বিদ্যার জন্য স্থান পরিবর্তন হতে পারে। গবেষণামূলক কাজে সাফল্য আসবে। কর্মপ্রার্থীরা কোনও শুভ সংবাদ পেতে ... বিশদ
গোন্দলপাড়ার ওই বাড়িতে তখন অবস্থান করছেন কয়েকজন বিপ্লবী যুবক আর তাদের তথাকথিত দাদা-বউদি। ওই যুবকেরা পণ করেছেন তাঁরা আর পালাবেন না। পালাতে পালাতে আজ তাঁরা মরিয়া। ব্রিটিশ পুলিসের সঙ্গে মুখোমুখি লড়াই করবেন। হয় মারবেন, নয় মরবেন। সেদিনের সেই অকুতোভয় বিপ্লবীরা হলেন ছদ্মবেশে অতুল ওরফে গণেশ ঘোষ, অশোক মানে মাখনলাল ঘোষাল, বাচ্চু অর্থাৎ আনন্দ এবং অজয়ের পরিচয়ে লোকনাথ বল।
এঁরা সকলেই চট্টগ্রাম আন্দোলনের বীর সৈনিক। বিপ্লবীরা জানতেন তাঁদের ধরতে অথবা মারতে আসছে ব্রিটিশ পুলিস। তবু তাঁরা অকুতোভয়। খবর পেয়ে বিপ্লবী বসন্ত বন্দ্যোপাধ্যায় ভাই সত্যেনকে তাঁদের খবর দিতে পাঠিয়েছিলেন। পুলিস কমিশনার টেগার্ট স্বয়ং আসছেন। বিপ্লবীরা যেন চন্দননগর ত্যাগ করেন। কে এক কালীপদ ঘোষ বিশ্বাসঘাতকতা করে পুলিসকে তাঁদের ঠিকানা জানিয়ে দিয়েছে। ফরাসি আইনে রাতে কোনও বাড়ি খানা-তল্লাসী করার নিয়ম নেই। সুতরাং ভোর পর্যন্ত তাদের অপেক্ষা করতেই হবে। বাড়ি ঘিরে ওঁত পেতে বসে আছে তারা, টেগার্ট আর তার বিশাল পুলিসবাহিনী।
আর সময় নেই। বিপ্লবী গণেশ ঘোষ বললেন, পেছনের দরজা দিয়ে রিভলভারের গুলি ছুঁড়তে ছুঁড়তে এগতে হবে। ওঁরা বার হতেই শুরু হল পুলিসের গুলিবৃষ্টি। টর্চের জোরালো আলোয় চারপাশ একদম দিনের আলোর মতো পরিষ্কার। তবে শেষরক্ষা হল না। মাখন ঘোষালের বুকে, মাথায়, শরীরের বিভিন্ন অংশে লাগল গুলি। ছিটকে পুকুরের জলে পড়লেন তিনি। সবচেয়ে কমবয়সি আনন্দ গুপ্তের ঊরুতে গুলি লাগায় তিনি তখন মাটিতে ধরাশায়ী, লড়াই শেষ।
অকথ্য নির্যাতন শুরু হল বন্দি বিপ্লবীদের ওপর। নারী হয়েও রেহাই পেলেন না ছদ্মবেশী বউদি মানে বিপ্লবী সুহাসিনী গাঙ্গুলি। ব্রিটিশ পুলিসের লাঞ্ছনায় অতিষ্ঠ হয়ে তিনি গর্জে উঠলেন। ‘তোমরা সভ্য জাত বলে গর্ব কর, এই তার পরিচয়?’ আনন্দ গুপ্ত, লোকনাথ বল, গণেশ ঘোষ, সুহাসিনী গাঙ্গুলি আর তাঁর ছদ্ম স্বামীর বেশধারী শশধর আচার্যকে বন্দি করে গাড়িতে তুলল তারা। ওদিকে পুকুরের জল থেকে মাখনলাল ঘোষালের মৃতদেহ উদ্ধার করে মেয়রের নেতৃত্বে মিছিল করল চন্দননগরবাসী। সেই স্বনামধন্য মেয়র হলেন চারুচন্দ্র রায়। যাঁর নেতৃত্বে শহরবাসী ফরাসি পুলিসকে মৃতদেহ স্পর্শ করতে দেয়নি। চট্টগ্রামের অগ্নিমন্ত্রে দীক্ষিত মাখনলালের নশ্বর দেহ ভস্মীভূত হল চন্দননগরের মহাশ্মশানে। আর সেই থেকে চট্টগ্রামের স্বাধীনতা সংগ্রামীদের সঙ্গে চন্দননগরবাসী বাঁধা পড়লেন অচ্ছেদ্য বন্ধনে।
