বিদ্যার জন্য স্থান পরিবর্তন হতে পারে। গবেষণামূলক কাজে সাফল্য আসবে। কর্মপ্রার্থীরা কোনও শুভ সংবাদ পেতে ... বিশদ
প্রত্যেক মানুষের মধ্যেই থাকে কোনও না কোনও গুণ আর সেই গুণ বিভিন্ন প্রয়োজনে ও পরিস্থিতিতে একেক রূপে প্রকাশিত হয়। জ্ঞানের দ্বারা সকল প্রকার কার্যসিদ্ধির জন্যই আমরা বাগদেবী সরস্বতীর সাধনা করে থাকি।
ধ্যান ও প্রণামমন্ত্র অনুসারে দেবী সরস্বতী শ্বেতবর্ণা, শ্বেতপদ্মাসনা, শ্বেতবস্ত্রাবৃতা, দ্বিভূজা, বীণা-পুস্তকধারিণী, হংসরূঢ়া রূপে পূজিতা হলেও বেদ-বেদাঙ্গ-বেদান্ত তথা সকল জ্ঞানের আধার। মা সরস্বতী বিভিন্ন পুরাণ, বেদ, তন্ত্রে বিচিত্র লীলাময়ীরূপে বর্ণিত হয়েছেন। দেবীর প্রতিটি রূপের আলাদা আলাদা তাৎপর্য আছে।
ঋগ্বেদে বাগদেবীর তিনটে মূর্তির কথা বলা হয়েছে, ভূঃ বা ভূলোকে ইলা, ভূবঃ বা অন্তরীক্ষে সরস্বতী এবং স্বর বা স্বর্গলোকে ভারতী। জগতে দেবী সরস্বতী তার জ্ঞানজ্যোতি দ্বারা চিন্ময়ীরূপে পরিব্যপ্ত।
বৈদিক স্তুতির মধ্যে দেবী সরস্বতীর তিনটি রূপের প্রকাশ লক্ষ্য করা যায়। কোথাও ‘দেবীতমে’ অর্থাৎ দেবী শ্রেষ্ঠা, কোথাও ‘অম্বিতসে’ অর্থাৎ মাতৃশ্রেষ্ঠা, আবার কোথাও ‘নদীতসে’ বা নদী শ্রেষ্ঠা রূপে বন্দনা করা হয়েছে।
শিবপুরাণের সরস্বতী তপ্তকাঞ্চনবর্ণা, চতুর্ভূজা, ত্রিনয়না, শিরে চন্দ্রকলাশোভিতা, বর ও অভয়মুদ্রা-শোভিতহস্তা, সর্বলক্ষণসম্পন্না, শ্বেতপদ্মে উপবিষ্টা, নীলকুঞ্জিত কেশশোভিতা।
অগ্নিপুরাণে সরস্বতী পুস্তক অক্ষমালিকা, বীণাহস্তা চতুর্ভূজা। আবার এই অগ্নিপুরাণেই অন্য এক স্থানে ‘বাগেশ্বরীর’ ধ্যানে সরস্বতী চতুর্ভূজা, ত্রিলোচনা, পুস্তক অক্ষমালা বর ও অভয়মুদ্রাধারিণী। লক্ষ্যণীয় যে এই পুরাণেই আবার দেবী সরস্বতীকে অষ্টাভূজা রূপেও বর্ণনা করা হয়েছে।
গড়ুর পুরাণে দেবী সরস্বতীর শক্তি আট প্রকার। যথা শ্রদ্ধা, ঋষি, কলা, সেবা, তুষ্টি, পুষ্টি, প্রভা ও মতি। তন্ত্রশাস্ত্রে এই আটশক্তি হলেন যোগা, সত্যা, বিমলা, জ্ঞানা, বুদ্ধি, স্মৃতি, মেধা ও প্রজ্ঞা।
স্কন্দপুরাণে সুসংহিতায় সরস্বতীর মস্তকে জটা, মুকুটে চন্দ্রকলা, ত্রিনয়না ও নীলগ্রীবা। দেবী এখানে শিবশক্তিরূপে বর্ণিতা।
