খরা, বন্যা এবং ঘূর্ণিঝড়! এই ত্র্যহস্পর্শেই জলবায়ু বদলজনিত বিপদের আশঙ্কায় বিশ্বে পঞ্চম স্থানে উঠে এসেছে ভারত। একটি জার্মান পরিবেশ গবেষণা সংস্থার প্রকাশিত সমীক্ষা রিপোর্টে একথা জানিয়েছেন পরিবেশবিদরা। ২০১৮ সালে বিশ্বে যে-ধরনের জলবায়ুগত বিপর্যয় হয়েছে, তার নিরিখেই এই তালিকা প্রকাশ করেছে ওই সংস্থা। তালিকার শীর্ষ স্থানে রয়েছে জাপান। ওই সমীক্ষায় বলা হয়েছে, ২০১৮ সালে ভারতের অনেক জায়গাই প্রবল তাপপ্রবাহের কবলে পড়েছিল। অতিবৃষ্টিতে বিপর্যয় ঘটে কেরলে। আবার ঘূর্ণিঝড় গজ, তিতলি, বুলবুলের দাপটে পূর্ব উপকূল ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে। জলবায়ুগত বিপর্যয়ে মৃত্যুর দিক থেকে ভারত এক নম্বরে। আর্থিক ক্ষতির দিক থেকে তার স্থান দ্বিতীয়। এসব তথ্যের নিরিখেই জলবায়ুর পরিবর্তনগত ঝুঁকি-সূচিতে ভারত পঞ্চম স্থানে রয়েছে বলে জানাচ্ছেন পরিবেশবিদেরা। তাই তাঁরা ভারতকে বিশেষ গুরুত্ব দিচ্ছেন। ২০১৭ সালে এই সমীক্ষায় ভারত ছিল চতুর্দশ স্থানে, এক বছরে উঠে এসেছেপঞ্চম স্থানে। শুধু ভারত নয়, গোটা পৃথিবীর আবহাওয়াই দ্রুত বদলে যাচ্ছে। ধীরে ধীরে অস্বাভাবিক মাত্রায় উত্তপ্ত হয়ে উঠেছে এই গ্রহ। পৃথিবী নষ্ট হয়ে বাসের অনুপযোগী হয়ে গেলে মানুষ থাকবে কোথায়! আবহাওয়াবিদদের এই নিয়ে চিন্তার শেষ নেই। হলিউড এই নিয়ে একটা সিনেমা তৈরি করেছিল ২০০৪ সালে। ছবির নাম ছিল ‘ডে আফটার টুমরো’। সেখানে দেখানো হয়েছিল কীভাবে বরফ যুগ গ্রাস করছে আমেরিকাকে। একটুখানি রোদের আশায় লাখ লাখ মানুষ দেশ ছেড়ে পালাচ্ছে মেক্সিকোর দিকে। নিউ ইয়র্ক জনশূন্য। যেখানে ঘুরে বেড়াচ্ছে নেকড়ের দল। ওদিকে ঘূর্ণিঝড় ক্যালিফোর্নিয়ায়। শিলাবৃষ্টি টোকিওতে। আর দাবানল বহু জায়গায়। ফক্স-এর আগে আর কেউ এমন ভয়াবহ ছবি তৈরি করেছে কি না জানা নেই। তবে, সিনেমাটিতে মানুষকে আবহাওয়া বিপর্যয় সম্পর্কে সতর্কতার বার্তা দিয়েছে খুবই ভয়ঙ্কর চেহারায়।
তবু, মানুষের চেতনা কই! সাধারণ মানুষের কথা কী বলব, যেদিন ২০০৫ সালের ১৬ ফেব্রুয়ারি থেকে কিয়োটো প্রটোকল পুরোপুরি আইনে বলবৎ হওয়ার কথা ছিল, সেদিন আমেরিকার প্রেসিডেন্ট জর্জ ডব্লিউ বুশ বলেছিলেন, আমি কিয়োটো প্রটোকল মানি না। আর এখন আমেরিকার আরেক প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্প প্যারিস চুক্তি থেকে আমেরিকার নাম প্রত্যাহার করে নিয়েছেন। উভয় প্রেসিডেন্টের যুক্তি হল—মানুষের তৈরি পরিস্থিতির কারণে আবহাওয়ার পরিবর্তন হতে পারে, তাঁরা তা বিশ্বাস করেন না।