পরবর্তীকালে পাওয়া ‘জাজমেন্ট রিপোর্টে’ ওই ঘটনা সম্পর্কে লিপিবদ্ধ লাইনগুলি হল ‘১৯৩০ সালের ১ সেপ্টেম্বরের মধ্যরাতে দশজন সার্জেন্ট এবং একজন কলকাতা পুলিসের ইন্সপেক্টর ও আরও দশজন পদস্থ অফিসার, যাঁদের মধ্যে ছিলেন পুলিস কমিশনার চার্লস টেগার্ট, ডেপুটি কমিশনার বার্টবি এবং ম্যাকেন্টি, ছ’টি মোটরগাড়িতে কলকাতা ত্যাগ করেন ও রাত তিনটেয় চন্দননগর পৌঁছন।’ এই সমস্ত ঘটনার পেছনে ছিলেন এক বীরাঙ্গনা। তিনিই বিপ্লবী নেত্রী সুহাসিনী গাঙ্গুলি।
১৯৪৩ সাল। জেলে বসে ফেলে আসা দিনগুলোর কথা ভাবছিলেন সুহাসিনী। ২ সেপ্টেম্বর ১৯৩০-এ প্রথম পুলিসের হাতে বন্দি হন। কুখ্যাত হিজলি জেলে ছ-ছ’টা বছর কাটল। তারপর ‘বেঙ্গল অর্ডিন্যান্সে’ গ্রেপ্তার হয়ে সিউড়ি জেলে, কলকাতার বিভিন্ন জেলে কাটল অনেকগুলো দিন। অবশেষে ১৯৩৮ সালে এল সাময়িক মুক্তি। ১৯৪২-এ আবার কারাবাস। যদিও প্রায় বিনা দোষেই। এখনও অধরা সেই স্বপ্ন— দেশমাতৃকার স্বাধীনতা। মাঝেমাঝেই মনে পড়ে ভয়ঙ্কর সেই রাতটার কথা। ১৯৩০-এর ১ সেপ্টেম্বর। সন্ধেবেলা রুটি করতে করতে বারবার মনে হচ্ছিল ভয়ানক কিছু ঘটবে সেদিনই। ভাইদের জন্য হয়তো রুটি আর বানাতে হবে না। উনুনে ধিকিধিকি জ্বলছে আগুন। সেই আঁচের দিকে তাকিয়ে হঠাৎই অন্যমনস্ক হয়ে গেলেন তিনি।
দেশের বাড়ির কথা ভাবতে ভাবতে কখন যে অন্যমনস্ক হয়ে গিয়েছিলেন। শেষ রুটিটা একদম পুড়ে গেল। ওটাকে আড়াল করে রাখতে হবে। খাওয়ার সময় নিয়ে নেবেন। দেখতে পেলে ভাইরা চেঁচাবে। ওরা যে তাঁদের পুঁটুদিদিকে বড্ড ভালোবাসে। কিন্তু এই দুর্মূল্যের বাজারে কিছুই তো ফেলা যাবে না। চার চারটে জোয়ান ছেলে আবার তাঁরা দু’জনও আছেন। এতগুলো লোকের খাবারের সংস্থান করা কম কথা নয়। রেলের চাকরিতে রোজ যাতায়াত করতে হয়। তবু শশধরবাবু দোকান-বাজার সব এক হাতে সামলে নিচ্ছেন। রান্নাবান্না করেন তিনি। ভাইরা থাকে বন্ধ বাড়িতে নিশ্চুপে, আত্মগোপন করে।
ঘরের কাজকর্ম সামলে প্রতিদিন ইস্কুলে ছোটেন সুহাসিনী। স্থানীয় কাশীশ্বরী পাঠশালার হেডমিস্ট্রেস তিনি। গোঁদলপাড়ার সব লোক, সর্বক্ষণ সমীহ করে চলে। আজ রাতের পর হয়তো সবকিছু জানাজানি হয়ে যাবে। ভারী অবাক হবে সবাই।