বায়ুপুরাণে সরস্বতী চতুর্ভূজা, হংসারূঢ়া, বামদিকের দুই হাতে গ্রন্থ ও বরমুদ্রা, আর ডানদিকের দুই হাতে যথাক্রমে জপমালা ও বরমুদ্রা। দেবী এখানে ব্রহ্মশক্তি হিসেবে বর্ণিতা হয়েছেন।
ব্রহ্মবৈবর্ত পুরাণে দেবী চতুর্ভূজা, পীতবসনা, নানা অলঙ্কারে অলঙ্কৃতা, বীনাপুস্তকধারিণী, ব্যাখ্যা মুদ্রা ও বরমুদ্রাধারিণী। এই বর্ণনা থেকে মনে হয় চতুর্ভুজা, পীতবসনা অর্থাৎ বিষ্ণুর শক্তি রূপে সরস্বতী বর্ণিত হয়েছেন।
মার্কণ্ডেয় পুরাণে দেবী দুর্গার অপর রূপ হিসেবে দেবী সরস্বতীকে দেখানো হয়েছে। এই পুরাণের শ্রীশ্রী চণ্ডীতে মহাসরস্বতী রূপে শুম্ভ-নিশুম্ভকে বধ করেছিলেন। এই মহাসরস্বতী গৌরবর্ণা, অষ্টভূজা। তাঁর হাতে ছিল বাণ, শঙ্খ, চক্র, হল, মুষল, শূল ও ঘণ্টা। এখানে মা বিদ্যাদাত্রী রূপে নয় অন্যায়ের প্রতীক দুষ্ট অসুরদ্বয়কে বধ করে শান্তি প্রতিষ্ঠা করেছিলেন।
তবে একথা মনে রাখতে হবে যে বাঙালির দুর্গাপুজোয় মা দুর্গার মেয়ে রূপে সরস্বতী অন্য ভাই বোনদের সঙ্গে পূজিত হন। তবে এই মা সরস্বতীর ধ্যানমন্ত্র প্রণাম মন্ত্র সব এক হলেও এই সরস্বতী পৌরাণিক সরস্বতী নন।
কালিকাপুরাণে সরস্বতীর বাম হাতে বীণা ও পুস্তক আর দক্ষিণহাতে মালা ও কমণ্ডলু, শুক্লবর্ণধারিণী, মহাচলের পৃষ্ঠেস্থিতা,শ্বেতপদ্মের ওপর উপবিষ্টা, শুক্লবস্ত্রা ও শুভ্র অলঙ্কার ভূষিতা। প্রাচীন ভারতবর্ষে মা সরস্বতী সিংহের ওপর আসীনা ও হাতে শূল ধারণ করে আছেন এই মূর্তিতে পূজিত হতেন। আমাদের সমাজে মা সরস্বতী শুধু শুক্লাবর্ণা জ্ঞানদাত্রীরূপেই নয়, অন্য রূপে আলাদা মন্ত্রেও পূজিত হন। যেমন তন্ত্রমতে নীল তারা বা নীল সরস্বতী রূপ পূজিত হন। এই দেবীর উপাসনা করলে ভক্ত অপার জ্ঞানের অধিকারী হন। দশমহাবিদ্যার নবম ‘দেবী মাতঙ্গী’ আসলে তন্ত্রমতে সরস্বতী।
এইভাবে আমাদের সমাজে বৈদিক মতে ও তন্ত্র মতে দেবী সরস্বতী বিভিন্ন রূপে ও ভিন্ন ভিন্ন উদ্দেশ্যে পূজিত হন। তবে সরস্বতীদেবী যে মতে যে রূপেই পূজিত হন না কেন তিনি কলুষতাহীন সদ্ জ্ঞানের অধিষ্ঠাত্রীদেবী। তাই প্রাচীন যুগ, আর্যযুগ, পরবর্তী আর্য যুগ বেদ-পুরাণ থেকে শুরু করে তন্ত্রদেবী হিসেবেও দেবী সরস্বতী পূজিত হয়ে আসছেন।
দূর্বা বাগচী