কয়েক বছর ধরেই ইউরোপের বিভিন্ন দেশে প্রবল তাপপ্রবাহ দেখা গিয়েছে। শতাব্দীর যাবতীয় রেকর্ডকে ছাপিয়ে গিয়েছে সেই তাপপ্রবাহ। এর পিছনে সরাসরি জলবায়ু পরিবর্তনকে দায়ী করেছেন গবেষকেরা। তাঁরা জানাচ্ছেন, জলবায়ুগত বিপর্যয়ে যে-ভাবে প্রাণহানি ও সম্পত্তির ক্ষতি হচ্ছে, তা আন্তর্জাতিক ক্ষেত্রেও চিন্তার কারণ। পরিবেশ বিজ্ঞানীরা বলছেন, মানবসভ্যতার জন্য অপেক্ষা করছে মহাপ্রলয়ের মতো বিপর্যয়। রাষ্ট্রসঙ্ঘ নিয়োজিত ‘ইন্টারগভর্নমেন্টাল প্যানেল অন ক্লাইমেট চেঞ্জ’ (আইপিসিসি)-এর বিজ্ঞানীরা বলছেন, বিশ্ব উষ্ণায়ন ছিল শুধুই বিপদের আগাম পূর্বাভাস। এবার সরাসরি তার ফল ভুগতে শুরু করেছে মানবগ্রহ। শিল্প বিপ্লবের (১৭৫০-১৮৫০) পর থেকে এই প্রথম পৃথিবীর তাপমাত্রা বেড়েছে ১ ডিগ্রি সেলসিয়াস। হ্রাসের পরিবর্তে বেড়েই চলেছে গ্রিন হাউস গ্যাস নির্গমণ। তার জেরে অ্যান্টার্কটিকা আর গ্রিনল্যান্ডে বরফ গলার হার আরও বাড়ছে। আরও উষ্ণ হচ্ছে পৃথিবী। অবিলম্বে ব্যবস্থা না নিলে ২০৩০-এর মধ্যে এই তাপমাত্রা বেড়ে যেতে পারে দেড় ডিগ্রি সেলসিয়াস পর্যন্ত। এই কারণেই ভয়ঙ্কর এবং অভূতপূর্ব উদ্বেগের কথা উল্লেখ করেছেন বিজ্ঞানীরা। পৃথিবীর তাপমাত্রা দেড় ডিগ্রি বেড়ে গেলে কী কী হতে পারে, তার ইঙ্গিত দিয়েছেন বিজ্ঞানীরা। অ্যান্টার্কটিকা ও গ্রিনল্যান্ডে আরও দ্রুত গলবে বরফ। দক্ষিণ গোলার্ধে উষ্ণতা বাড়লে তার প্রভাব পড়বে গোটা বিশ্বেই। পাহাড়প্রমাণ হিমশৈল তথা বরফের চাঁই গলে সমুদ্রের জলে মিশবে। আয়তন বাড়বে জলভাগের। ধীরে ধীরে নষ্ট হয়ে যাবে বাস্তুতন্ত্র। নিউ ইয়র্ক, লন্ডন, মুম্বই জলে তলিয়ে যাবে।
অথচ, কে না জানে, কার্বন ডাই অক্সাইড তৈরি করছে শিল্পোন্নত দেশগুলোই। কয়লা, ডিজেল, গ্যাস অর্থাৎ জীবাশ্ম জ্বালানি যত ব্যবহার করা হচ্ছে, ততই মিথেন তৈরির পরিমাণ বাড়ছে। সুতরাং কার্বন-ডাই-অক্সাইড প্রতিরোধের জন্য এবং আবহাওয়ার বিপর্যয় ঠেকাতে গরিব দেশগুলোকে সাহায্য করার জন্য একটা তহবিল তৈরির কথা হয়েছিল। এই ফান্ডে অনুদান হিসেবে ধনীদেশগুলোর টাকা দেওয়ার কথা ছিল। অনুদান যে দিচ্ছে না তা নয়, কিন্তু পরিমাণ সামান্যই। তাহলে পৃথিবীকে রক্ষা করবে কারা? পৃথিবীটাই না-বাঁচলে, ঘটা করে রাষ্ট্রসঙ্ঘের জলবায়ু সম্মেলন করে লাভ কী? নানা প্রশ্নের উত্তর খুঁজতে গোটা দুনিয়া তাকিয়ে স্পেনের রাজধানী মাদ্রিদের দিকে। হয়তো ২-১৩ ডিসেম্বর ধরিত্রী বাঁচানোর শেষ সুযোগ পাবেন বিশ্বনেতারা!