খবর এসেছে। বসন্তবাবু তাঁর ভাইকে দিয়ে খবর পাঠিয়েছেন। যে কোনও সময় কলকাতার পুলিস কমিশনার চার্লস টেগার্ট তার দলবল সমেত হাজির হবে। যেটুকু সময় আছে, নৌকা করে নদী পেরিয়ে পালানো যায়।
কিন্তু ভাইরা রাজি নয়। গণেশ, আনন্দ, মাখন, লোকনাথ সবাই একসঙ্গে যা বলেছে তা হল ‘করেঙ্গে ইয়া মরেঙ্গে’। পালাতে পালাতে দেওয়ালে পিঠ ঠেকে গিয়েছে। এবার মুখোমুখি হতে হবে। ধর্মযুদ্ধ! দেশের স্বাধীনতার জন্য যুদ্ধ! যা হবার হোক। ‘চলরে চল সবে ভারত সন্তান, মাতৃভূমি করে আহ্বান’। গাইছিল ওরা। তিনি গলা মেলাতে পারেননি। এই ক’দিনেই বড় মায়ায় জড়িয়েছে ছেলেগুলো। ওদের বিপদের কথা ভাবলে বুক কেঁপে ওঠে যে।
ঢাকার বাড়িতে মা মাঝেমাঝে বড় আক্ষেপ করতেন। চার চারটে মেয়ে। বিয়ে দেব কী করে? এই তো টানাটানির সংসার। মা এখানে থাকলে দেখতেন নকল সংসারের নকল স্বামীর সঙ্গে নকল স্ত্রী সেজে চমৎকার সংসার করছেন তিনি। বাড়তি পাওনা সোনার মতো উজ্জ্বল ভাইদের সঙ্গ। ঢাকার কলেজে পড়তে পড়তেই চিন্তাভাবনার শুরু। পরাধীন মায়ের শৃঙ্খল মোচনের ডাক এসেছে। ডাকছেন মাস্টারদা সূর্য সেন। চট্টগ্রামে মাস্টারদা, ঢাকায় সুভাষচন্দ্র, যুবশক্তিকে আহ্বান জানাচ্ছেন, মেয়েদেরও সমান গুরুত্ব দিচ্ছেন তাঁরা। দেশমাতৃকার শৃঙ্খল মুক্ত করতে দলে দলে যুবক-যুবতী যোগ দিচ্ছে তাঁদের সংগ্রামে। না, গান্ধীজির অহিংস আন্দোলন নয়, সহিংস আন্দোলনেই যোগ দেবেন তিনি।
কলকাতা। গঙ্গা নদীর তীরে প্রাণবন্ত এক শহর। বিপ্লবের পীঠস্থান। ‘ডেফ এ্যান্ড ডাম্ব’ স্কুলের কাজ নিয়ে সেই কলকাতায় অবশেষে পৌঁছে গেলেন তিনি। দেশ জুড়ে স্বদেশি উন্মাদনা, তার কেন্দ্রবিন্দুতে কলকাতা শহর। আলাপ হল কমলাদি, মানে কমলা দাশগুপ্তের সঙ্গে। তিনি আবার সঙ্গে করে নিয়ে গেলেন রসিকলাল দাসের কাছে। দেশের ডাক এসেছে। গুরুতর দায়িত্ব পালন করতে হবে। ১৯২৯-এ চট্টগ্রাম অস্ত্রাগার লুণ্ঠনে তাঁর কোনও ভূমিকা ছিল না। প্রীতিলতা, কল্পনা, মাস্টারদার মন্ত্র শিষ্যারা নিঃসঙ্কোচে সেই দুঃসাহসিক কাজে ঝাঁপিয়ে পড়েছিলেন। লড়াই শেষ। এবার বিপ্লবীদের আত্মগোপনের পালা। গণেশ ঘোষ, অনন্ত সিংহ, মাখন ঘোষাল, আনন্দ গুপ্তদের গোপন আশ্রয় চাই। ফরাসি অধিকৃত চন্দননগরে যদি সেই আশ্রয় মেলে সবদিক দিয়ে নিশ্চিন্ত হওয়া যায়। গোন্দলপাড়ার বসন্ত বন্দ্যোপাধ্যায় নিলেন