়ে। সুষমা স্বরাজের মধ্যে ছিল এই বিরল প্রতিভা। তিনি একদিকে ছিলেন দক্ষ প্রশাসক, সফল এক কূটনীতিক। আবার একইসঙ্গে ছিলেন শিক্ষিত স্মার্ট আধুনিক সনাতন ভারতীয় নারীর এক কপিবুক ফ্যাশন স্টেটমেন্ট। সনাতন, আধুনিক, স্মার্ট এসব শব্দকে যদি পরস্পরবিরোধী মনে হয়, তাহলে লক্ষ্য করতে হবে সুষমা স্বরাজের জার্নিকে। কারণ তাঁর এই ভারসাম্য রক্ষা কি রাজনীতির ময়দানে পা রাখার পর থেকে? একদমই নয়। এই ভাবমূর্তি যেন ছিল সহজাত। তাই স্কুল শেষ করে কুরুক্ষেত্র বিশ্ববিদ্যালয়ে স্নাতক স্তরে তিনি যখন পড়তে গেলেন, তখন একইসঙ্গে পড়লেন সংস্কৃত আর পলিটিক্যাল সায়েন্স। সুষমা শর্মা কবে ফ্রি থাকবে, সেটা দেখেই ইন্টার কলেজ ডিবেট কম্পিটিশনের তারিখ ধার্য করা হতো সেই সময়। কারণ সুষমা শর্মা যে বিতর্কসভায় থাকবে না, সেই বিতর্কসভা ম্লান। এহেন এক দুর্ধর্ষ বক্তা তরুণীর মধ্যে আগুনের স্ফুলিঙ্গ দেখলেন জয়প্রকাশ নারায়ণ। সুষমা শর্মার পিতা আরএসএসের কর্মী। সুতরাং ওই আবহেই তাঁর বড় হওয়া। জয়প্রকাশ নারায়ণ লালকৃষ্ণ আদবানিকে বলেছিলেন, ‘আদবানিজি ওই যে হরিয়ানার মেয়েটি প্রচার করেছিল, ওকে আপনারা প্রোমোট করুন। মেয়েটি কিন্তু আগামীদিনের লিডার। আর ওঁকেই আপনারা প্রার্থী করুন হরিয়ানায়। কারণ রাজ্যে রাজ্যে ভালো নেতানেত্রী থাকা দরকার।’ জয়প্রকাশ নারায়ণের সেই উপদেশ মেনে নিয়েছিলেন আদবানি। সুষমা হরিয়ানার সবথেকে কমবয়সি মন্ত্রী হয়ে গেলেন চৌধুরী দেবীলালের সরকারে। সেই শুরু। আদবানির টিমে চলে আসা সুষমা স্বরাজ কেন অপ্রতিদ্বন্দ্বী হয়ে উঠলেন? কারণ তাঁর মধ্যে একজন স্টেটসম্যান হয়ে ওঠার সমস্ত গুণ ছিল। একেবারে তরুণ বয়স থেকেই প্রশাসন সামলেছেন। তাই ভারত সরকারের তথ্য ও সম্প্রচার মন্ত্রী হওয়া কিংবা বিদেশমন্ত্রীর পদ সামলানো তাঁর কাছে কোনও ব্যাপারই নয়। সবথেকে বড় কথা হল বিদেশমন্ত্রী হিসেবে তিনি বেমানান, এই ভাবমূর্তি তাঁর ছিল না। যেটা আজকের ভারত সরকারের অনেককে পর্যবেক্ষণ করে অথবা তাঁদের কার্যকলাপ প্রত্যক্ষ করে মনে হয় যে সঠিক মানুষ বোধহয় সঠিক আসনে নেই। অরুণ জেটলি অথবা সুষমা স্বরাজরা নিজেদের রাজনৈতিক স্কুলিং এতটাই উঁচু তারে বেঁধেছিলেন যে, তাঁরা যখন লোকসভা ও রাজ্যসভায় বিরোধী দলনেতা ও দলনেত্রী হয়েছিলেন, কয়েকমাসের মধ্যেই গোটা দেশের রাজনৈতিক শক্তি বুঝে গিয়েছিল, বিজেপির এই দুই শক্তিশালী তারকার কাছে ইউপিএ সরকারের রাজনৈতিক ম্যানেজাররা মোটেই টেক্কা দিতে পারছেন না। এর কারণ একটাই। অরুণ জেটলি ও সুষমা স্বরাজ দুজনেই ছিলেন অসামান্য বক্তা।