সেই দায়িত্ব। চন্দননগরের দক্ষিণে তেমাথায় কাশীশ্বরী পাঠশালা অবস্থিত। সেই পাঠশালার জন্য একজন বিবাহিত শিক্ষয়িত্রী চাই। যদি সুহাসিনী সেই পদে যোগ দিয়ে গোন্দলপাড়ায় বসবাস করেন, সব গোল মেটে। কিন্তু সুহাসিনী তো বিবাহিত নন। শেষ পর্যন্ত সমাধান হল সেই সমস্যার। শশধর আচার্য, ইস্ট ইন্ডিয়া রেলের কর্মচারী, স্বদেশের আহ্বানে এগিয়ে এলেন। সুহাসিনীর স্বামীর ভূমিকায় তিনি নিঃসঙ্কোচে এসে উঠলেন গোন্দলপাড়ায় জনৈক দাশরথী ঘোষের বাড়িতে। সুহাসিনীর ভাই হিসেবে এলেন বিপ্লবী হেমন্ত তরফদার। স্বামী রেলের কাজে, স্ত্রী স্কুলের কাজে বেরিয়ে যান। বাড়ি থাকে তালাবন্ধ। আত্মগোপনের এমন নিরাপদ জায়গা আর কোথায় পাওয়া যাবে?
১৯৩০-এর মে মাসে মোটরগাড়িতে চেপে ছদ্মবেশে এসেছিলেন অনন্ত সিংহ, আনন্দ গুপ্ত, মাখন ঘোষাল আর গণেশ ঘোষ। রক্তক্ষয়ী সংগ্রামের বীর অংশগ্রহণকারীরা। সেই বছরই জুন মাসে হঠাৎ কলকাতায় আত্মসমর্পণ করলেন অনন্ত সিংহ। এবার এলেন লোকনাথ। লোকনাথ বল। ফাঁকা বাড়িতে গণেশ ঘোষের নির্দেশে রিভলভারের কার্তুজ, বোমা তৈরি করেন তাঁরা। বিপ্লবের প্রস্তুতি চলে সংগোপনে। ১৯৩০, সুহাসিনীর জীবনে পরপর ঘটনার মিছিল। বাবা মারা গেলেন। সংসারের চরম দুরবস্থা। সবকথাই কানে আসে, কিন্তু নিরুপায় তিনি। চন্দননগরে তাঁর ভূমিকা যে নির্দিষ্ট হয়ে গিয়েছে। কর্তব্য আগে, ব্যক্তিস্বার্থ পরে। না! দিনগুলো সত্যিই বড় ভালো কাটছিল। দোতলায় ভেতর দিকের একটা ঘরে থাকতেন বিপ্লবীরা। তাঁরাই পালা করে রাতে পাহারা দিতেন বাড়ির ছাদে। তাই সেদিন আনন্দ গুপ্তের নজরে পড়েছিল পুলিসি হেলমেটের নড়াচড়া। পরদিন বৃষ্টি পড়েছিল চন্দননগরে। শহিদের মৃতদেহ নিয়ে শোভাযাত্রা হয়েছিল চন্দননগরের পথে। পুলিসের ভ্যানে ওঠার সময় তাঁর মনে পড়েছিল মাখনের কথা। মনে মনে ভাবছিলেন তাঁর পাঠশালার ছোট ছোট ছাত্রীরা স্বাধীন ভারতের মাটিতে পা রাখবে তো? অজস্র মাখনের এই মৃত্যু নিশ্চয়ই ব্যর্থ হবে না। স্বাধীনতা সংগ্রামের দীর্ঘ ইতিহাসে আত্মকথনরত মহিলাটির বিশেষ ভূমিকা ছিল। ১৯০৯ সালের ৩ ফেব্রুয়ারি মতান্তরে ১৯০৭ সালের ৩ ফেব্রুয়ারি খুলনায় জন্মগ্রহণ করেন সুহাসিনী গাঙ্গুলি। তিনি ছিলেন স্বাধীনতা সংগ্রামের এক নির্ভীক সেনানী। তথ্যসূত্র: সুহাসিনী গাঙ্গুলি—অমলেন্দু দে, আবার আসিব ফিরে—বিমলেন্দু বন্দ্যোপাধ্যায়
সর্বাণী বন্দ্যোপাধ্যায়