নেতানেত্রীদের বয়সের কারণে কিংবা অবসরের পর একটি দল সামান্য হলেও দুর্বল হয়ে যায় এটা নিয়ে সংশয় নেই। সব দলের ক্ষেত্রেই প্রযোজ্য। কিন্তু অরুণ জেটলি আর সুষমা স্বরাজের চলে যাওয়ার পর বিজেপির ইমেজের যে অভাববোধ হবে সেটা অপূরণীয়। সুষমা ও জেটলি দু’জনের সবথেকে বড় বৈশিষ্ট্য, তাঁরা ছিলেন বিপক্ষের সঙ্গে সম্পর্কের সেতু। এমন কোনও নেতানেত্রী ভারতীয় রাজনীতিতে নেই, যাঁদের সঙ্গে এই দু’জনের সুসম্পর্ক ছিল না। প্রতিপক্ষকে সম্মান করে, তাঁদের কথা শোনা এবং যথাযোগ্য শ্রদ্ধা সমীহ করেই আলোচনার রাস্তা খোলায় এই দু’জনের কোনও বিকল্প নেই। বিজেপির মতো একটি হিন্দুত্ববাদী দলের শীর্ষ স্তরে থেকেও এই দু’জন কোনওদিন হিন্দু নেতানেত্রী হয়ে উঠলেন না। অরুণ জেটলির মধ্যে নরেন্দ্র মোদির ছায়া পড়ল না। সুষমা স্বরাজের মধ্যে ছিল না উমা ভারতীর প্রতিফলন! এমন এক বিস্ময়কর ব্যক্তিগত ব্যক্তিত্বময়তায় তাঁরা বাস করতেন যেন মনে হতো যে, কোনও দলেই তাঁদের অবস্থান মানিয়ে যাবে। অটলবিহারী বাজপেয়ি মৃত্যুর বহুদিন আগেই জনসমক্ষ থেকে সরে গিয়েছিলেন। অসুস্থ হয়ে ঘরবন্দি ছিলেন। বিজেপির অন্দরে তাঁর কোনও প্রভাবই আর ছিল না। কিন্তু বাজপেয়ি প্রবলভাবে উপস্থিত ছিলেন তাঁর দুই শিষ্যের মধ্যে। অপ্রত্যক্ষ হয়েও বাজপেয়ি যেন বিজেপির অন্দরে দীপ্যমান ছিলেন অরুণ জেটলি ও সুষমা স্বরাজের ভাবমূর্তি ও রাজনৈতিক অ্যাপ্রোচের মধ্যে দিয়ে। অর্থাৎ সকলকে সঙ্গে নিয়ে চলার রাজনীতি। এই দু’জন অকালে চলে যাওয়ায় প্রকৃতই শুরু হল এক নতুন অধ্যায়। বিজেপির ভাবমূর্তি থেকে অবশেষে অন্তর্হিত হল বাজপেয়ি ঘরানার শেষ প্রতীকদ্বয়! এখন নতুন বিজেপি। যেখানে প্রতিপক্ষের সঙ্গে সেতুবন্ধনের প্রয়োজন নেই! কারণ নতুন বিজেপির গুপ্ত ধ্রুবপদ—ওয়ান নেশন, ওয়ান পার্টি!
.............................................
ছবি : এএফপি, পি টি আই
গ্রাফিক্স : সোমনাথ পাল
সহযোগিতায় : উজ্জ্বল দাস